আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ইনকা সভ্যতা। দক্ষিণ আমেরিকাস্থ পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায়, খ্রিষ্টীয় ১৫ শতকে যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তা ইনকা সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। ইনকা শব্দের অর্থ “সূর্য দেবতার সন্তান” (Son of the Sun)। কোস্কোর অধিপতি বা ইনকা সম্রাট কে সূর্য দেবতার সন্তান হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সেই থেকেই স্পেনীয়রা সাম্রাজ্যটির নাম দেয় “ইনকা সাম্রাজ্য”। আজ এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
ইনকা সভ্যতা
ইনকা সভ্যতা
আমরা গুয়াতেমালা ও মেক্সিকোর সভ্যতা তথা উত্তর আমেরিকার মায়া এবং আজটেক সভ্যতার কথা আলোচনা করেছি। ইন্কা নামক এক জাতি দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলে প্রায় অনুরূপ উচ্চমানের এক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, ইতিহাসে তা ইন্কা সভ্যতা নামে পরিচিত হয়েছে।
পেরু অঞ্চলে ইনকাদের আবির্ভাবের আগেও সেখানে সভ্যতা-সংস্কৃতির উদয় ঘটেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকে জানা গেছে যে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে প্রাগৈতিহাসিক কালে বিভিন্ন রেড ইণ্ডিয়ান উপজাতির মানুষ বাস করত। খ্রিস্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এ আদিম মানুষরা গৃহ ও পিরামিড নির্মাণ, উৎকৃষ্ট মাটির পাত্র নির্মাণ, জলসেচ প্রভৃতির কৌশল আয়ত্ত করেছিল।
ঐ সময়ের অল্পকাল পরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে ১৩ হাজার ফুট উপরে আন্দিজ পর্বতের উপত্যকায় অন্যান্য রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিরা আরেক সুউচ্চ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এ মানুষরা যেসব বিশাল পাথরের নগরী গড়ে তুলেছিল তার ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। কালক্রমে এ সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, কিন্তু এর বিলুপ্তির কারণ এখনও জানা জায়নি।
খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ইন্কা নামে পরিচিত একদল মানুষ আন্দিজ পর্বতের মধ্যভাগে এসে বাস স্থাপন করে। ইন্কা শব্দের অর্থ হচ্ছে “সূর্যের সন্তান”। ইনকারা ক্রমশ যুদ্ধ করে তাদের রাজ্যের পরিধি বাড়াতে শুরু করে। শেষ পর্যায়ে, ১৪৩৮ থেকে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে ইন্কা রাজ্য আন্দিজ পর্বতের উপর প্রায় ২৭০০ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইনকা রাজ্য স্পেনীয় আক্রমণে হয়ে গিয়েছিল।
স্পেনীয় আক্রমণের আগে ইন্কা রাজ্য বর্তমান পেরু, ইকোয়েডর, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও চিলির এক বড় অংশ জুড়ে অবস্থিত ছিল। ইনকাদের শাসক ছিল সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন “সাপা ইন্কা” অর্থাৎ “একমাত্র ইন্কা”। ইনকারা অন্যান্য উপজাতির মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের দাসে পরিণত করেছিল। অবশ্য সাধারণ ইনকা ও দাসের অবস্থাতে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। সাধারণ ইনকা ও দাস-ভূমিদাসদের উপর রাজত্ব করত প্রকৃতপক্ষে পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণী।

সাস এবং ইনকা কৃষক কারিগররা যে বিপুল সম্পদ উৎপন্ন করত, অভিজাত শ্রেণী তার অধিকাংশই আত্মসাৎ করত নিজেদের সুখভোগের জন্য। কৃষিই ছিল ইন্কা সংস্কৃতির ভিত্তি। পাহাড়ের গায়ে তারা ফসল ফলাত। পাহাড়ের গায়ে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু দেওয়াল তুলে তারা খাঁজ সৃষ্টি করত এবং সে খাঁজ মাটি দিয়ে ভরত। এ মাটির উপর তারা শস্যের চাষ করত। ইনকারা প্রধানত ভুট্টা, আলু, মরিচ, তরিতরকারি, নানাপ্রকার লতাগুল্ম প্রভৃতির চাষ করত।
ষোল শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ বা এশিয়াতে আলু অজানা ছিল: দক্ষিণ আমেরিকা থেকেই আলু পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছিল। ইন্কা রাজ্যে জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা ছিল। ইনকারা পশুপালনের কৌশল আয়ত্ত করেছিল। লামা, আলপাকা প্রভৃতি প্রাণীকে তারা পোষ মানিয়েছিল। এ দু’টি প্রাণীই উটজাতীয়। আলপাকা আকারে ভেড়ার সমান, লামা আরেকটু বড়। ইন্কারা লামাকে ভারবাহী পশু হিসেবে ব্যবহার করত।
তবে মায়া আজটেকদের মতো ইনকারাও চাকাওয়ালা গাড়ির ব্যবহার জানত না। আলপাকার লোম থেকে ইনকারা পশমী কাপড় বুনত। লামা এবং আলপাকার দলের বড় অংশই ছিল সাপা ইন্কার সম্পত্তি। ইনকারা কাপড় বুনতে পারত, মাটির সামগ্রী বানাতে পারত এবং সোনা, তামা প্রভৃতি ধাতুর সুন্দর সুন্দর সামগ্রীও বানাতে পারত। ইন্কারা সুবিশাল ও মজবুত পাথরের বাড়ি বানাতে পারত। ইনকারা রাস্তা, বাঁধ ও সেতু নির্মাণে দক্ষ ছিল।
রাজধানী কুজকো থেকে ইন্কা রাজ্যের সর্বত্র বড় বড় চওড়া রাস্তা গিয়েছিল। নদী, ঝরনা ইত্যাদির উপর দিয়ে ইনকারা সেতু নির্মাণ করত; তার অধিকাংশই ছিল ঝুলন্ত সেতু। ইনকারা জলপথে যাতায়াত ব্যবস্থারও উন্নতি সাধন করেছিল। তারা ভেলা, ডোঙ্গা নৌকা এবং পালতোলা নৌকার সাহায্যে জলপথে যাতায়াত করত। ইন্কারা সমুদ্র পথে মেক্সিকোর সাথে যোগাযোগ রাখত বলে অনুমান করা হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার এত উন্নতি সত্ত্বেও অবশ্য ইন্কাদের বাণিজ্য ব্যবস্থা বিশেষ উন্নত ছিল না। ব্যবসা বলতে পণ্য বিনিময় ব্যবস্থারই প্রচলন ছিল, তবে ইনকারা কড়িকেও মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করত বটে। ইনকাদের কোনো লেখনব্যবস্থা ছিল না, তবে তারা সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য এক প্রকার কৌশল আয়ত্ত করেছিল। তার নাম কিপু, বাংলায় বলা চলে গ্রন্থিলিপি। ইনকারা দড়িতে গিট বেঁধে বেঁধে সেটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাত।
দড়ির মধ্যে গিঁটের অবস্থান দেখে অন্যেরা লিপির অর্থ উদ্ধার করত। এরই নাম কিপু। ইকারা পঞ্জিকার ব্যবহার আয়ত্ত করেছিল। তারা ৩৬৫ দিনে বছর গণনা করত। তারা বছরকে বারটি মাসে এবং মাসকে চারটি সপ্তাহে বিভক্ত করত। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে স্বার্থলোভী স্পেনীয় সৈনিক পিজাবোর আক্রমণে ইনকাদের প্রাচীন সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছিল।
আরও দেখুন :