নৃবিজ্ঞানের উদ্ভবের এঁতিহাসিক প্রেক্ষাপট

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভবের এঁতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “নৃবিজ্ঞান পরিচিতি” বিষয়ের “নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ” বিভাগের একটি পাঠ।  আক্ষরিক অর্থে নৃবিজ্ঞান (ইংরেজি ভাষায় Anthropology) মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। নৃবিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো অতীত ও বর্তমানের মানব সমাজ ও মানব আচরণকে অধ্যয়ণ করা । কিন্তু মানুষ বিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির চেয়ে এটির পরিধি ব্যাপকতর। বিশ্বের সকল অঞ্চলের, সংস্কৃতির মানুষকে নিয়ে এই বিজ্ঞানে গবেষণা করা হয়। লক্ষ কোটি বছর ধরে মানুষের বিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের গবেষণাও নৃবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে।

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভবের এঁতিহাসিক প্রেক্ষাপট

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ
নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ

 

নৃবিজ্ঞানের  উদ্ভবের এঁতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভবের পেছনে যে অনুসন্ধিৎসা কাজ করেছে, তা একভাবে অতি পুরাতন। “আমরা  কোত্থেকে এলাম? এই দুনিয়ায় কে কোথায় দীড়িয়ে আছি? কে কোথায় যাচ্ছি? এ ধরনের প্রশ্ন কোন না কোন
আকারে সম্ভবত উচ্চারিত হয়েছে পৃথিবীর বুকে চিন্তাক্ষম মানুষের আবির্ভাবের সময় থেকেই।

প্রায় প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই  মানুষ, প্রকৃতি ও বিশ্বর্মান্ডের উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু “মিথ” বা সৃষ্টিকাহিনী চালু রয়েছে। এসব কাহিনী যে সবসময় সকলের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তা নয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসারের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধমীয়ি বা পৌরাণিক ব্যাখ্যার মাধ্যমেই মানব প্রকৃতি ও উৎপত্তি-রহস্য সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর সাধারণভাবে খোজা হয়েছে।

সেদিক থেকে নৃবিজ্ঞানের আবির্ভাবকে দেখা যেতে পারে বিজ্ঞানের আলোকে নিজের সম্পর্কে মানুষের অতি পুরাতন কিছু প্রশ্নের নূতন উত্তর খোজার সংঘবদ্ধ প্রয়াস হিসাবে, যা সম্ভব হয়েছে অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালে, পাশ্চাত্যের ইতিহাসে এ ধরনের চর্চার অনুকূল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক আবহ তৈরী হওয়ার পর।

নৃবিজ্ঞানকে অনেক সময় “অন্যকে অধ্যয়নের বিজ্ঞান” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই “অন্য” হতে পারে পুরো মানব প্রজাতির প্রেক্ষিতে অন্যান্য প্রাণী, বা বর্তমান কালের মানুষদের প্রেক্ষিতে সুদূর অতীতের মানুষেরা, বা নৃবিজ্ঞান চর্চার প্রবর্তকদের চোখে সভ্যতার মাপকাঠিতে তাদের নিজেদের সমাজ থেকর পিছিয়ে থাকা অন্যরা। আসলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের নিজের সম্পর্কে জানার কৌতুহল আর অন্যকে জানার কৌতুহল অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। অন্যকে জানার মাধ্যমে, বা “অন্য কে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খোজার মাধ্যমেই মানুষ সর্বত্র ‘নিজ’ সম্পর্কে ধারণা তৈরী করেছে।

 

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ
নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ

 

সকল মানব সমাজেই বিভিন্ন আকারে “আমরা” ও “ওরা” ধরনের ভিন্নতার বোধ তৈরী করা হয়। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সমাজ স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন প্রাচীন কালের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

এই প্রেক্ষিতে “ইতিহাসের জনক” বলে খ্যাত  খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতান্দীর গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে কোন কোন নৃবিজ্ঞানী নিজেদেরও পূর্বসূরী হিসাবে গণ্য করেন, কারণ গ্রীস ও পারস্যের মধ্যেকার ছন্দের যে ইতিহাস তিনি লিখেছিলেন, তাতে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে লব্ধ নিজের অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন তথ্য তিনি যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ সহকারেই উপস্থাপন করেছিলেন। কোন কোন নৃবিজ্ঞানী আবার প্লেটো বা এ্যারিস্টটলের মধ্যে নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার দার্শনিক ভিত্তির উৎস খুঁজে পান।

এমন একটা গল্প চালু আছে যে, মানুষের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে প্লেটো ও তার শিক্ষার্থীরা মিলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, “মানুষ হচ্ছে একটি পালকবিহীন দ্বিপদ প্রাণী”। এ কথা শুনে অন্য এক গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস নাকি একটি মোরগের সকল পালক উঠিয়ে সেটাকে প্লেটোর সভায় হাজির করে বলেছিলেন, “প্লেটোর মানুষ”, যার প্রেক্ষিতে উক্ত সংজ্ঞায় সংশোধনী আনা হয় বাড়তি একটি শর্ত যুক্ত করে: ‘নখর-বিহীন”।

একটি জ্ঞানকান্ড হিসাবে নৃবিজ্ঞানের উদ্ভবের সার্বিক প্রেক্ষাপট অবশ্য তৈরী হয়েছিল আরো অনেক পরে,যা আমরা ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটি বিগত পাঁচ শতান্দীর মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের আলোকে দেখতে পারি। আজ থেকে পাঁচশ” বছরের কিছু আগে সংঘটিত কলম্বাসের নৌ-অভিযাত্রার মাধ্যমে ইউরোগীয়রা তখন পর্যন্ত তাদের সম্পূর্ণ অজানা নৃতন নূতন ভূখন্ডের খোজ পায়– ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সহ দুইটি বিশাল মহাদেশ–যেগুলিকে তারা একত্রে ‘নুতন বিশ্ব (New World) নামে অভিহিত করতে শুরু করে।

