আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল
কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল
কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল
কার্থেজের বিরুদ্ধে জয়লাভ রোমের জন্য অন্যদিকে অভিযানের পথ খুলে দেয়। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অন্যান্য দেশগুলি এখন রোমের আগ্রাসী নীতির স্বরূপ প্রকাশ পাওয়ায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় ম্যাসিডনের রাজা পঞ্চম ফিলিপ কার্থেজের সাথে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি সিরিয়ার সাথে একত্রে মিলে মিশরকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন।
ফিলিপের এই পরিকল্পনায় বাধাদানের উদ্দেশ্যে রোম পূর্ব দিকে তার সামরিক অভিযান প্রেরণ করে। ফলে গ্রীস ও এশিয়া মাইনর তার সরাসরি দখলে আসে এবং মিশরের উপর তার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। গ্রীস জয়ের ফলে রোম হেলেনীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আসে এবং বিপুল প্রতিরোধ সত্ত্বেও হেলেনীয় সংস্কৃতি ও ভাবধারা বহুলাংশে রোমানদের প্রভাবিত করে।
যুদ্ধজয়ের সম্পদ হিসাবে রোম ১,২৮০টি হাতির দাঁত, ২৩৪টি স্বর্ণহার, ১৮৭ হাজার পাউন্ড রূপা, ২ লক্ষ ২৪ হাজার গ্রীক রৌপ্যমুদ্রা, ১ লক্ষ ৪০ হাজার ম্যাসিডনীয় স্বর্ণমুদ্রা এবং প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার লাভ করে। এ ছাড়া কার্থেজবিজয়ের ফলে স্পেনের রূপার খনিগুলির অধিকারী হওয়ায় রোম প্রচুর পরিমাণে রৌপ্যমুদ্রা তৈরির সুযোগের অধিকারী হয়। কিন্তু রোমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে পিউনিক যুদ্ধের যে প্রভাব পড়ে, সেটাই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।
যুদ্ধের পরে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্দীদের ধরে আনা হয় এবং ক্রীতদাসরূপে তাদের উৎপাদনের সর্বস্তরে নিয়োগ করা হয়। ফলে ক্রীতদাসের সংখ্যা রোমে এত বেড়ে যায় যে, খনিতে, খামারে, কারখানায় স্বাধীন নাগরিকদের উচ্ছেদ করে এদেরই কাজে লাগানো হয়। গ্রামের স্বাধীন কৃষকদের উচ্ছেদ করে ছোটখাট কৃষিজমিগুলিকে একত্রিত করে বড় বড় ল্যাটিফান্ডিয়া বা কৃষি-খামার স্থাপন করা হল এবং সেখানে ব্যাপক হারে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করা হলো।
খনি ও কারখানায় বেতনভোগী মজুরদের পরিবর্তে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করা হল। ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। এসব বেকার, অসহায়, ভবঘুরেরা রোমে এসে জড়ো হয় এবং সামাজিক জীবনে এক প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি করে। বিজিত রাজ্যগুলি থেকে সস্তা দরে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ফলে দেশে প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্যের দাম ভীষণভাবে কমে যায় এবং কৃষকরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দেশে ব্যবসায়ী, মহাজন, ঠিকাদার ইত্যাদি এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব হয় এবং দেশের সম্পদের একটি অংশ এদের কুক্ষিগত হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, যুদ্ধজয়ের সম্পদলাভের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন ইত্যাদি রোমে এসে জমা হলো তাতে এক শ্রেণীর লোক প্রচণ্ড ভোগবিলাসে নিমগ্ন হয়ে পড়লো। এসবের ফলে রোমে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের দারুণ পরিবর্তন ঘটল।
একটি স্বাধীন নাগরিকদের রাষ্ট্রের পরিবর্তে রোম পরিণত হল সাম্রাজ্যবাদী দাসনির্ভর রাষ্ট্রে। ক্রীতদাসদের পশুর মতো শ্রমে নিযুক্ত করে রোমে যেমন একদিকে স্বাাধীন নাগরিকদের জীবিকার পথ বন্ধ করে দেযা হল, অন্যদিকে তেমনি এক শ্রেণীর লোক সর্বপ্রকার দৈহিক শ্রম থেকে বিরত হয়ে প্রচণ্ড বিলাসিতা ও অর্থনৈতিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য এতদিনের সমস্ত মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারণাকে পাল্টে দিল, শৃঙ্খলাবোধ ও দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য॥
যা এতদিন পর্যন্ত রোমের জনগণের মধ্যে টিকে ছিল, তা এখন বিশৃঙ্খলা, ঈর্ষা, পরস্পরের প্রতি রেষারেষি ও শত্রুতায় পরিণত হল। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে এ বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপনীত হল এবং সিনেটর ক্যাটোর মতো দু-একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির সতর্কবাণী ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা ব্যাপক ভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। রোমের সাম্রাজ্যবাদী নীতির পরিণামস্বরূপ প্রাথমিকভাবে রোমে যে অশান্তি ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়, তা শেষ পর্যন্ত রোম প্রজাতন্ত্রের জন্য মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে।

