সামন্ততন্ত্র ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : পাঠান আমলে বাঙলা ৫৫৮ মহাল-বিশিষ্ট ১৯ সরকারে বিভক্ত ছিল। অধিকাংশ মহালই জায়গীরদারদের অধীনস্থ ছিল। পাঠান শক্তির পতনের পর সম্রাট আকবরের আমলে মানসিংহ যখন বাঙলা জয় করে, তখন মানসিংহের সমসাময়িক মুঘল রাজস্বসচিব তোদরমল্লের ‘আসল-ই-জমা-তুমার’ থেকে আমরা জানতে পারি যে সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বাঙলা দেশ ৬৮৯ মহাল-বিশিষ্ট ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল।
[ সামন্ততন্ত্র ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর ]
এই ১৬৬৯ মহাল বা পরগনার সব মহাল অব সমান আকারের ছিল না। কোন কোনটা খুব বড়, যার বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৭০ লক্ষ টাকা। আবার কোন কোনটা খুবই ছোট, এত ছোট যে রাজদরবারে দেয় বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল মাত্র পঁচিশ টাকা। এই সকল ছোট-বড় মহালগুলি যাদের অধীনে ছিল, তারা নানা অভিধা বহন করত, যথা জমিদার, ইজারাদার ঘাটওয়াল, তালুকদার, পত্তনিদার, মহলদার, জোতদার, গাঁতিদার ইত্যাদি। বড় বড় মহালগুলি জমিদারদেরই অধীনস্থ ছিল।
এ সকল জমিদারীর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বড়, সেসব জমিদারদের প্রায় সামস্তরাজার মতো আধিপত্য ছিল। দিল্লীর বাদশাহ তাদের রাজা, মহারাজা, খান, সুলতান প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করতেন। তারাই ছিল সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক। দেশীয় রাজগণ অনেক পরিমাণে সর্বময় কর্তা ছিলেন। তাঁদের দেয় রাজস্ব দিলেই তাঁরা স্বীয় অধিকারমধ্যে যথেচ্ছ বাস করতে পারতেন। সুতরাং তাঁরা পাত্র, মিত্র, সভাসদে পরিবেষ্টিত হয়ে সুখেই বাস করতেন।
জঙ্গলমহলের রাজাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন নারায়ণগড়, নাড়াজোল ও কর্ণগড়ের রাজারা। এর মধ্যে নারায়ণগড়ের আয়তন ছিল ৮১,২৫৪ একর বা ২২৬,৯৬ বর্গমাইল, আর নাড়াজোলের ছিল ৮,৯৯৭ একর বা ১৪:০৫ বর্গ মাইল। সুতরাং নারায়ণগড়ই বড় রাজ্য ছিল। কিংবদন্তী অনুযায়ী এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গন্ধর্বপাল। তিনি বর্ধমানের গড় অমরাবতীর নিকটবর্তী দিগনগর গ্রাম থেকে এসে নারায়ণগড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
‘মাড়ি স্থলতান’ মানে ‘পথের মালিক। শাহজাদা থুররম (উত্তরকালের সম্রাট শাহজাহান) যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন, তখন সম্রাটসৈন্যদ্বারা পরাজিত হয়ে মেদিনীপুরের ভিতর দিয়ে পলায়ন করতে গিয়ে দেখেন যে ঘোর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পলায়ন করা অসম্ভব। তখন নারায়ণগড়ের রাজা শ্যামবল্লভ এক রাত্রির মধ্যে তাঁর গমনের জন্য পথ তৈরি করে দেন। এই উপকারের কথা স্মরণ করে পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান রক্তচন্দনে পাঁচ আঙুলের ছাপবিশিষ্ট এক সনদ দ্বারা তাঁকে ‘মাড়ি হুলতান’ বা ‘পথের মালিক’ উপাধি দেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্গীর হাঙ্গামার সময় ও ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দে মারাঠাদের বিরুদ্ধে নারায়ণগড়ের রাজারা ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন। বেইলী সাহেব নারায়ণগড়ের তৎকালীন ২৫ বৎসর বয়স্ক রাজার জনহিতকর কাজের জন্য খুব প্রশংসা করে গিয়েছেন।
রাজা যশোমন্ত সিংহের আমলে কর্ণগড়ের দেয় রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৪০, ১২৬ টাকা ১২ আনা ও তাঁর দৈন্য সংখ্য। ছিল ১৫,০০০। তৎকালীন জঙ্গলমহলের প্রায় সমস্ত রাজা তাঁর অধীনতা স্বীকার করত। রানী শিরোমণির আমলে প্রথম চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে এবং যদিও যশোমস্ত সিংহের মাতুল নাড়াজোলের রাজা ত্রিলোচন খানের দ্বারা চুয়াড়রা পরাহত হয়, তা হলেও দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকার রানী শিরোমণিকে ওই বিদ্রোহের নেতা ভেবে ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের ৬ এপ্রিল তাঁকে তাঁর অমাত্য চুনিলাল খান ও নীরু বকসীসহ বন্দী করে কলকাতায় নিয়ে আসে।
