নৃবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো আঞ্চলিক বা জাতিগত নৃবিজ্ঞান। এটি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত জাতি, উপজাতি ও আদিবাসী সমাজের জীবনধারা, বিশ্বাস, সামাজিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করে। মানুষ পৃথিবীর নানা ভূগোলে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বসবাস করেছে এবং সেই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। আঞ্চলিক নৃবিজ্ঞান তাই বিশ্বজনীন ঐতিহ্যকে বুঝতে এবং স্থানীয় সমাজকে মূল্যায়ন করতে সহায়ক।
বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ: সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো
বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী দেশের সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের প্রতীক।
- সাঁওতালরা মূলত সমতলভূমির কৃষিজীবী সমাজ।
- চাকমা ও মারমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে, তাদের সামাজিক সংগঠন ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
- গারো জনগোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য পরিচিত।
এসব সমাজের অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক প্রথা স্থানীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ভারতের উপজাতি সমাজ: ভিল, নাগা, মিজো
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উপজাতি অধ্যুষিত দেশ।
- ভিল উপজাতি মধ্য ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষি ও শিকার নির্ভর জীবনযাপন করে।
- নাগা উপজাতি উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি রাজ্যে যোদ্ধা সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র আচার-অনুষ্ঠানের জন্য খ্যাত।
- মিজো উপজাতির সমাজ কাঠামোতে আধুনিকতার সাথে ঐতিহ্যের সমন্বয় দেখা যায়।
ভারতের উপজাতিগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা, শিল্প ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের পরিচয় ধরে রেখেছে।
আফ্রিকার উপজাতি ও টোটেমিক বিশ্বাস
আফ্রিকা মহাদেশে অসংখ্য উপজাতি বাস করে, যাদের জীবনধারা টোটেমিক বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।
- এখানে প্রতিটি গোষ্ঠী কোনো না কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ বা প্রাকৃতিক প্রতীকের সাথে আত্মীয়তা স্থাপন করে।
- টোটেমিক বিশ্বাস শুধু ধর্ম নয়, বরং সামাজিক সংগঠনেরও ভিত্তি।
- শিকার, কৃষি ও পারিবারিক রীতিনীতিতেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল সংস্কৃতি
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনালরা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
- তাদের “ড্রিমটাইম” বিশ্বাস মহাবিশ্বের উৎপত্তি, পূর্বপুরুষের কাহিনি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ব্যাখ্যা করে।
- শিকার ও সংগ্রাহক অর্থনীতির সাথে সাথে প্রতীকী শিল্পকলা, গুহাচিত্র ও সঙ্গীত তাদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ।
- আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চাপে থেকেও তারা নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে।
আমেরিকার নেটিভ আমেরিকান ও ইনুইট সমাজ
আমেরিকার আদিবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন জীবনযাত্রা গড়ে তুলেছে।
- নেটিভ আমেরিকানরা শিকার, কৃষি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের জন্য পরিচিত। তাদের সামাজিক জীবনে প্রকৃতি কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে।
- ইনুইটরা, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বসবাস করে, তীব্র ঠান্ডায় খাপ খাইয়ে নিয়েছে বিশেষ জীবনধারা। তারা শিকার, মাছ ধরা ও বরফের ঘর (ইগলু) নির্মাণের মাধ্যমে টিকে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের মরু যাযাবর বেদুইন
বেদুইনরা হলো আরব মরুভূমির যাযাবর জাতিগোষ্ঠী।
- তারা উট ও ভেড়া পালনের উপর নির্ভরশীল।
- তাদের জীবনধারায় যাযাবর সংস্কৃতি, আতিথেয়তা ও কবিতার ঐতিহ্য বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
- আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রভাব সত্ত্বেও তারা মরুভূমির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
ল্যাটিন আমেরিকার ইন্ডিজেনাস সংস্কৃতি
ল্যাটিন আমেরিকায় বিভিন্ন ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠী আজও টিকে আছে।
- তাদের মধ্যে মায়া, কেচুয়া, আইমারা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
- কৃষি, বস্ত্রশিল্প, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং ঔপনিবেশিক প্রতিরোধের ইতিহাস তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
- তারা স্থানীয় পরিচয় ধরে রেখেই আধুনিক সমাজে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।
উপসংহার
আঞ্চলিক/জাতিগত নৃবিজ্ঞান আমাদের শেখায় মানুষ কিভাবে ভৌগোলিক পরিবেশ, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক কাঠামোর সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের পাহাড়ি গারো বা সাঁওতাল, ভারতের ভিল বা নাগা, আফ্রিকার টোটেমিক উপজাতি কিংবা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল—সবাই মিলে মানুষের অসীম বৈচিত্র্যের চিত্র তুলে ধরে।
এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতা—খাদ্যের সন্ধান, পরিবেশের সাথে অভিযোজন, বিশ্বাসের জন্ম, এবং সামাজিক ঐক্যের সন্ধান। তাই আঞ্চলিক/জাতিগত নৃবিজ্ঞান শুধু একটি গবেষণাক্ষেত্র নয়, বরং মানবজাতির বহুরূপী পরিচয় বোঝার এক অনন্য জানালা।
