ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি : শাং যুগ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি : শাং যুগ

ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি : শাং যুগ

 

ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি : শাং যুগ

 

ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি : শাং যুগ

প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনে পীত নদীর পূর্ব অংশের মধ্যভাগে অকস্মাৎ ব্রোঞ্জযুগের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ অঞ্চলের ব্রোঞ্জ যুগের মানুষেরা সুরক্ষিত নগর তৈরি করতে পারত এবং ব্রোঞ্জযুগের সমস্ত মৌল অবদান, এমনকি লেখনপদ্ধতি পর্যন্ত আয়ত্ত করেছিল।
চীনে নবোপলীয় সংস্কৃতি যেমন হঠাৎ উদিত হয়েছিল, ব্রোঞ্জযুগের সংস্কৃতিও তেমনি হঠাৎ উদিত হয়েছিল বলে মনে হয়। চীনে ব্রোঞ্জ যুগের সংস্কৃতির ধাপে ধাপে বিকাশ লাভের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না।

এর অর্থ হল ব্রোঞ্জযুগের উদয় চীনে ঘটেছিল বাইরের সভ্যতার প্রভাবে। মিশর ও ব্যবিলনে ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতার বিকাশের আলোচনা কালে আমরা দেখেছি, কেমন করে অনুকূল সামাজিক পরিবেশে বিভিন্ন কারিগরি আবিষ্কার সে যুগে সংঘটিত হয়েছিল। ব্রোঞ্জের কারিগরি, কুমোরের চাক, গাড়ির চাকা, লেখনপদ্ধতি ইত্যাদি আবিষ্কারের জন্য যেসব সূক্ষ্ম শর্ত পূরণ হওয়া আবশ্যক তা মনে রাখলে বোঝা যাবে যে, বারবার ভিন্ন ভিন্ন স্থান নতুন করে তার আবিষ্কার ঘটা সম্ভব নয়।

বিশেষত মিশর বা মেসোপটেমিয়ায় চিত্রলিপিভিত্তিক যে লেখনপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল তা এমনই একটি জটিল, বিস্ময়কর ও অভিনব আবিষ্কার ছিল যে বারবার নুতন করে তার আবিষ্কার ঘটার সম্ভবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। বিশেষত চীনের প্রাচীন লিপিও ছিল মূলত চিত্রলিপিভিত্তিক ও ভাবব্যঞ্জক। তাই একথা নিঃসংশয়ে মেনে নেওয়া যেতে পারে যে, চীনে ব্রোঞ্জযুগের আবির্ভাব ঘটেছিল পূর্ববর্তী কোনো সভ্যতার (ব্যবিলনীয় বা অন্য কোনো সভ্যতার প্রভাবে।

চীনের ব্রোঞ্জযুগের সংস্কৃতির বিকাশ শাং যুগের ইতিহাসের সাথে জড়িত। শাং রাজবংশ চীনে ১৫০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল। শাং রাজ্য মোটামুটি হোয়াং হো অববাহিকার পূর্ব অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। শাং রাজা যদিও প্রভাবশালী ছিলেন এবং বিশাল সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন, তথাপি শাং যুগে সাম্রাজ্যের দূরবর্তী অঞ্চলে অভিজাত শাসকদের প্রতিপত্তিই বজায় ছিল। শাং রাজারা রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন।

শাং আমলে যুদ্ধবিগ্রহ প্রায় লেগেই থাকত। এ আমলেই চীনে প্রথম দুই চাকাওয়ালা ঘোড়ায় টানা যুদ্ধরথের প্রচলন হয়েছিল। এ নতুন সামরিক সরঞ্জামের সাহায্যেই শাং রাজারা তাঁদের আধিপত্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলন। শাহ্ যুগে ধর্ম ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। জমি ও পশুর উর্বরতাবৃদ্ধির পূজাই ছিল এ যুগে মূল ধর্মাচরণ। এ যুগে পরিবার ছিল মাতৃতান্ত্রিক, পরবর্তীকালে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রচলন হয়।

শাং যুগের সংস্কৃতির অনেকগুলি উপাদান পরবর্তীকালের চীনের সভ্যতার ভিত্তিস্বরূপ হয়েছিল। যথা, রেশম উৎপাদনের জন্য রেশম গুটির চাষ, লেখনপদ্ধতির বিকাশ সাধন, যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে চীনের লিপি গড়ে উঠেছিল; ব্রোঞ্জের নির্মিত অপরূপ পাত্র ও অন্যান্য শিল্প নিদর্শন ইত্যাদি। বস্তুত শাং রাজত্বকালেই চীনের মানুষ উন্নত জীবনযাপনের উপযুক্ত সব রকম উপকরণ ও সমাজ সংগঠন আয়ত্ত করেছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