কর্ণগড় ইংরেজ সৈন্যদল কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মুক্ত হবার পর রানী শিরোমণি আর কর্ণগড়ে বাস করেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মেদিনীপুরের আবাদগড়ে বাস করে এই নির্ভীক রমণী ১৮১২ খ্রীস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে মারা যান। তারপর কর্ণগড় নাড়াজোল বংশের অধীনে চলে যায়।
১৮০০ খ্রীস্টাব্দে সম্পাদিত এক দানপত্র দ্বারা রানী শিরোমণি সমস্ত রাজ্য সীতারামের জ্যেষ্ঠপুত্র আনন্দলালকে দান করেন। আনন্দলাল নিঃসন্তান অবস্থায় ১৮১০ খ্রীস্টাব্বে মারা যান। তিনি তাঁর ছোট ভাই মোহনলালকে কর্ণগড় রাজ্য ও মধ্যম ভাই নন্দলালকে নাড়াজোল রাজ্য দিয়ে যান।
মেদিনীপুরের অন্তর্গত মুকসুদপুরের ভুইঞারাও অতি প্রসিদ্ধ সদগোপ জমিদার ছিলেন। এছাড়া, মেদিনীপুরে অন্য জাতির জমিদারীও অনেক ছিল। তন্মধ্যে চেতুয়া-বরদার রাজারা, তমলুকের রাজারা, ঝাড়গ্রামের রাজারা, জামবনির রাজারা, ঝাটিবনির রাজারা ও ঘাটশিলার রাজারা উল্লেখের দাবী রাখে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই বাঁকুড়ার মল্লরাজদের মিত্রতা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তমলুকের রাজা ছিলেন কৈবর্ত জাতিভুক্ত আনন্দনারায়ণ রায়। ময়ূধ্বজ, তাম্রধ্বজ, হংসধ্বজ ও গরুড়ধ্বজ নামে চারজন রাজার পর আনন্দ নারায়ণের ঊর্ধ্বতন ৫৬তম পূর্বপুরুষ বিদ্যাধর রায় এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের রাজারা বহু দেবদেউল মাণ করেন, এবং তন্মধ্যে বর্গভীমার মন্দির সুপ্রসিদ্ধ।
চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় ঝাড়খণ্ড বা ঝাড়গ্রাম ‘বন্যজাতি’ অধ্যুষিত ও ওড়িষ্যা-ময়ূরভঞ্জের বনপথের সংলগ্ন ছিল। খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঝাড়গ্রামে যে রাজবংশ রাজত্ব করতেন, তাঁদের আদিপুরুষ ষোড়শ শতাব্দীতে ফতেপুর সিকরি অঞ্চল থেকে পুরীর জগন্নাথক্ষেত্রে তীর্থ করতে আসেন এবং অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ঝাড়গ্রামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাঁকুড়ার মল্লরাজগণের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের রাজাদেরও বিশেষ মিতা ছিল। ( মল্লরাজগণ সম্বন্ধে পরে দেখুন ) ।
“একদা দামোদর অজয় বেষ্টিত ভূখণ্ডের এক বিস্তৃত অঞ্চলে সদগোপ রাজাদের আধিপত্য ছিল।”
সাম্প্রতিককালে বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থেও বলেছেন—
“গোপভূমের সদ্গোপ রাজবংশের ইতিহাস রাঢ়ের এক গৌরবময় যুগের ইতিহাস। আজও সেই অতীতের স্মৃতি-চিহ্ন ভালকি, অমরাগড়, কাঁকশা, রাজগড়, গৌরাঙ্গ পুর প্রভৃতি অঞ্চলে রয়েছে। বাঙলার সংস্কৃতির ইতিহাসে সদগোপদের দানের গুরুত্ব আজও নির্ণয় করা হয়নি।”
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গোপভূমে যে সদ্গোপ রাজা রাজত্ব করেছিলেন তাঁর নাম শত্রুতু। ১৭১৮ খ্রীস্টাব্দে শত্রুতু মারা গেলে তাঁর পুত্র মহেন্দ্র রাজা হন। মহেন্দ্র নিজ পিতৃরাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনচরিতে রাজা মহেন্দ্রের কথা বিস্তারিতভাবে লেখা আছে। যখন জগৎশেঠের বাড়িতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে সভা আহূত হয়, তখন রাজা মহেন্দ্র একজন প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। নবাবের বিপক্ষে বিরোধী হওয়ার জন্য তাঁর রাজ্য বর্ধমানের রাজা কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং তিনি শেষপর্যন্ত পরাজিত হন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙলায় আরও রাজা মাহারাজা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। যেমন চন্দ্রকোণার রাজারা, নাটোরের রাজবংশ, নদীয়ার রাজবংশ ইত্যাদি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নাটোরের জমিদার ছিলেন রাজা রামকান্ত রায়। ১৭৪৬ খ্রীস্টাব্দে রামকান্তের মৃত্যুর পর তাঁর ৩২ বৎসর বয়স্কা বিধবা রানী ভবানী (বঙ্গাব্দ ১১২১-১২০০) নাটোরের বিশাল জমিদারীর উত্তরাধিকারিণী হন। ওই বিশাল জমিদারী কৃতিত্বের সঙ্গে পরিচালনার স্বাক্ষর তিনি ইতিহাসের পাতায় রেখে গেছেন। তাঁর জমিদারীর বাৎসরিক আয় ছিল দেড় কোটি টাকা।
নবাব সরকারে সত্তর লক্ষ টাকা রাজস্ব দিয়ে বাকী টাকা তিনি হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ প্রতিপালন, দীনদুঃখীর দুর্দশামোচন ও জনহিতকর কার্যে ব্যয় করতেন। বারাণসীতে তিনি ভবানীশ্বর শিব স্থাপন করেছিলেন ও কাশীর বিখ্যাত দুর্গাবাড়ি, দুর্গাকুঞ্জ ও কুরুক্ষেত্রতলা জলাশয় প্রভৃতি তাঁর কীর্তি। বড়নগরে তিনি ১০০টি শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন।
যদিও সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে তিনি ইংরেজ পক্ষকেই সাহায্য করেছিলেন, তা সত্ত্বেও তার জমিদারীর কিয়দংশ ইংরেজরা কেড়ে নিয়েছিল। তাঁর বাহারবন্দ জমিদারী ওয়ারেন হেষ্টিংস বঙ্গ পূর্বক কেড়ে নিয়ে কান্তবাবুকে ( কাশিমবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকান্ত নন্দী) দিয়েছিলেন। পাঁচসালা বন্দোবস্তের সুযোগ নিয়ে গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ ও তার রংপুরের কয়েকটা পরগনা হস্তগত করেছিলেন।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন আঠারো শতকের নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের কেন্দ্র মণি। ১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দের মাঘ মাসে তিনি অগ্নিহোত্র ও বাজপেয় যজ্ঞ সম্পাদন করেন। এই যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য তাঁর ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। বাঙলা, তৈলঙ্গ, দ্রাবিড়, মহারাষ্ট্র, মিথিলা, উৎকল ও বারাণসীর বিখ্যাত পণ্ডিতরা এই যজ্ঞে আহত হয়েছিলেন। এছাড়া, তাঁর সভা অলঙ্কৃত করতেন বহু গুণিজন যথা গোপাল ভাঁড়, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্ক সিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচষ্পতি, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ। নাটোর থেকে এক দল মুৎশিল্পী এনে, তিনি কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মৃৎশিল্পের প্রবর্তন করেন। বাঙলাদেশে জগদ্ধাত্রী পূজার তিনি প্রবর্তক। তিনি রাজা রাজবল্লভ প্রস্তাবিত হিন্দু বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন।
বাঁকুড়ার মল্লরাজগণের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুর জঙ্গলমহলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজগণ তাদের গৌরবের তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে মল্লরাজগণ যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। গোপাল সিংহের রাজত্বকালে বগীদের আক্রমণে রাজ্যটি বিধ্বস্ত হয় ও তার পতন ঘটে। কিন্তু একসময় তারা এক বিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি ছিল। এই ভূখণ্ড উত্তরে সাঁওতাল পরগনা থেকে দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত এবং পূর্ব দিকে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন রাজা সীতারাম রায়, বঙ্কিম যাঁকে তাঁর উপন্যাসে অমর করে গিয়েছেন। যশোহরের ভূষণা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা উদয়নারায়ণ ছিলেন স্থানীয় ভূম্যধিকারী। মহম্মদ আলি নামে একজন ফকিরের কাছ থেকে তিনি আরবী, ফারসী ও সামরিক বিদ্যা শিক্ষা করেন। পরে তিনি পিতার জমিদারীর সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে নিজেই ‘রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন। মুরশিদকুলি খান তাঁকে দমন করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি ঐশ্বর্যমত্ত হলে, তাঁর রাজ্যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। সেই সুযোগে নবাবের সৈন্য তাঁর আবাসস্থল মহম্মদপুর আক্রমণ করে তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে। কথিত আছে তাঁকে শূলে দেওয়া হয়েছিল। (অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসের জন্য লেখকের ‘আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী’ প্রঃ)।
ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির সারকিট কমিটির তত্ত্বাবধানে জমিদারী মহল গুলিকে নিলামে চড়িয়ে দিয়ে, ইজারাদারদের সঙ্গে পাঁচসালা বন্দোবস্ত করেন। যারা ইজারা নেয়, তাদের অধিকাংশই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেনিয়ান। এদের মধ্যে ছিলেন হেষ্টিংস-এর নিজস্ব বেনিয়ান কান্তবাবু, কিন্তু ইজারাদারদের অধিকাংশই নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে না। কোম্পানির সমস্ত প্রত্যাশাই ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার পর ১৭৭৭ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানি জমিদারদের সঙ্গে বাৎসরিক রাজস্বের বন্দোবস্ত করে।
সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি বললেন, কৃষিই সামাজিক ধনবৃদ্ধির একমাত্র হুত্র এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারদের ভূমির মালিকানা স্বত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করলে, তাদের উদ্যোগে কৃষির পুনরভ্যুদয় ঘটবে এবং তাতে কোম্পানির আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে।
ফ্রান্সিসের লেখার প্রভাবেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক ১৭৮৪ খ্রীস্টাব্দে বিধিবদ্ধ পিটস্-এর ‘ভারত আইন’-এ রাজা, জমিদার, ও বুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ীই ১৭৮৯-৯০ খ্রীস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার জমিদারদের সঙ্গে দশমালা বন্দোবস্ত করেন। (দশসালা বন্দোবস্তের সময় আলাহাবাদের রাজা ও জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করবার জন্য দেওয়ানীর ভার পেয়ে নোয়াখালির জগমোহন বিশ্বাস আলাহাবাদে যান। তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে এককালীন দুই লক্ষ টাকা দিয়ে তীর্থযাত্রীদের ওপর থেকে পূর্ব-প্রচলিত তীর্ণকর চিরতরে রহিত করেন। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে এক বেগুলেশন দ্বারা এটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত হয়।
এর সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন বিহারের কালেকটর টমাস ল’। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদাররা ও স্বাধীন তালুকদাররা জমির মালিক ঘোষিত হয়। এর দ্বারা বিভিন্ন শ্রেণীর জমিদারদের (যথা কুচবিহার ও ত্রিপুরার রাজাদের মতো মুঘল যুগের করদ নৃপতি, রাজশাহী, বর্ধমান ও দিনাজপুরের রাজাদের মতো পুরাতন প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ, মুঘল সম্রাটগণের সময় থেকে বংশানুক্রমিকভাবে রাজস্ব-সংগ্রাহকের পদভোগী পরিবারসমূহ ও কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানী লাভের পর ভূমিরাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ) একই শ্রেণীভুক্ত করে তাদের সকলকেই জমির মানিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়।
১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দের এক মিনিট-এ কর্ন ওয়ালিস মত প্রকাশ করেন — ‘আমার সুদৃঢ় মত এই যে, ভূমিতে জমিদারগণের মালিকানা স্বত্ব দেওয়া জনহিতার্থে আবশ্যক। বাঙলার জমিদারদের জমার পরিমাণ ২৬৮ লঞ্চ সিক্কা টাকা নির্দিষ্ট হয়। কোম্পানির আর্থিক প্রয়োজন বিচার করেই জমার পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। যাতে নিয়মিতভাবে ভূমিরাজস্ব দেওয়া হয়, সেই উদ্দেশ্যে ‘সূর্যাস্ত আইন’ জারি করা হয়। এই আইন অনুযায়ী কিস্তি দেওয়ার শেষ দিন সন্ধ্যার পূর্বে কোন মহালের টাকা জমা না পড়লে, সেই মহালকে নিলামে চড়ানো হত; অনাদায়, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কোন অছিলাই চলত না। কর্নওয়ালিসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সুনিশ্চিত আদায় ও কৃষির বিস্তার। কিন্তু কর্নওয়ালিদের উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা কিছুই সিদ্ধ হয়নি। উপরত্ত জমিদাররা সম্পূর্ণ নির্জীব হয়ে দাঁড়ায় ও প্রজাপীড়ন ক্রমশ: ঊর্ধ্বগতি লাভ করে।
“Rajesahy, the most unwieldy and extensive zemindary of Bengal or perhaps in India”.
