নৃবিজ্ঞান বিষয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা

আজ ঐতিহাসিক গবেষণা নিয়ে আলোচনা হবে। এই পাঠটি “নৃবিজ্ঞান পরিচিতি” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি” বিভাগের একটি পাঠ। সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। তাঁদের বেলায় গবেষণার অর্থ হতে পারে প্রথাগত মাঠকর্মের পরিবর্তে সরকারী মহাফেজখানাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাসঙ্গিক দলিলপত্রের সন্ধান করা এবং সেসব দলিলপত্র পর্যালোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করা।

ঐতিহাসিক গবেষণা

ঐতিহাসিক গবেষণা | সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি | নৃবিজ্ঞান পরিচিতি

 

সংশ্লিষ্ট সময়কালের সরকারী নথিপত্র থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত দিনপঞ্জী, চিঠিপত্র সব ধরনের দলিলই ঐতিহাসিক গবেষণায় তথ্যের ‘উৎস’ হিসাবে গণ্য হতে পারে। তবে এসব উৎস খুঁজে বের করতে পারা গবেষণার প্রাথমিক ধাপ মাত্র, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল উৎসসমূহ ভাল করে পরীক্ষা করে প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা, এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খন্ডচিত্রসমূহ মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যতটা সম্ভব একটা পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো।

অতীতে যখন প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে তথাকথিত আদিম সমাজসমূহ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উপর নৃবিজ্ঞানে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত, তখন অনেক নৃবিজ্ঞানীরই লক্ষ্য ছিল আদি-অকৃত্রিম অবস্থায় রয়ে গেছে, এমন জনগোষ্ঠীর সন্ধান করা। আর ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে সূচিত কোন পরিবর্তন যদি নৃবিজ্ঞানীদের চোখেও পড়ত, সেগুলোর প্রতি তাঁরা যথেষ্ট আগ্রহ বা মনোযোগ দেখান নি।

সাম্প্রতিককালের ইতিহাস-মনস্ক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা তাই অনেকেই পরীক্ষা করে দেখছেন, তাঁদের পূর্বসূরীদের বর্ণিত তথাকথিত আদিম সমাজসমূহ আসলেই কতটা আদি ও অকৃত্রিম অবস্থায় ছিল। এ ধরনের গবেষণা থেকে সাধারণভাবে এই উপলব্ধি ব্যাপকতা

পেয়েছে যে, প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সনাতনী বাস্তবতা হিসেবে যেসব বিবরণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অনেকক্ষেত্রে আসলে ঔপনিবেশিক সময়কালের বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। এ ধরনের উপলব্ধি অনেক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীকে ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে।

 

ঐতিহাসিক গবেষণা | সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি | নৃবিজ্ঞান পরিচিতি

 

গবেষণার রাজনৈতিক ও নৈতিক দিক:

‘গিনি পিগ’ কথাটার সাথে আপনি নিশ্চয় পরিচিত। গবেষণাগারে গিনি পিগের মত প্রাণীদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয় মানুষের প্রয়োজনে। এ ধরনের গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার লোক একেবারে বিরল নয়, যদিও সংখ্যায় তারা কম।

কিন্তু যদি এমন কথা শোনা যেত যে সামাজিক গবেষণার নামে জীবন্ত মানুষদেরই ‘গিনিপিগ’ বানানো হয়েছে, তাহলে সেটা নিশ্চয় কারো কাছে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হত না। সামাজিক বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় মানব সমাজের উপর এ ধরনের কোন পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালান না ঠিকই, তবে অনেকসময় পরোক্ষভাবে তাঁরা এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকেন। যেমন, আপনি নিশ্চয় জানেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু স্থানে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।

এসব প্রকল্প অনেকক্ষেত্রেই হয়ে থাকে পরীক্ষামূলক, যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। এমনটা অনেক সময়ই দেখা যায় যে, সমাজের কোন প্রভাবশালী গোষ্ঠী চায় বিশেষ কোন প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক, কারণ তারা এতে নিজেরা লাভবান হবে, অন্যদিকে সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন অন্যদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ধরা যাক, এ ধরনের কোন বিতর্কিত প্রকল্প মূল্যায়নের কাজে একজন সামাজিক বিজ্ঞানীকে সম্পৃক্ত করা হল। তিনি কাদের পক্ষ অবলম্বন করবেন? নীতিগতভাবে সামাজিক বিজ্ঞানী অবশ্যই নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন তুলে ধরবেন।

কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানীরাও যেহেতু সমাজেরই অংশ, তাঁদেরও বিশেষ কোন মূল্যবোধ, মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে যা গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ধরনের বিষয় বিবেচনা করে অনেক সামাজিক বিজ্ঞানীই মনে করেন যে, বস্তুনিষ্ঠ বা মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ সামাজিক গবেষণা বলে আসলে কিছু নেই, থাকতে পারে না।

এ ব্যাপারে ভিন্নমতের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, যে বৃহত্তর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হয়, তা পরীক্ষা করে দেখা সামাজিক বিজ্ঞানীদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা যেহেতু ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তিক ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠীদের মাঝে গবেষণা করেছেন, উপরের প্রশ্নগুলো তাঁদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। অনেক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীই মনে করেন যে তাঁরা একধরনের সাংস্কৃতিক অনুবাদকের ভূমিকা পালন করেন।

ঐতিহাসিকভাবে এই ভূমিকাটা হয়েছে একমুখী, অর্থাৎ পশ্চিমা নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অপশ্চিমা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বোধগম্য করে তুলেছে নিজেদের সমাজে, কিন্তু এর উল্টো ভূমিকা তাঁরা সাধারণভাবে পালন করেননি। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অনেক নৃবিজ্ঞানীই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার জন্য ফরমায়েশী গবেষণার কাজ করেছেন।

এ ধরনের গবেষণায় নৃবিজ্ঞানীরা সাধারণতঃ মনে করেন যে তাঁরা গবেষণা এলাকার জনগোষ্ঠীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন, অনেক সময় তাঁরা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের মুখপাত্র হিসাবেও নিজেদের গণ্য করেন। তবে ইদানীং নৃবিজ্ঞানীদের মাঝে এই উপলব্ধি বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, কোন জনগোষ্ঠী, সেটা আয়তনে যত ক্ষুদ্র বা সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যত সরলই হোক না কেন, আসলে সম্পূর্ণ সমরূপ না। কাজেই নৃবিজ্ঞানীরা যেটাকে স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গী হিসাবে তুলে ধরছেন, সেটা যে অনেক সময় স্থানীয় মানুষদের শুধু একটা অংশেরই দৃষ্টিভঙ্গী হতে পারে

(স্থানীয় প্রেক্ষিতে ক্ষমতাবানদের, পুরুষদের, ইত্যাদি), এই সম্ভাবনাও তলিয়ে দেখার তাগিদ স্বীকৃতি পেয়েছে। স্পষ্টতই, নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় এধরনের অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া পদ্ধতিগতভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরী, যাতে করে গবেষকের একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকে গবেষণার সার্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে।

 

ঐতিহাসিক গবেষণা | সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি | নৃবিজ্ঞান পরিচিতি

 

গবেষণার সারাংশ:

প্রতিটা জ্ঞানকান্ডেই নির্দিষ্ট কিছু গবেষণা পদ্ধতি রয়েছে। এক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানেরও রয়েছে নিজস্ব কিছু গবেষণা পদ্ধতি, যেগুলোর মধ্যে এথনোগ্রাফিক মাঠকর্ম ও তুলনামূলক পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে ‘মাঠ’ বলতে বোঝায় এমন কোন স্থান বা এলাকা যেখানে গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেখানে বসবাসরত মানুষদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করার এবং তাদের সাথে মেশার, কথা বলার সুযোগ রয়েছে।

এভাবে পর্যবেক্ষণ ও কথোপকথন, সাক্ষাতকার প্রভৃতি কৌশল ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিকে মাঠকর্ম বা মাঠ গবেষণা বলা হয়। আন্তঃসাংস্কৃতিক তুলনা (cross-cultural comparison) সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একটি অন্যতম গবেষণা পদ্ধতি।

মানব জীবনের বিশেষ কোন দিক ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে কি রূপে বিরাজমান ও ক্রিয়াশীল থাকে, তা নৃবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত এথনোগ্রাফিক তথ্যের আলোকে। বৃহদায়তনের কোন সমাজে গবেষণা করতে গেলে সামাজিক বিজ্ঞানীরা প্রায়ই জরীপের সাহায্য নিয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। প্রথাগত মাঠকর্মের পরিবর্তে সরকারী মহাফেজখানাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাসঙ্গিক দলিলপত্রের সন্ধান করা এবং সেসব দলিলপত্র পর্যালোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করা। নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া পদ্ধতিগতভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরী, যাতে করে গবেষকের একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকে গবেষণার সার্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে।

 

আরও দেখুনঃ

 

Leave a Comment