গুপ্তহত্যা, শাসকশ্রেণীর নিজেদের মধ্যে রেষারেষি, যুদ্ধ, গৃহবিবাদ ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয় দাসবিদ্রোহ— যা ব্যাপকভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ক্রীতদাসপ্রথা শুধু রোমের স্বাধীন অর্থনীতিকেই ব্যাহত করেনি, ক্রীতদাসদের মানবেতর জীবনযাপন, তাদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার ইত্যাদির কারণে প্রায়শই ব্যাপক দাসবিদ্রোহ সংঘটিত হয়— যা রোম প্রজাতন্ত্রের তথাকথিত শান্তিকে প্রায়ই বিঘ্নিত করত।
খ্রিঃ পূঃ ১০৪ অব্দে প্রথম ব্যাপক দাসবিদ্রোহ শুরু হয় সিসিলিতে। রোমান সৈন্যের সাহায্যে এ বিদ্রোহ দমন করা হয়। ত্রিশ বছর পরে সিসিলিতে দ্বিতীয় বারের মতো ক্রীতদাসগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এবারও রোমান সৈন্য পাঠিয়ে এ বিদ্রোহ দমন করা হল। ক্রীতদাসপ্রথার কুফল রোমের কিছুসংখ্যক নাগরিককে এর ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছিল। এদের মধ্যে দুইজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাঁরা হলেন প্লিবিয়ান শ্রেণী থেকে উদ্ভূত গ্রাকাস্ ভ্রাতৃদ্বয় । বড় ভাই টাইবেরিয়াস গ্রাকাস খ্রিঃ পূঃ ১৩৩ অব্দে রোমের ট্রিবিউন নিযুক্ত হন। তিনি জমিসংক্রান্ত একটি সংশোধনী বিল সিনেটে উপস্থিত করেন। এতে প্রস্তাব করা হয় যে, কোনো ব্যক্তি ৩১০ একরের বেশি জমির মালিক হতে পারবে না। অবশিষ্ট জমি দেশের ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে।
টাইবেরিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপকভাবে ক্রীতদাসদের কৃষিকার্যে নিযুক্তির ফলে যে বিপুলসংখ্যক স্বাধীন কৃষক ভূমিহীন হয়ে পড়েছিল তাদের অন্তত কিছুটা পুনর্বাসিত করা। কিন্তু সিনেটের বহু সদস্য এ বিলের বিরোধিতা করে। তারা প্রত্যেকেই ছিল বিরাট বিরাট কৃষি-খামারের মালিক এবং ক্রীতদাসদের অধিকর্তা। স্বভাবতই তাদের স্বার্থবিরোধী এ বিলকে তারা প্রাণপণে বাধা দেয়; তাদের নেতা অক্টেভিয়াস এ বিলের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেন।
টাইবেরিয়াস অক্টেভিয়াসকে ট্রিবিউন পদ থেকে অপসারিত করেন এবং সিনেটে নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করে এ বিল পাস করেন। এ বিল কার্যকর করতে গিয়ে টাইবেরিয়াস প্রচণ্ডভাবে সর্বত্র বাধাপ্রাপ্ত হন। অক্টেভিয়াসকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরিয়ে দেয়ার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। পরবর্তী ট্রিবিউন নির্বাচনে টাইবেরিয়াস অংশগ্রহণ করলে তাঁর বিরোধী পক্ষ নির্বাচনের দিন হিংসাত্মক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে টাইবেরিয়াস ও তাঁর ৩০০ অনুচরকে হত্যা করে।
টাইবেরিয়াস-এর মৃত্যুর নয় বছর পরে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা গেইয়াস গ্রাকাস বড় ভাই-এর আরব্ধ সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন। ১২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গেইয়াস ট্রিবিউন নিযুক্ত হন। তিনি তাঁর ভাইয়ের চেয়ে বেশি স্পষ্ট বক্তা ছিলেন এবং সিনেটের বিভিন্ন কার্যকলাপের মারাত্মক সমালোচনা শুরু করেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে, টাইবার নদীর পার্শ্বে সরকারি শস্যাগার গড়ে তুলতে হবে এবং সেখান থেকে স্বল্প মূল্যে খাদ্যদ্রব্য দেশের দরিদ্র জনসাধারণের নিকট বিক্রি করতে হবে।
নির্যাতিত জনগণের মধ্যে ভীষণভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করার ফলে গেইয়াস পরের বছর পুনরায় ট্রিবিউন নির্বাচিত হন। এবার তিনি নাগরিক অধিকার, যা এতদিন পর্যন্ত শুধু রোমের জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা ইতালির অন্যান্য জনগণ, বিশেষ করে ল্যাটিনদের মধ্যে বিস্তৃত করার প্রস্তাব দেন। গেইয়াস-এর শত্রুরা এবার প্রচার করতে শুরু করল যে, রোমানদের সম্পদের অধিকার এবার অন্য জাতিরাও কেড়ে নেবে।
এ প্রচারণা গেইয়াস-এর বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে তুলল। গেইয়াসকে দেশের শত্রু ঘোষণা করা হল। গেইয়াস অবশ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত করেছিলেন কিন্তু পরাক্রমশালী রোমান সৈন্যবাহিনীর সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। রোমান সৈন্যের হাতে মৃত্যুবরণের পরিবর্তে তিনি তাঁর একজন অনুচরকেই নির্দেশ দেন তাঁকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু রোমান সৈন্যরা তাঁর তিন হাজার অনুচরকে হত্যা করে।
গ্রাকাস্ ভ্রাতৃদ্বয়ের হত্যা একটি কথাই পরিস্ফুট করে তোলে যে, রোমের তথাকথিত গণতন্ত্রের মৃত্যুঘন্টা বাজছে, রোমের দাস-মালিকগণ এতটুকু স্বার্থত্যাগ করতে রাজি নয়, এবং বৃহত্তর জনগণের কল্যাণ কামনা তাদের মোটেই কাম্য নয়— বরং দরকার হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই তারা জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দমন করবে।
আরও দেখুন :