শাং যুগের মানুষরা প্রধানত কৃষিকাজেই ব্যাপৃত ছিল। তাদের চাষের পদ্ধতি ছিল খুবই আদিম ধরনের। একজন একটা চোখা লাঠিকে মাটিতে ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে থাকত, আরেকজন কোমরে বাঁধা দড়ির একপ্রান্ত কাঠিতে বেঁধে তাকে টানত। এভাবেই তারা জমি চাষ করত, কারণ তাদের লাঙল ছিল না। তাদের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল গম ও যব। ধানের চাষও তারা করত। এ যুগে কুকুর, শূকর, ছাগল, ভেড়া, গরু, ঘোড়া, মুরগি, বানর ও সম্ভবত হাতিকে পোষ মানানো হয়েছিল।

কুকুর ও শূকরের মাংস ছিল লোকের প্রিয় খাদ্য। শাং যুগে কৃষির পাশাপাশি কারিগরি উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন ছিল। শাং যুগের কারিগররা ব্রোঞ্জ, পাথর, হাড়, ঝিনুকের খোল, শিং প্রভৃতি দিয়ে অতি সুন্দর সামগ্রী বানাতে পারত। সে যুগের কারিগরদের তৈরি সুন্দর সুন্দর ছুরি, কুঠার, থালা প্রভৃতির নমুনা প্রত্নতাত্ত্বিকরা উদ্ধার করেছেন। মণিখচিত হাড়ের সামগ্রী এবং সুন্দরভাবে খোদাই করা হাতির দাঁতের অনেক সামগ্রীও পাওয়া গেছে।

নানারকম চিত্রিত মাটির পাত্র এবং চীনামাটির বাসন ও পাত্র এ যুগে তৈরি হত। এ যুগে মানুষ মাটির দেওয়াল দেয়া দোচালা ঘর বানাতে শিখেছিল। উত্তর চীনের বাতাসে ভেসে যে লোয়েস মাটি আসত তাকে পানি দিয়ে মেখে পিটিয়ে নিলে তা দিয়ে খুব শক্ত দেওয়াল বানানো চলত। ডাল, পাতা, খড় দিয়ে ঘরের চাল দেওয়া হত। আগেকার নবোপলীয় যুগে এ অঞ্চলের মানুষ মাটির নিচে গর্ত করে বাস করত।

শাং যুগের প্রধান অস্ত্র ছিল তীরধনুক। শিকার ও যুদ্ধে তীরধনুক ব্যবহার করা হত। বাঁশের তীরে পালক লাগানো থাকত এবং সামনের দিকে হাড় বা ব্রোঞ্জের ফলা লাগান থাকত। মধ্যভাগে স্থাপিত শিংয়ের সাথে দুই পাশে দুই খণ্ড কাঠ জোড়া দিয়ে এদের ধনুক তৈরি হত। এ ধনুক মধ্যযুগের ইংরেজদের লম্বা ধনুকের দ্বিগুণ শক্তিশালী ছিল বলে কথিত আছে। দুই ঘোড়ায় টানা বথও যুদ্ধে ব্যবহৃত হত। এসব রথের চাকা অরযুক্ত ছিল।

যোদ্ধারা চামড়া বা কাঠের পাতযুক্ত চামড়ার তৈরি বর্ম ব্যবহার করত। শাং যুগের মানুষের বাদ্যযন্ত্র ছিল— প্রধানত ঢোল ও ফাঁপা হাড়ের তৈরি বাঁশি। পাথরের তৈরি আরেক রকম বাদ্যযন্ত্র ছিল। তা থেকে ঘন্টার মতো ধ্বনি নির্গত হত। শাং যুগের নির্মিত ভাস্কর্য ও শিল্প সামগ্রীর মধ্যে শিল্পীর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। আগেই বলা হয়েছে, শাং যুগের মানুষ লেখন পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। তাদের ব্যবহৃত লেখার তুলি এবং ভুসার কালি আবিষ্কৃত হয়েছে।

সাধারণত সিল্কের কাপড়ে এবং বাঁশ বা কাঠের পাতে লেখা হত। শাং যুগের লেখার অনেক নমুনা পাওয়া গেছে পশুর হাড়, শিং এবং কাছিমের খোলার গায়ে খোদাই করা লেখা থেকে। এগুলিকে বলা হয় ‘দৈববাণীর হাড়’। কারণ প্রাচীন পুরোহিতরা প্রেতলোকের উদ্দেশ্যে কোনো প্রশ্ন করে একটা হাড় বা খোলাকে আগুনে ফেলে দিতেন। গরমে এগুলো ফেটে গেলে যে দাগ পড়ত তা দেখে পুরোহিতরা প্রশ্নের জবাব বুঝতেন।

 

ব্রোঞ্জ সংস্কৃতি : শাং যুগ

 

কোনো কোনো হাড়ে সবশেষে পুরোহিতরা প্রশ্নগুলি লিখে রাখতেন। এই হল দৈববাণীর হাড়। এগুলি থেকে শাং যুগের লিপির পরিচয় পাওয়া গেছে। এ থেকে পণ্ডিতরা বুঝতে পেরেছেন যে, শাং যুগের লিপি। একেবারে আদিম ধরনের নয়। বিবর্তনের অনেক ধাপ পার হয়ে তবে শাং যুগের লিপির উদ্ভব হয়েছিল। শাং যুগের লিপি ও লেখনপদ্ধতির সাথে আধুনিক চীনের লেখনপদ্ধতির কিছু মিলও রয়েছে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment