আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মায়া সভ্যতা
মায়া সভ্যতা
মায়া সভ্যতা
মায়া সভ্যতা ছিল আমেরিকা মহাদেশের সমস্ত সভ্যতাসমূহের মধ্যে উচ্চতম সভ্যতা। খ্রিস্টের জন্মের অন্তত এক হাজার বছর আগে মায়া জাতির মানুষরা গুয়াতেমালা ও মেক্সিকো অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে। খ্রিস্টের জন্মের কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই মায়ারা তাদের রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে অপূর্ব সব নগর গড়ে তুলেছিল।
তবে পণ্ডিতদের মতে মায়া সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে বিকাশ লাভ করেছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। ৩১৭ থেকে ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালকে বলা হয় মায়া সভ্যতার আদি পর্ব। এরপর দক্ষিণাঞ্চলের মায়া সভ্যতায় অবক্ষয়ের লক্ষণ দেখা দেয় এবং মায়া সভ্যতার মূল কেন্দ্র উত্তরে ইউকাতান উপদ্বীপ অঞ্চলে চলে যায়। ৯৮৭ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালকে বলা হয় মায়া সভ্যতার শেষ পর্যায়। এ সময়ে স্থাপত্য এবং শিল্পকলা নবজীবন লাভ করেছিল।
মায়া সভ্যতা অনেকগুলি নগররাষ্ট্র নিয়ে গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেক নগররাষ্ট্র গড়ে উঠত একটা নগর ও তার চারপাশের জমি নিয়ে। রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন আইন, শাসন বিচার ও ধর্মীয় বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পুরোহিত ও সেনাপতিগণ ছিলেন এ শাসকের ঘনিষ্ঠ সহচর। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছিল। মায়াদের রাজ্যে ধাতু বিশেষ ছিল না, মায়ারা মায়া রাষ্ট্রে তাই প্রতিবেশী উপজাতিদের কাছ থেকে ধাতু সংগ্রহ করত। মায়াদের রাজ্যে কোকো গাছের বিচি মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হত।
সমাজে বণিক, কারিগর ও অবস্থাপন্ন কৃষকদের স্থান ছিল পুরোহিত, সেনাপতি প্রভৃতি অভিজাতদের নিচেই। মায়া সমাজে ক্রীতদাসের প্রচলন ছিল। মায়াদের সমাজে সবচেয়ে নিচের স্তরের মানুষ ছিল ভূমিদাস ও ক্রীতদাসগণ। মায়াদের রাজ্যে দাসদের কঠোর পরিশ্রম করতে হত, কারণ সেখানে ভারবাহী পশু বা ঢাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন ছিল না। মায়া রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই ছিল কৃষক, তারা নগরের বাইরের জমিতে চাষ করত।
মায়ারা বন কেটে জমি পরিষ্কার করত এবং জলসেচের সাহায্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করত। মায়ারা চাষের কাজ খুব ভাল জানত। তারা ভুট্টা, কোকো, বিভিন্ন ফল, শাক সবজি, মরিচ, তুলা প্রভৃতির চাষ করত। ভুটা ছিল তাদের প্রধান খাদ্যশস্য। মায়া কারিগররা চমৎকার কাপড় বুনতে পারত, গয়না ও অস্ত্র বানাতে পারত এবং হাড়, কাঠ ও পাথরে খোদাই করতে পারত। মায়া রাজ্যে ধাতুর অভাব থাকায় মায়ারা অসিডিয়ান নামে একপ্রকার কাচতুল্য পাথর দিয়ে পাত্র, হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করত।
মায়াদের জীবনে ধর্মের অত্যধিক আধিপত্য ছিল। মায়াসমাজে পুরোহিতরা ছিল। খুবই ক্ষমতাশালী। সমস্ত সার্বজনীন ভবন নির্মাণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল। পুরোহিতদের। শিক্ষা বলতে ছিল ধর্মশিক্ষা এবং লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল পুরোহিতদের কবলিত। মায়াদের ধর্মে নরবলির প্রথা ছিল। মায়াসমাজে লেখনপদ্ধতির প্রচলন ছিল। মায়াদের লিপি ছিল চিত্রলিপি অথবা ভাবব্যঞ্জক লিপি। মায়াদের লিপির পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি।
