গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব নিয়ে আজকের আলোচনা। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি গ্রীসে মানসচর্চার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব উপস্থিত হয়। সাধারণ মানুষের অভ্যুদয় এবং ব্যক্তিসত্তার বিকাশের ফলে বাস্তব মানবিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্নটা জরুরি হয়ে দেখা দেয়। মানবচর্চার এ নতুন ধারার প্রথম প্রবক্তাদের বলা হয় ‘সফিস্ট’। সফিস্ট কথাটার অর্থ জ্ঞানী। প্লেটোর কঠোর সমালোচনার দরুন সফিস্টদের সম্পর্কে সাধারণভাবে খারাপ ধারণা প্রচলিত আছে এবং একথাও ঠিক যে, অনেক সফিস্টই বাগাড়ম্বরপ্রিয় ছিলেন।

গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব

 

গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব

 

গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব

অনেক সফিস্ট আবার অতি উচ্চ চিন্তাশীল ছিলেন। যেমন প্রোটাগোরাস, গর্গিয়াস প্রভৃতি। সফিস্টরা সংশয়বাদী চিন্তাধারারও প্রচার করেন। ‘সফিস্ট’ নামটি গ্রীকদেরই দেয়া। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচের শতকের মাঝামাঝি সময়ে গ্রীসে এক নতুন শ্রেণীর জ্ঞানী ব্যক্তির উদয় ঘটে, যাঁরা একদিকে দার্শনিক এবং অপরদিকে শিল্পী ও কারিগর শ্রেণী থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করেন।

আসলে এঁরা ছিলেন উচ্চমানের শিক্ষক। এঁরা বলতেন যে, তাঁরা ছাত্রদের বিশেষ কোনো একটি বিদ্যা বা বৃত্তি শেখান না, বরং তাদেরকে সভ্য নাগরিক জীবন-যাপনের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করেন। গ্রীকরা এঁদেরকেই সফিস্ট (Sophist) নামে অভিহিত করে। সফিস্ট কথাটার শব্দগত অর্থ হল ‘জ্ঞানী ব্যক্তি’। সফিস্টরা প্রাচীন গ্রীসে প্রায় একশো বছর ধরে সাধারণ শিক্ষা বা উদারনৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার বজায় রেখেছিলেন।

সফিস্টরা ছিলো পেশাদার শিক্ষক শ্রেণী। তবে এরা সকলেই সফিস্ট— এই একটি নামে পরিচিত হলেও, এ পেশার অন্তর্ভুক্ত পণ্ডিতরা বাস্তবে এবং তত্ত্বগতভাবে নানা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। সফিস্টদের চারটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। যথা, সংস্কৃতি বিষয়ক সফিস্ট, বাগ্মিতা বা বক্তৃতাদান বিদ্যা (rhetoric) বিষয়ক সফিস্ট, রাজনীতি বিষয়ক সফিস্ট এবং তর্কবিতর্ক (‘eristic’ বা Disputation) বিষয়ক সফিস্ট।

সফিস্টবিদ্যার এ চারটি বিভাগের এক একটি এক এক সময়ে প্রাচীন গ্রীসে পর্যায়ক্রমে গুরুত্ব অর্জন করেছিল, তবে প্রতিটি ধারাই কমবেশি প্রচলিত ছিল। যেমন, সংস্কৃতি বিষয়ক সফিস্টবিদ্যা খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ অব্দে প্রবর্তিত হয়ে কালক্রমে বিতর্ক বিষয়ক সফিস্টবিদ্যায় পরিণতি লাভ করে। বক্তৃতা দান বিষয় সফিস্ট বিদ্যা মধ্য গ্রীসে খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে প্রবর্তিত হয় এবং কালক্রমে তা রাজনীতিবিষয়ক সফিস্ট বিদ্যার সাথে মিশে যায়।

আবার, সফিস্টদের মতো সক্রেটিস (খ্রিঃ পূঃ ৪৬৯-৩৯৯) এবং তাঁর শিষ্যরাও ছিলেন শিক্ষাব্রতী ও শিক্ষক। তাই তাঁদেরও কখনও কখনও সফিস্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে সফিস্টদের শিক্ষাদানের লক্ষ্য ছিল— তাঁদের ছাত্ররা যেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে, আদালতে, মামলা-মোকদ্দমায়, গণপরিষদে, জাতীয় সংসদে বা তর্কবিতর্কে সাফল্য লাভ করতে পারেন, সেভাবে তাঁদের গড়ে তোলা।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অপর পক্ষে, সক্রেটিস ও তাঁর শিষ্যদের অভিমত ছিল ব্যবহারিক জীবনে সাফল্য অর্জনই জ্ঞানলাভের মূল লক্ষ্য নয়, জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের অনুসন্ধান। এক্ষেত্রে সফিস্টদের সাথে সক্রেটিসের সম্প্রদায়ের পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে ঐতিহাসিকরা সক্রেটিস ও তাঁর শিষ্যদের সফিস্টরূপে গণ্য না করে দার্শনিকরূপে গণ্য করেন।

এর কারণ হচ্ছে সফিস্টরা নিজেরাই বলত যে, জ্ঞানলাভ সম্পর্কে তারা আশাবাদী নয়; অপরপক্ষে দার্শনিকরা সত্যজ্ঞান লাভে সমর্থ না হলেও সত্যের অনুসন্ধানে নিমগ্ন থাকতেন। কালক্রমে যখন সক্রেটিসের শিষ্য দার্শনিক প্লেটো (খ্রিঃপূঃ ৪২৭-৩৪৭) একাডেমি নামক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন এবং প্লেটোর শিষ্য দার্শনিক এ্যারিস্টটল (খৃঃপূঃ ৩৮৪-৩২২) লাইসিয়াম নামক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন তখন ক্রমশ গ্রীসে সফিস্টদের পরিবর্তে দার্শনিকরা শিক্ষাব্রতী ও শিক্ষাদাতারূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন।

 

গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব

 

প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন গ্রীসে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণতা সাধনের প্রয়োজনেই সফিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। প্রথম যুগে গ্রীসের নাগারিকদের শুধুমাত্র লিখতে ও পড়তে শেখানো হত এবং শরীরচর্চা ও সঙ্গীতবিদ্যায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হত। এ অসম্পূর্ণ বিদ্যাশিক্ষার পরিপূরক হিসেবে গ্রীক নাগরিকদের সাধারণ শিক্ষা বা উদারনৈতিক শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্য নিয়েই সফিস্ট শ্রেণীর শিক্ষকরা উদিত হয়েছিলেন।

কিন্তু, প্রথম যুগের সফিস্টরা তাঁদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি হিসেবে ব্যাকরণ, রচনাশৈলী, সাহিত্য এবং বাগ্মিতাকে (বক্তৃতাদানবিদ্যা) গ্রহণ করেছিলেন; আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় যুগের সফিস্টরা ছিলেন বক্তৃতাদানবিদ্যায় পারদর্শী। সফিস্টবিদ্যা (Sophistry) তাই সমকালীন গ্রীক সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আবার, আয়োনীয় যুগের দর্শনের বিরুদ্ধে যে সংশয়বাদী চিন্তাধারার উদয় গ্রীক, চিন্তাজগতে ঘটেছিল, ঐ পটভূমিতেই সফিস্টদের উৎপত্তি ঘটেছিল।

এথেনীয় যুগে সক্রেটিস-প্লেটো-এ্যারিস্টটলকে অবলম্বন করে নতুন আকারে গ্রীক দর্শনের পুনরুত্থান ঘটেছিল। এ কারণে সফিস্টবিদ্যাকে গ্রীক দর্শনের ইতিহাসে একটা স্বল্পকাল স্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন চিন্তাপদ্ধতিরূপে গণ্য করা চলে। শেষত বলা প্রয়োজন যে, সফিস্টদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় ক্রমশ বাগ্মিতা এবং তার্কিকতা প্রধান স্থান অধিকার করার ফলে মানুষের চিন্তা ও আচরণের ওপর এর একটা অসাধু প্রভাব পড়তে শুরু করে।

 

গ্রীসীয় সফিস্টদের তত্ত্ব

 

তখন অনেকেই এ অভিযোগ উত্থাপন করেন যে সফিস্টদের আলোচনা বা তর্কের লক্ষ্য সত্যকে জানা নয়, বরং যে কোনো যুক্তি প্রদর্শন করে জয়লাভ করাই তাদের উদ্দেশ্য। দার্শনিক প্লেটো বিশেষ জোর দিয়ে সফিস্টদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। ক্রমশ এমন ধারণারও সৃষ্টি হয় যে সফিস্টরা অনৈতিক ও সমাজবিরোধী তত্ত্ব প্রচারে লিপ্ত রয়েছেন।

আরও দেখুন :

Leave a Comment