আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় পরবর্তী গুপ্তরাজগণ। স্কন্দগুপ্তের পরে পুরুগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত, বালাদিত্য, দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত প্রভৃতি রাজগণ রাজত্ব করেছিলেন। এর রাজত্বকালে ক্রমে গুপ্তসাম্রাজ্য একটি ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয়ে যায়।
পরবর্তী গুপ্তরাজগণ
পরবর্তী গুপ্তরাজগণ
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর তাঁর পুত্র কুমারগুপ্ত (৪১৪-৪৫৫ খৃঃ) মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। পূর্ববর্তী গুপ্ত সম্রাটদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গৌরব ও সমৃদ্ধি তখন অক্ষুণ্ণ ছিল। মধ্য ভারতের দুর্ধর্ষ পুষ্যমিত্র নামক উপজাতি কুমার গুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করলে সমার্ট তাদের পরাজিত করে সাম্রাজ্যকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। কুমার গুপ্তের সময় সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রসার ঘটে।
পরবর্তী গুপ্তরাজার স্কন্ধগুপ্তের রাজত্বকালে (৪৫৫-৪৬৭ খৃঃ) মধ্য এশিয়া থেকে আগত দুর্ধর্ষ হুন জাতি ভারতবর্ষ-আক্রমণ করে। স্কন্ধগুপ্ত তাদের পরাজিত করেন। তাঁর রাজত্বকালে, অবশ্য হুনরা আর গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেনি।
এই কুখ্যাত হুন জাতি রোমান সাম্রাজ্যর উপর তাদের ধ্বংসলীলা চালায়। তাদেরই এক শাখা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের উপর বার বার আক্রমণ চালায় এর ফলে ভারতবর্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
নরসিংহ, দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত ও বুধগুপ্ত (৪৭৬-৪৯৫ খৃঃ ) প্রভৃতি শেষের দিকের গুপ্তরাজাদের রাজত্বকালে হুনদের আক্রমণ বার বার ঘটতে থাকে এবং এ সকল রাজারা তাদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। পরিণামে ৬ষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে এবং তার স্থানে উদ্ভব ঘটে কনৌজ, মালব, সৌরাষ্ট্র,বঙ্গ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের।
উত্থান ও পতন ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়ম। যে অপ্রতিহত শক্তি সাময়িকভাবে সকলের শ্রদ্ধা, বিস্ময় ঈর্ষা এবং ভীতির উদ্রেক করে অদূর ভবিষ্যতে তারও গৌরবরবি অস্তমিত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে নি। সমুদ্রগুপ্ত যে সাম্রাজ্যকে সর্বভারতীয় রূপদান করেছিলেন, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যার আয়তনকে আরও বৃদ্ধি করেছিলেন, সেই বিশাল সাম্রাজ্য তাঁদের মৃত্যুর একশত বছরের মধ্যেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত বংশ উন্নতির চরম শীর্ষস্থানে আরোহণ করেছিল এবং খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই পতনের সূত্রপাত হয়েছিল।
পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহ প্রথম কুমারগুপ্ত :
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ‘মহেন্দ্রাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি খুব সম্ভবতঃ ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৪৫৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। প্রথম কুমারগুপ্তের শাসন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় নি, তবে মুদ্রা এবং শিলালেখ থেকে যে সকল তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয় যে, তাঁর সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আয়তন হ্রাস পায় নি।
পুর্বদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত এই সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। তিনি যে শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন তা তাঁর দ্বারা অনুষ্ঠিত অশ্বমেধ যজ্ঞের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। তাঁর রাজত্বের প্রথমভাগে যে হুন আক্রমণ হয়েছিল তিনি সেই আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। কিন্তু এই শক্তিশালী শাসকের রাজত্বের শেষদিকে নর্মদা অঞ্চলের পুষ্যমিত্ররা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যুবরাজ স্কন্দগুপ্তকে এই বিদ্রোহ দমন করতে পাঠানো হয়েছিল। স্কন্দগুপ্ত এই সংকট থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে সম্রাট কুমারগুপ্তের যশ ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখেন। কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর স্কন্দগুপ্ত এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করেছিলেন।
স্কন্দগুপ্ত ও হুন আক্রমণ :
প্রথম কুমারগুপ্তের পর তাঁর প্রথম পুত্র স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্কন্দগুপ্তই গুপ্ত বংশের শেষ পরাক্রান্ত সম্রাট। তিনি ৪৫৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৪৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় যে স্কন্দগুপ্ত কুমারগুপ্তের সন্তানদের মধ্যে যোগ্যতম বলে কুমারগুপ্ত তাঁকেই রাজপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই স্কন্দগুপ্ত নিজ কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহ দমন ছাড়াও যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত আর এক কঠিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতবর্ষ তথা গুপ্ত সাম্রাজ্য বর্বর হন জাতির আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল।
সিংহাসনে আরোহণের পর স্কন্দগুপ্তের সর্বপ্রধান কৃতিত্ব হল হুন আক্রমণ থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা। স্কন্দগুপ্ত হুন জাতিকে এমনভাবে যুদ্ধে পরাজিত করেন যে, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তারা আর ভারত আক্রমণে সাহসী হয় নি। এই আক্রমণ থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকেও বর্বর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন। সামরিক সাফল্যই স্কন্দগুপ্তের একমাত্র কৃতিত্ব নয় । তিনি বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের জন্য সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রাখেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের মত উদার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছিলেন। সুদক্ষ যোদ্ধা ও সুশাসক স্কন্দগুপ্ত সুবিখ্যাত গুপ্ত রাজবংশের শেষ সার্থক সম্রাট।‘কথাসরিৎসাগর’ থেকে স্কন্দগুপ্ত ও বিক্রমাদিত্যের কার্যকলাপ আমরা জানতে পারি ।
স্কন্দগুপ্তের দুর্বল উত্তরাধিকারীগণ :
স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। তবে একথা সত্য যে, তাঁরা হুন আক্রমণের বিরুদ্ধে সার্থক প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। গুপ্তযুগের বংশ-তালিকা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ধারিত হয় নি। বুধগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত প্রভৃতি বহু নাম শিলালেখ থেকে পাওয়া যায়। তবে তাঁদের মধ্যে কে কে প্রধান গুপ্ত বংশের শাসক এবং কারাই বা শাখা বংশের, ঐতিহাসিকগণ আজও তা সঠিকভাবে স্থির করতে পারেন নি। এই যুগের একমাত্র বুধগুপ্ত সম্বন্ধে কিছু সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর সময়ে অর্থাৎ ৪৭৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্য অটুট ছিল। তারপর থেকেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের আয়তন ও ক্ষমতা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। হুন দলপতি তোরমান এবং মিহিরগুল ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ক্রমক্ষীয়মান গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছিলেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হঠাৎ ঘটেনি। তার অবনতি অনেকদিন ধরে চলেছিল। এই পতনের অনেক কারণ ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন কারণের উল্লেখ করেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গুপ্ত বংশীয় সম্রাটদের পরিবারে অভ্যন্তরীণ কলহ, সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও সম্রাটদের দুর্বলতা।
আরও দেখুন :