মায়াদের লেখার বিষয়বস্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল ধর্মবিষয়ক ও সন-তারিখ সংক্রান্ত। প্রতি কুড়ি বছর অন্তর মায়া পুরোহিতরা একটা পাথরের দেওয়াল নির্মাণ করে তাতে পূর্ববর্তী কুড়ি বছরের ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করে রাখত। মায়া পুরোহিতরা ধর্মীয় প্রয়োজনে পঞ্জিকার হিসাবও আবিষ্কার করেছিল এবং এ পঞ্জিকা তারা পাথরের চাকতিতে লিপিবদ্ধ করে রাখত। এ ছাড়া মায়ারা সার্বজনীন ভবনে, স্মৃতিস্তম্ভে, মন্দিরে, গয়নায়, পাত্রের গায়ে এবং পুস্তকে বিভিন্ন কথা লিখত।
মায়াদের বই বিশেষ এক ধরনের কাগজ দিয়ে তৈরি হত এবং এসব বইকে কাগজের পাখার মতো ভাঁজ করে রাখা চলত। মায়াসমাজে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেছিল। মায়াসমাজে এক রকম অঙ্কপাতন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল যা অনেকটা আমাদের ব্যবহৃত অঙ্কপাতন পদ্ধতির মতোই। আমাদের গণনা পদ্ধতি ১০-ভিত্তিক, আর মায়াদের গণনা পদ্ধতি ছিল ২০-ভিত্তিক। আমাদের মতো মায়ারাও শূন্যের (0) ব্যবহার জানত।
অবশ্য মায়াদের শূন্যচিহ্ন দেখতে আমাদের মতো ছিল না। আমরা যখন চার অঙ্কের কোনো সংখ্যা লিখি তখন ডান দিক থেকে বাঁ দিকে প্রথম স্থানের একক ১, দ্বিতীয় স্থানের একক ১০. তৃতীয় স্থানের একক ১০০ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মায়াদের প্রথম স্থানের একক ১, দ্বিতীয় স্থানের একক ২০। ফলে মায়াদের হিসাবে ৩৭ লিখলে তার অর্থ দাঁড়াবে ৩ ঙ ২০ + ৭ = ৬৭। তবে মায়াদের অঙ্কপাতন পদ্ধতি আমাদের মত নিখুঁত ছিল না।
কারণ তারা ২০-ভিত্তিক অঙ্কপাতন পুরোপুরি অনুসরণ করত না। যেমন, আমাদের পদ্ধতিতে শতকের স্থানের মান হচ্ছে ১০০ অর্থাৎ ১০৪১০, মায়াদের হওয়া উচিত ছিল ২০ ২০ =৪০০; কিন্তু মায়ারা যে কারণেই হোক তৃতীয় স্থানের স্থানিক মান ধরত ৩৬০। এটা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। মায়ারা তাদের লেখনপদ্ধতি ও গণিতবিদ্যাকে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চার সাথে যুক্ত করেছিল এবং এ সবকিছুর সহযোগে একটা নিখুঁত পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে সমর্থ হয়েছিল।
মায়ারা তাদের পঞ্জিকায় বছরের যে দৈর্ঘ্য নিরূপণ করেছিল তা প্রায় আমাদের মতোই নিখুঁত ছিল। মায়াদের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে মায়াদের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল সুউচ্চ পিরামিড, বিশাল সোপানশ্রেণী, অতি অপরূপ মন্দির প্রভৃতি। নগর চত্বরের চারপাশে এ সকল পিরামিড ও অন্যান্য ভবন নির্মাণ করা হত। মন্দিরের চত্বর প্রভৃতিতে সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য স্থান পেত।
মায়া ভাস্কররা শুধুমাত্র পাথরের হাতিয়ার ও যন্ত্রের সাহায্যে এত সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য সৃষ্টি করতে পারতেন ভাবলে অবাক হতে হয়। এ ছাড়া রঙিন পাথর এবং সোনা ও রূপার বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর সামগ্রীও মায়ারা তৈরি করতে পারত। বস্তুত মায়া শিল্পকলা প্রাচীন মিশরের শ্রেষ্ঠ শিল্পকলার সাথে তুলনীয়। শেষ পর্যায়ে মায়া সভ্যতা অনেকগুলি স্বাধীন নগরের সমষ্টি হিসাবে টিকে ছিল।
শেষ পর্যন্ত মায়া নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিবাদ ও গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। এর ফলে ত্রয়োদশ শতকের পর থেকে মায়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির পতন ঘটে। স্পেনীয় উপনিবেশকরা যখন ষোল শতকে এখানে আসে তখন তারা এ অঞ্চলে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা দেখতে পায় এবং মায়া রাজ্যকে সহজেই জয় করে নেয়।
আরও দেখুন :