 

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ
নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ

 

এই ‘নৃতন বিশ্বের সন্ধান লাভ ইউরোপীয়দের ওপনিবেশিক সম্প্রসারণের পথ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের চিন্তা-চেতনাতেও বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। তখন পর্যন্ত অধিকাংশ ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা বাইবেলের ভিত্তিতেই চেনা জগতকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু এই নূতন বিশ্বের অস্ত বা সেখানকার মানুষদের উৎস ব্যাখ্যার জন্য বাইবেল থেকে স্পষ্ট কোন সুত্র পাওয়া যাচ্ছিল না।

অন্যদিকে প্রায় একই সময়কালে পোলিশ জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস এ ধারণা প্রথম নিয়ে আসেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, যেটা গ্যালিলিওর মাধ্যমে আরো প্রতিষ্ঠিত হয়। আপনি নিশ্চয় জানেন যে গ্যালিলিও তার মতামতের জন্য শাস্তি ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তৎকালে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত চার্চ কর্তৃপক্ষের হাতে, যারা গ্যালিলিও সূর্য-কেন্দ্িক বিশ্বের ধারণাকে মেনে নিতে পারে নি, কারণ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে ভাবা হত মানুষ ও পৃথিবীকেই।

তবে নানা কারণে চার্চের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না পুরাতন বিশ্ববীক্ষার আধিপত্য টিকিয়ে রাখা। কারণ সময়টা ছিল ইউরোপীয়দের জন্য নৃতন করে জেগে ওঠার, বা রেনের্সার, যা ইতালীতে সূচিত হয় প্রাচীন গ্রীসের শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন পুনরাবিস্কারের মাধ্যমে। পঞ্চদশ শতান্দীতে মুদ্রণ প্রযুক্তির উদ্ভাবন সুগম করে দিয়েছিল নৃতন নৃতন ধ্যান-ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার রাস্তা। রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে বেরিয়ে তৈরী হয় নৃতন নৃতন সংস্কারবাদী ধমীয়ি সম্প্রদায়, যারা সামগ্রিক ভাবে প্রটেস্টান্ট নামে পরিচিত।

এসব পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সংঘটিত হয় বড় ধরনের দু’টি রাজনৈতিক বিপ্লব: আমেরিকান বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লব, যেগুলি যথাক্রমে ইবল্যান্ড ও ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের ভিত্তি নাড়িয়ে বা ভেঙে দেয়। ততদিনে শিল্প বিপ্লবও শুরু হয়ে গেছে, যা গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে উৎপাদন ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন আনে।

 

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ
নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ

 

অভিজাত সামন্তশ্রেণীর জায়গায় ক্ষমতার কেন্দ্র চলে আসে নগর-ভিভ্তিক একটি শ্রেণী – বুর্জোয়া (শহুরে”) পুঁজিপতিরা, অর্থাৎ কল-কারখানা, ব্যাংক ইত্যাদির মালিকরা। অষ্টাদশ শতান্দীতেই চিন্তাজগতেও ঘটে যায় একধরনের বিপ্নব – এনলাইটেনমেন্ট (Enlightenment) নামে পরিচিত বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্তি, বিজ্ঞান ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্যবাদের একটা দৃঢ় ভিত্তি রচিত হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিক-লেখক-চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকেরই নাম উল্লেখ করা যায় – যেমন, মন্তেস্ক্যু, জী-জাক রুশো, ভিকো প্রমুখ – যাদেরকে নৃবিজ্ঞানীদের কেড না কেড তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্বসূরীদের
তালিকায় রাখেন। এনলাইটেনমেন্ট চিন্তার একটা কেন্দ্রীয় ধারণা ছিল এই যে, মানব সমাজ সময়ের সাথে সাথে ক্রমবিকশিত হয়। মানব ‘প্রগতি’র ইতিহাস নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে অনেকেই নজর
দিয়েছিলেন সবচাইতে আদিম হিসাবে বিবেচিত “বন্য” (sanage) মানুষদের দিকে, অর্থাৎ যারা শুধু শিকার ও ফলমূল আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।

মানব সমাজ প্রগতির পথে ক্রমান্বয়ে শিকার থেকে পশুপালন হয়ে কৃষি ও বাণিজ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে, এই ধারণা বেশ ব্যাপকতা পেয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই। ‘ এ্যান্থোপলজি ” শব্দটা অবশ্য তখনো মূলতঃ দৈহিক নৃবিজ্ঞান” বলতে এখন আমরা যা বুঝি, সে অর্থেই ব্যবহৃত হত।

অন্যদিকে এথনোগ্রাফি ও এথনোলজি বা সমতুল্য অন্য কোন নামে গড়ে ওঠা জ্ঞানচর্চার কিছু ধারার প্রসার ঘটতে থাকে (বিশেষতঃ জার্মানভাষী দেশগুলোসহ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অন্যত্র) যেগুলোর নজর কেবল ইউরোপের বাইরের “আদিম” সমাজগুলোর প্রতি নয়, ইউরোপের ভেতরকার জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের প্রতিও ছিল।

নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ
নৃবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ

এই ধারাগুলোর অনেকটাই পরবর্তীতে সামাজিক-সাংক্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের আওতায় চলে এসেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বন্য ও আদিম হিসাবে চিহ্ত সমাজগুলোর ব্যাপারে ইউরোপীয়দের কৌতুহল শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার ব্যাপার ছিল না, এর সাথে যুক্ত ছিল রোমান্টিকতার ধারাও – যার ফলে কারো কারো কাছে ‘বন্য’রা হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক সারল্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment