আজকের আলোচনার বিষয় ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোতে নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা – যা ফলিত গবেষণায় নৃবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্তি এর অর্ন্তভুক্ত, আপনারা জানেন যে, নৃবিজ্ঞানীদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যে বিষয়টা এখানে মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে: সকল সময় এই সম্পর্কটা প্রত্যক্ষ নয়। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে। ম্যালিনোস্কি যখন পলিনেশীয় এলাকাতে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন তখন সেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত ছিল।
কিন্তু ম্যালিনোস্কি কখনোই সে প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় আনেননি কিংবা এই সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেননি। পরবর্তী কালের অনেক নৃবিজ্ঞানী এই বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে: কোন নৃবিজ্ঞানী যদি প্রত্যক্ষভাবে কোন ঔপনিবেশিক শাসকের অধীনে চাকরি নাও করেন, যে ব্যবস্থার মধ্যে তাঁর মাঠকর্ম সাধিত হয়, যে অসম সম্পর্কের মধ্যে নৃবিজ্ঞানীর গবেষণা ক্ষেত্রের মানুষজন এবং নৃবিজ্ঞানীর ‘নিজ’ সমাজের মানুষজন বসবাস করেন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নিপীড়ন – এ সবই নৃবিজ্ঞানীর কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এগুলোকে বাদ দিয়ে নৃবিজ্ঞানীর গবেষণাকে বোঝা যাবে না ।
ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোতে নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা
কিন্তু আলোচ্য প্রবন্ধে ম্যালিনোস্কি সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনে নৃবিজ্ঞানীদের সহযোগিতার কথা বলেন। কেবল তাই নয়, যে সকল নৃবিজ্ঞানীরা এই কাজে সহায়তা করবার প্রচেষ্টা নেননি, ম্যালিনোস্কি তাঁদের তিরস্কারও করেন। এক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ড এবং প্রশিক্ষণ থেকে আসা বিশেষজ্ঞদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। ম্যালিনোস্কির ভাষায়:
“…বিগত একটা প্রবন্ধে (আফ্রিকা, জানুয়ারী ১৯২৯) আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি যে আমাদের বর্তমান- কালের বিদ্যাজাগতিক নৃবিজ্ঞান এখন অবধি ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণকে সহায়তা দান করবার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। একই সঙ্গে আমি দেখিয়েছি যে নতুন একটা পদ্ধতি এবং নতুন একটা তত্ত্ব, ক্রিয়াবাদী ধারা, খুব দ্রুত আকৃতি পেয়ে যাচ্ছে, এবং এটা, যদি ঔপনিবেশিক-ক্ষেত্রের লোকজনের সহযোগিতা লাভ করে, নিঃসন্দেহে পলিসি বানানোতে একই ভূমিকা নিতে পারবে প্রকৌশলের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান এবং ভূতত্ত্ববিজ্ঞান যা করেছে।…
এই অংশটি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লে ফলিত নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় অনেকগুলো বিষয় পরিষ্কার হওয়া সম্ভব। এখানে ধরে নেয়া হয়েছে যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইউরোপীয় শাসকদের উপনিবেশ স্থাপন স্বাভাবিক। এবং এই উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় শাসকদের সহযোগিতা প্রদান করাই নৃবিজ্ঞানীদের মুখ্য কাজ, তাঁদের পেশাগত সমৃদ্ধির বিষয়টাও এখানে যুক্ত।

বিশ্ব জুড়ে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি নৃবিজ্ঞানীদের কারো কারো পক্ষপাত ভেবে দেখার মত। ইউরোপের সভ্যতা সংক্রান্ত ভাবনা এখানে প্রাসঙ্গিক। সারা দুনিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে তা হ’ল: সভ্যতা আনয়ন। তাদের দাবি ছিল সারা দুনিয়াতে তারা সভ্যতা বয়ে নিয়ে এসেছে। ম্যালিনোস্কির মত অনেক নৃবিজ্ঞানীই এই ভাবনাকে সমর্থন করে গেছেন। আমরা পরবর্তী পাঠে দেখতে পাব কিভাবে পরবর্তী কালের নৃবিজ্ঞানে একই বিষয় কিংবা একই ভাবনা কাজ করেছে। সেখানে মূল প্রতিপাদ্য সভ্যতা আনয়ন নয়, উন্নয়ন। উদ্ধৃত বক্তব্যের একটু পরেই ম্যালিনোস্কি নাইজেরিয়ার একজন গভর্নরের বরাত দিয়ে জানান যে তাঁর এই বক্তব্য প্রশাসনের সমর্থনও পাচ্ছে।
বোঝাই যায় যে, নাইজেরিয়ার এই সাবেক প্রশাসক আসলে ব্রিটিশ প্রশাসনের কেউ এবং ম্যালিনোস্কি নৃবিজ্ঞানীদের সম্ভাব্য ভূমিকা ও পেশা দাঁড় করাবার জন্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই আমরা ফলিত নৃবিজ্ঞানের গড়ে ওঠা অনুমান করতে পারব। উদ্ধৃত অংশে আরও একটি জায়গা মনোযোগ পাবার দাবিদার। ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীদের প্রসঙ্গ সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ম্যালিনোস্কির ভাবনায় নৃবিজ্ঞানকে একটি বিশুদ্ধ বিজ্ঞান হিসেবে প্রমাণ করবার তাগিদ রয়েছে।
আরও দেখুনঃ