ভাষাতত্ত্ব-নৃবিজ্ঞান

ভাষাতত্ত্বঃ
ভাষাতত্ত্ব বা ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যয়নের বিষয়বস্তু হল, আপনি নিশ্চয় জানেন বা ধারণা করতে পারবেন,ভাষা। বলা বাহুল্য, এখানে ভাষা বলতে শুধু মানব ভাষার কথাই বলা হচ্ছে।
কাব্যিক উপমা হিসাবে ‘পশুপাখির ভাষা” কথাটা আমরা ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু প্রাণীজগতে একমাত্র মানুষই ভাষার অধিকারী, কাজেই আলাদাভাবে “মানব ভাষা” বলার দরকার পড়ে না।
ভাষা মানব সমাজে তথ্য ও ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। পশুপাখিরাও বিভিন্ন ডাক ব্যবহার করে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের যোগাযোগ ব্যবস্থার (communication sustem)
সাথে মানব ভাষার কিছু মৌলিক ও গুরুত্পূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।

আপনি হয়তবা লক্ষ্য করেছেন, পশুপাখিরা পরিস্থিতি ভেদে বিভিন্ন ডাক ব্যবহার করে, মানুষের ভাষায় যেগুলোর অর্থ হতে পারে অনেকটা এধরনের: “কাছে এসো না, এটা আমার!’, “সাবধান, বিপদ!”, “আমি
এইখানে, তুমি/তোমরা কোথায়?” “বাচাও!” ইত্যাদি।
পশুপাখিদের বেলায় এধরনের ডাকের সংখ্যা সীমিত এবং জৈবিকভাবে পূর্বনির্ধারিত, অর্থাৎ একই প্রজাতির কোন পশু বা পাখি সর্বত্রই সীমিত সংখ্যক কিছ অভিন্ন ডাক ব্যবহার করে। একটু চিন্তা করলেই দেখবেন
, মানুষের বেলায় এক্ষেত্রে রয়েছে একটা বিরাট পার্থক্য। কোন একটা নির্দিষ্ট বস্তুকে আমরা কি নামে ডাকব, কোন্ পরিস্থিতিতে কি ধরনের শব্দ বা বাক্য উচ্চারন করব, তা জৈবিকভাবে পূর্বনির্ধারিত থাকে না।

প্রতিটা মানুষই ভাষা শেখে জন্মের পর। একজন শিশু পানিকে ‘পানি’ বলতে শিখবে, না “জল” বা “ওয়াটার, তা নির্ভর করে সে কোন্ সামাজিক পরিবেশে জন্মেছে, তার উপর।
এই ধরনের বৈশিষ্ট্যের কারণে ভাষা মানুষকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দেয়। প্রতিটা ভাষাতেই সীমিত সংখ্যক কিছু মৌলিক ধুনি ব্যবহৃত হয় (যেগুলোর সংখ্যা সাধারণত ২৫-৩০টা বা বড়জোর ৫০টা হয়)।

কিন্তু প্রতিটা ভাষাতেই এই সীমিত সংখ্যক ধুনিকে বিভিন্ন ভাবে মিলিয়ে হাজার হাজার শব্দ ব্যবহার করা হয় বা প্রয়োজনে নূতন নৃতন শব্দ তৈরী করা যায়, এবং সেই শব্দ গুলোকে নানানভাবে মিলিয়ে প্রায় অসীম সংখ্যক বাক্য তৈরী করা যায়।
ফলে ভাষার মাধ্যমে দূরের-কাছের, অতীতের-ভবিষ্যতের, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য-ইন্দরিয়াতীত, সম্ভব-অসম্ভব অসংখ্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করার, তথ্য বিনিময়ের যে ক্ষমতা মানুষ অর্জন করেছে, এ ধরনের ক্ষমতা
প্রাণীজণতে অন্য কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
মানুষের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে ভাষার স্বরূপ অধ্যয়ন ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম একটি লক্ষ্য। এই স্তরে ভাষাবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ভাষার পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামান না, বরং সকল ভাষার অভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো
কি কি, সেদিকেই তাদের দৃষ্টি থাকে।

অন্যদিকে ভাষাবিজ্ঞানীরা কোন নির্দিষ্ট ভাষার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষার সম্পর্ক ও পার্থক্যও অধ্যয়ন করেন। কোন ভাষার মৌলিক ধূনিগুলো কি কি, ধুনিগুলো ব্যবহারের পদ্ধতি কি, এসব বিষয় অধ্যয়নের জন্য তৈরী হয়েছে ধৃনিতত্ব।
অন্যদিকে ভাষার ব্যাকরণগত কাঠামো, ভাষার অর্থময় দিক, ইত্যাদি অধ্যয়নের জন্যও ভাষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন আলাদা ক্ষেত্র বা শাখা রয়েছে। ভাষার অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছাড়াও ভাষা ব্যবহারের সামাজিক প্রেক্ষাপট, ভাষার পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি, প্রভৃতি বিষয়ও অধ্যয়ন করা হয়।

ভাষাতত্ত্বের এধরনের বিভিন্ন দিক রয়েছে যেগুলোর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। আমরা বরং যেদিকে নজর দেব তা হল নৃবৈজ্ঞানিক পরিসরে ভাষাতত্ত্ব চর্চার উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট।
আরও দেখুনঃ
- ছাপাখানা ও সামাজিক বিস্ফোরণ
- বাঙলার অলিখিত সাহিত্য
- বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত
- বাঙলার স্মার্ত পণ্ডিতগণ
- লোকায়ত ধর্ম ও যুক্তসাধনা