রানী ভবানী তাঁর এই বিশাল জমিদারী থেকে লব্ধ দেড় কোটি টাকা খাজনার অর্ধেক দিতেন নবাব দরবারে, আর বাকী অর্ধেক ব্যয় করতেন নানারকম জনহিতকর ও ধর্মীয় কাজে। অকাতরে অর্থ দান করে যেতেন দীনদুঃখীর দুঃখমোচনে, ব্রাহ্মণপণ্ডিত প্রতিপালনে ও গুণীজনকে বৃত্তিদানে। তাঁর দানথয়রাতি ও বৃত্তিদান বাঙলা দেশে প্রবচনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দুর্দিনের জন্য কখনও তিনি কিছু মজুত করেননি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পদক্ষেপে যখন প্রাদের কাছ থেকে খাজনা অনাদায়ী রইল, তখন তাঁর জমিদারীর একটার পর একটা মহাল ও পরগন। নিলামে উঠল। সুযোগসন্ধানীরা সেগুলো হস্তগত করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কুকার্যসমূহের যারা সহায়ক ছিল, তারাই এল এগিয়ে। রানী ভবানীর জমিদারীর অংশসমূহ কিনে নিয়ে তারা এক একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে বসল। কাস্তবাবু (যিনি হেষ্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন চৈত সিং-এর সম্পত্তি লুণ্ঠন করতে এবং সেজন্য তার অংশবিশেষ তিনি পেয়েছিলেন ) প্রতিষ্ঠা করলেন শিমবাজার রাজবংশ, গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ প্রতিষ্ঠা করলেন পাইকপাড়ার রাজবংশ, দুর্বৃত্ত দেবী সিংহ প্রতিষ্ঠা করলেন নসীপুরের রাজবংশ, এমনকি রানী ভবানীর নিজ দেওয়ান দয়ারাম প্রতিষ্ঠা করলেন দিঘাপাতিয়ার রাজবংশ।
শেষপর্যন্ত রাণী ভবানী এমন নিঃস্ব হয়ে গেলেন যে তাঁকে নির্ভর করতে হল কোম্পানি প্রদত্ত মাসিক এক হাজার টাকা বৃত্তির ওপর। তাঁর পার লৌকিক ক্রিয়াকর্মাদি করবার জন্য, তাঁর স্বজনদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল ইংরেজ কোম্পানির কাছে। আর তাঁর ললাটে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কালিমার টাকা। ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের ১০ অক্টোবর তারিখের (তার মৃত্যুর তিন বছর আগে) এক সরকারী আদেশে বলা হল-
“The former rank and situation of Maharanny Bowanny, her great age, and the distress to which both herself and the family have been reduced by the imprudence and misconduct of the Late Rajah of Rajesahy, are circumstances which give her claims to the consideration of Government. We therefore authorise to continue to her an allowance of Rs 1000 per month”.
অথচ তাঁর মৃত্যুর পর যখন তাঁর স্বজনবর্গ তাঁর শেষকৃত্যের খরচের সাহায্যের জন্য কোম্পানির দ্বারস্থ হল তখন কোম্পানির রেভেন্যু বোর্ডের কর্তারা বললেন –
“( Board ) have reasons to suppose that the Late Ranny left ample funds by which the expenses of her funeral obsequies may be discharged”.
আরও পড়ুন: