একান্নবর্তী পরিবার 

আজকের আলোচনার বিষয় একান্নবর্তী পরিবার  – যা পরিবারের ধরন এর অর্ন্তভুক্ত,  পাশ্চাত্যের একক পরিবার হতে খুবই ভিন্নভাবে গঠিত একান্নবর্তী পরিবার যা পৃথিবীর বহু অঞ্চলে বিস্তৃত। হিন্দু সমাজে, পরিবার মাত্রই একান্নবর্তী বা যৌথ। যৌথপনা রাষ্ট্রীয় আইন এবং প্রথা দ্বারা সমর্থিত। জন্মসূত্র মতে সকল পুরুষের পারিবারিক সম্পত্তিতে আছে সমান অধিকার।

পরিবারের সকল নারীর – জন্মসূত্রে কিংবা বিয়ের সূত্রে – আছে পরিবার দ্বারা ভরণপোষণের – – অধিকার। আইনত, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ (পিতা অথবা বড় ভাই) পারিবারিক সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক মাত্র, অন্যান্য পুরুষ অংশীদারদের সম্মতি ছাড়া তিনি পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি বা বিভাজিত করতে পারেন না।

একান্নবর্তী পরিবার

 

একান্নবর্তী পরিবার 

 

বিবাহিত পুত্র, স্ত্রী এবং সন্তানসহ বসবাস করে বাবা-মার সংসারে, এক অন্ন গ্রহণের মধ্য দিয়ে যৌথপনা প্রকাশিত হয়। কন্যাদের বিয়ের খরচ মেটানো হয় যৌথ সম্পত্তি হতে। যদিও যৌথ সম্পত্তির যে কোন অংশীদার চাইলে তার হিস্যা আলাদা করে নিতে পারেন, এবং তা আইনীভাবে স্বীকৃত, সচরাচর তা ঘটেনা। অন্তত বাবার জীবদ্দশায় তো নয়ই। বরং, ভারতের গ্রামাঞ্চলে বহুক্ষেত্রে এমন যৌথ পরিবার পাওয়া যায় যেখানে কয়েক পুরুষ ধরে সম্পত্তি একীভূত।

যদি বিভাজন ঘটে, হয়তো কোন প্রয়োজনে বা ঝগড়া-ফ্যাসাদের কারণে, বৃহত্তর যৌথ পরিবার ভেঙ্গে তার স্থলে গঠিত হয় আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যৌথ পরিবার। এই ছোট যৌথ পরিবারগুলো আবার ধীরে ধীরে বড় যৌথ পরিবারে পরিণত হয়। যৌথ পরিবারের এই বর্ণনা নৃবিজ্ঞানী লিওনহার্ট লিখেছিলেন ১৯৬৪ সালে। তিনি আরও লিখেছিলেন, পাশ্চাত্য সমাজে পরিবার অ-বৃদ্ধিযোগ্য কিন্তু ভারতে তা নয়।

আফ্রিকার বহুস্ত্রী গৃহস্থালীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের যৌথপনা লক্ষণীয়। সেখানে প্রতিটি স্ত্রীর নিজস্ব ঘর থাকে যেখানে তিনি তার সন্তানসহ বসবাস করেন। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরনের পরিবারে বাবার মাধ্যমে পরিবারের সকলে একীভূত হন, আর মার মাধ্যমে হন বিভাজিত। তবে, পারিবারিক এবং দৈনন্দিন বহু কাজ স্ত্রীরা একত্রে করেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আফ্রিকার যে সকল অঞ্চলে বহুস্ত্রী প্রথার প্রচলন রয়েছে সেসব এলাকায় দেখা গেছে যে, সকল পুরুষ বহু বিবাহ করেন না, এই প্রথা কেবলমাত্র বিত্তবান এবং ক্ষমতাশালী পুরুষদের জন্য রক্ষিত। নৃবৈজ্ঞানিক সাহিত্যে বহুস্ত্রী গ্রহণের ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া হয়েছে: বহুস্ত্রী গ্রহণের ফলে একজন বিত্তবান এবং ক্ষমতাশালী পুরুষের ক্ষমতা বিকশিত হয় যেহেতু বিয়ের মাধ্যমে তিনি অপরাপর গোষ্ঠীর সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন; বহুস্ত্রী থাকার ফলে তিনি বহু সন্তানের জনক হন যাদের শ্রম ক্ষমতার অধিকারী তিনি; সন্তানদের বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার আত্মীয় গোষ্ঠী বৃদ্ধি পায়, এর ফলে তার ক্ষমতার জাল সমাজে আরও বিস্তৃত হয়।

নৃবিজ্ঞানীরা আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন, আফ্রিকান সমাজে দেখা যায় যে, মা যতদিন সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, ততদিন (অনেক ক্ষেত্রে, প্রায় দুই বছর) স্ত্রীর সাথে সহবাসের নিষেধাজ্ঞা পালন করা হয়। বহু বিবাহ প্রথা সহবাসের নিষেধাজ্ঞার চাপ লাঘবে সাহায্য করে।

যৌথপনা মাতৃসূত্রীয় সম্পর্কের ভিত্তিতেও সংগঠিত হতে পারে। মেলানেশিয়ার দরু-দের ক্ষেত্রে তাই। বিবাহের আগ পর্যন্ত ভাই-বোন একই বাড়িতে বসবাস করেন কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবার পর, পুরুষটি তার বোনের বাড়িতে আর কখনও যান না। এ কারণেই মাতৃসূত্রীয় দল সুসু’র কোন বাসস্থানিক ভিত্তি নেই। একটি বিবাহিত নারী ও পুরুষের সন্তানেরা তাদের পিতার ক্ষেতের ধান খেতে পারে না; মাছ ধরার যন্ত্রপাতি এমনকি নৌকাগুলোও শুধুমাত্র সুসু’র সদস্যরা ব্যবহার করতে পারেন, এগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও প্রবাহিত। সুসু’র আছে অর্থনৈতিক ভিত্তি, যা বিয়ে সূত্রে গঠিত পরিবারের নেই।

নিজ সুসুর সদস্য বাদে দবাসীরা অপর দবাসীদের সন্দেহ করেন, শত্রুভাবাপন্ন মনে করেন। স্বামী ও স্ত্রী ভিন্ন ভিন্ন সুসুর হওয়ার কারণে বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয় শত্রুভাবাপন্ন। একে অপরকে সন্দেহ করে, ভাবে অন্যজন যে কোন মুহূর্তে যাদুটোনার সাহায্যে তার ক্ষতি করতে পারে, তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। কেউ মারা গেলে তার লাশ এবং মাথার খুলি তার সুসুর কাছেই হস্তান্তরিত হয়ে থাকে। ব্যক্তির নাম নির্ধারণ করে তার সুসু, তার সামাজিক মর্যাদাও সুসু অনুসারে নির্ধারিত হয়।

 

একান্নবর্তী পরিবার 

 

স্বামী কিংবা স্ত্রী কিংবা বাবা-মা মারা গেলে মৃত ব্যক্তির গ্রামে কেবলমাত্র সুসুর সদস্য ঢুকতে পারে। বর্ধিত বা একান্ন পরিবার ভিত্তিক সমাজগুলোতে, বিয়ে ব্যক্তির জীবনে আমূল রদবদল ঘটায় না, যা কিনা পাশ্চাত্য সমাজের বৈশিষ্ট্য। সেখানে বিয়ের পর নববিবাহিত দম্পতি সাধারণত নতুন গৃহে প্রবেশ করেন, একটি আলাদা সংসার গড়ে তোলেন। 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment