আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় এথেনীয় শক্তির অভ্যুদয়
এথেনীয় শক্তির অভ্যুদয়
এথেনীয় শক্তির অভ্যুদয়
পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রীসের জয়লাভ ছিল সমস্ত গ্রীকজগতের পক্ষেই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু গ্রীসীয়-পারসিক যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে লড়াই সমুদ্রবক্ষেই হয়েছিল। এ সকল নৌযুদ্ধে এথেন্স বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ, এথেন্সের নৌবহর ছিল সবচেয়ে বড়। ফলে গ্রীক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এথেন্স এক উঁচু স্থান অধিকার করে। গ্রীসীয়-পারসিক যুদ্ধ চলাকালেই এথেন্সের নেতৃত্বে একটি নৌশক্তির জোট গঠিত হয়।
এ জোটের নাম ছিল ‘ডেলিয়ান লীগ’। কারণ, ডেলোস দ্বীপে এ প্রতিষ্ঠানের সভা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। আড়াই শতাধিক গ্রীক নগররাষ্ট্র এ জোটে যোগ দিয়েছিল। সদস্য রাষ্ট্রগুলো এ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিত, বড় রাষ্ট্রগুলো জাহাজ দিয়েও সাহায্য করত। গ্রীসীয়-পারসিক যুদ্ধে গ্রীস যখন ক্রমশ জিততে থাকে, এ জোটের চরিত্রও ততই বদলাতে থাকে।
এ জোটের সামরিক নেতৃত্ব এথেন্সের হাতে থাকার ফলে জোটের সব বিষয়েই ক্রমশ এথেন্সের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। ডেলিয়ান লীগ নৌশক্তি জোটটি ক্রমে ক্রমে এথেনীয় নৌশক্তিতে পরিণত হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলো কার্যত পরিণত হয় এথেন্সের তাঁবেদার রাষ্ট্রে এবং এথেন্স তাদের কাছ থেকে কার্যত কর আদায় করতে থাকে। নৌশক্তি জোটের সাধারণ অর্থভাণ্ডার ডেলোস থেকে এথেন্সে স্থানান্তরিত হয় এবং সাধারণ তহবিলের অর্থে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে এথেন্স তার নিজস্ব নৌশক্তি বৃদ্ধি করে।
এরপর কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে ডেলিয়ান লীগ থেকে বেরিয়ে যাবার উপায় ছিল না। পারস্যের আক্রমণের আশঙ্কা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাবার পর অনেক নগরই এ জোট থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এথেনীয় শক্তি নির্দয়ভাবে এ সকল প্রচেষ্টা দমন করে। ডেলিয়ান লীগ এখন এথেনীয় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এথেন্সের রাজ কর্মচারী এখন সব নগররাষ্ট্রে উপস্থিত থাকে, অন্যান্য নগররাষ্ট্রের মামলা-মোকদ্দমা এখন থেকে নিষ্পত্তির জন্যে এথেন্সের আদালতে আনতে হয়।
ডেলিয়ান লীগের প্রতিষ্ঠা এবং পারসিকদের রিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে এথেন্সের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। সাথে সাথে দাসপ্রথারও প্রসার ঘটে। এ সময়ে পারসিক যুদ্ধের আগের তুলনায় গ্রীসে দাসের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। কারণ, যুদ্ধবন্দীদের অধিকাংশকে দাসে পরিণত করা হত।
যেমন, এশিয়া মাইনরের উপকূলে একবার আক্রমণ চালিয়ে এথেনীয় বাহিনী ২০ হাজার লোককে বন্দী করেছিল; তাদের সবাইকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ সময়ে দাসব্যবসাও খুব প্রসার লাভ করে। জলদস্যুরা বিভিন্ন স্থানে হামলা করে বিপুলসংখ্যক লোককে বন্দী করে দাস-বাজারে বিক্রি করে দিত। দাস কেনাবেচার বাজার সব বড় বড় নগরেই ছিল। এ ছাড়া, ক্রীতদাসদের সন্তানরাও তাদের মালিকদের পাসরূপে গণ্য হত।
তবে এ রকম বংশগত দাসের সংখ্যা খুব কম ছিল। কারণ, গ্রীসে দাসদের জীবনযাত্রা এত কঠিন ছিল যে, দাসশিশুরা অল্প বয়সেই মরে যেত। ক্রীতদাসের দাম নির্ভর করত তাদের দক্ষতার ওপর। ধাতুবিদ ইত্যাদি দক্ষ কারিগর এবং শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি শিক্ষিত দাসের দাম ছিল বেশি, আর কাজ না জানা অদক্ষ দাসের দাম ছিল কম। শিক্ষিত দাসের কথায় অবাক হবার কিছু নেই।
সে যুগে যুদ্ধে বা জলদস্যুর হাতে বন্দী হয়ে দাসে পরিণত হবার দুর্ভাগ্য যে কোনো সভ্য দেশের লোকের পক্ষে ঘটতে পারত। শিক্ষিত দাস এত সহজলভ্য ছিল যে, গ্রীসের লোকেরা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে বাজার থেকে শিক্ষিত দাস কিনে তাকে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করত। প্রাচীন গ্রীসে কারখানা, খনি ইত্যাদিতে ব্যাপকসংখ্যায় দাসশ্রম নিয়োগ করা হত। সাধারণত সবচেয়ে কঠোর দৈহিক পরিশ্রমের কাজই দাসদের দিয়ে করানো হত।

স্বাধীন গ্রীকরা যত গরিবই হোক, খনি বা খাতে কাজ করত না। লরিয়নের রূপার খনি এবং অন্যান্য খনি ও খাতে হাজার হাজার দাস নিয়োগ করা হত। খনির ভেতর, সরু সরু সুড়ঙ্গের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে বা শুয়ে শুয়ে দাসরা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে মূল্যবান ধাতুর আকর খুঁড়ে বের করত। খনির বাইরে আরেক দল দাস এসব আকর জাঁতায় ভেঙে গুঁড়ো করত।
গাধা বা ঘোড়ার সাহায্যে এসব জাঁতা ঘোরানো অবশ্য সম্ভব ছিল; কিন্তু দাসমালিকরা এসব পরিশ্রমসাধ্য কাজে দাস নিয়োগ করাই পছন্দ করতেন। কারণ, দাসের শ্রম ছিল তুলনামূলকভাবে সস্তা। কারখানাগুলোতেও সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজ দাসদের দিয়ে করানো হত। যেমন, কুমারের কারখানায় মাটি, পানি ইত্যাদি আনা, কাদামাটি তৈরি করা, কুমারের চাক ঘোরানো ইত্যাদি কাজ করত দাসরা, কিন্তু মাটির পাত্র তৈরি এবং তার গায়ে ছবি আঁকার কাজ করত স্বাধীন কারিগররা।
অনিচ্ছুক এবং অদক্ষ দাসদের কাছ থেকে সূক্ষ্ম বা উঁচুদরের কাজ আদায় করা খুব কঠিন ছিল। গ্রীসের খেতে-খামারে দাসশ্রম নিয়োগের রেওয়াজ কম ছিল। কৃষকরা নিজেরাই ছোট ছোট জমি চাষ করত। অবস্থাপন্ন কৃষকদের অবশ্য দাস ছিল। এ দাসরা ঝুড়িভর্তি ফসল বাজারে নিয়ে যেত, পেষণযন্ত্রে বা পা দিয়ে জলপাই ও আঙুর পিষত, এবং বিভিন্ন পরিশ্রমের কাজ করত।
আর সব দাসভিত্তিক সমাজের মতো এথেন্সেও দাসদের অদৃষ্ট খুব কষ্টের ছিল। দাসদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না, তারা ছিল তাদের মালিকদের সম্পত্তি। অস্থাবর সম্পত্তির মতোই মালিকরা দাসদের কেনাবেচা করতে পারত। ফলে স্বাধীন গ্রীকরা, এমনকি দরিদ্রতম কৃষকরাও দাসদের খুব ঘৃণার চোখে দেখত। দাস- মালিকরাও দাসদের পশুরূপে বিবেচনা করত। দাসরাও কেবল শাস্তির ভয়েই কাজ করত।
দাসরা কাজে ঢিলেমি দিলেই পাহারাদারদের চামড়ার চাবুক পড়ত তাদের পিঠে। প্রাচীন একটি গ্রীক গ্রন্থে দাসদের প্রতি যে শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে তা হল : চাবুক মারা, শ্বাসরুদ্ধ করা, পদদলিত করা, আগুনে পোড়ানো, চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া, মুচড়িয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়া, নাকে সিকা ঢেলে দেয়া, পেটে পাথর চাপা দেয়া ইত্যাদি।’ দাসরাও অবশ্য সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নিত। তারা যন্ত্রপাতি নষ্ট করে ফেলত, গরু-ভেড়াকে বিকলাঙ্গ করে দিত এবং যথাসম্ভব খারাপভাবে কাজ করত।
সুযোগ পেলেই তারা পালাবার চেষ্টা করত, যদিও তারা জানত যে, ধরা পড়লে তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হবে। অনেক সময় তারা নিষ্ঠুর দাস-মালিকদের হত্যা করত। মাঝে মাঝে একজোট হয়ে তারা বিদ্রোহ করত। তবে এ সব সত্ত্বেও দাসশ্রমই ছিল গ্রীক নগরসমূহের সুখ ও সমৃদ্ধির মূল ভিত্তি।
আরও দেখুন :