জ্ঞাতিত্ব বা Kinship মানব সমাজের অন্যতম মৌলিক সংগঠন। মানুষ কেবল জৈবিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও আত্মীয়তা নির্ধারণ করে থাকে। নৃবিজ্ঞানে আত্মীয়তার এই জটিল জাল বোঝার জন্য যে গবেষণা কৌশলটি প্রথম দিকেই জনপ্রিয়তা পায় তা হলো জ্ঞাতিত্ব অনুসন্ধান পদ্ধতি (Genealogical Method)। এটি নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত, কারণ এর মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানকে এক ধরনের বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছিল।
উদ্ভব ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- এই পদ্ধতির সূচনা করেন ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ডব্লিউ.এইচ.আর. রিভার্স (W.H.R. Rivers)।
- প্রথম প্রয়োগ হয় ১৮৯৮–১৮৯৯ সালের টরেস স্ট্রেইটস অভিযান-এ, যেখানে রিভার্স আত্মীয়তার কাঠামো বোঝার প্রয়াস নেন।
- উদ্দেশ্য ছিল: নৃবিজ্ঞানকে পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের মতো সুনির্দিষ্ট তথ্যনির্ভর জ্ঞান হিসেবে গড়ে তোলা।
- রিভার্স পরবর্তীতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Notes and Queries in Anthropology (1912)-এর চতুর্থ সংস্করণে এই পদ্ধতির বিস্তৃত বর্ণনা দেন।
পদ্ধতির ধাপ ও কৌশল
জ্ঞাতিত্ব অনুসন্ধান পদ্ধতিতে গবেষক ধাপে ধাপে তথ্য সংগ্রহ করেন:
- তথ্যদাতার মাতার নাম লিখতে বলা।
- এরপর তাঁর জৈবিক পিতার নাম।
- পরবর্তী ধাপে ভাই-বোনদের নাম, বয়স, অবস্থান।
- আবার মাতা-পিতার ভাই-বোন (চাচা-মামা, খালা-ফুফু) এবং তাদের সন্তানদের তথ্য সংগ্রহ।
- শেষে খেয়াল করতে হয় তথ্যদাতা তাঁদেরকে কিভাবে সম্বোধন করেন— অর্থাৎ স্থানীয় আত্মীয়তা-পদাবলী।
এই পদ্ধতিতে তৈরি হয় একটি পূর্ণাঙ্গ বংশবৃত্তান্ত বা কুলুজি চার্ট, যা শুধু ব্যক্তির পরিবার নয়, বরং গোত্র ও বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর ধারণা দেয়।
উদ্দেশ্য ও বৈজ্ঞানিক দিক
- আত্মীয়তা সম্পর্ককে নথিভুক্ত ও তুলনাযোগ্য করা।
- সমাজে ভূমিকা, দায়িত্ব, উত্তরাধিকার, বিবাহরীতি ইত্যাদি বোঝার জন্য একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করা।
- তথ্য যাচাইয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব: একই তথ্য বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখা।
- বার্নার্ড ও গুড বলেন, এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল নৃবিজ্ঞানকে একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি হিসেবে দাঁড় করানো।
প্রয়োগের ক্ষেত্র
- আত্মীয়তা ও পরিবার কাঠামো বোঝা।
- উত্তরাধিকার ও সম্পত্তি বণ্টন সম্পর্কিত নিয়ম জানা।
- বিবাহপ্রথা (Endogamy, Exogamy) বোঝা।
- গোত্র ও উপজাতি সমাজে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার নির্ধারণ।
- পরবর্তীতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় গ্রামীণ সমাজতত্ত্ব, সামাজিক ইতিহাস এবং এমনকি চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানেও (যেমন, বংশানুগত রোগ গবেষণা)।
সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা
যদিও এটি একটি যুগান্তকারী পদ্ধতি, তবু এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:
- ইউরোকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি:
- বুকে সমালোচনা করেন যে পাশ্চাত্য ধারণা (পিতা-মাতা-সন্তান সম্পর্ক) সব সমাজে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়।
- যেমন, অনেক সমাজে মাতৃকুলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, আবার কোথাও পিতৃকুল প্রাধান্য পায়।
- সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য উপেক্ষা:
- সামোয়া দ্বীপে গবেষণার সময় মার্গারেট মীড দেখেন, স্থানীয়রা আত্মীয়তার সম্পর্ককে সামাজিক ঘনিষ্ঠতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু রিভার্সের পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কেবল রক্তসম্পর্ককেই কেন্দ্র করে তথ্য উঠে আসে।
- তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা:
- নৃবিজ্ঞানী লাডি হোলি বলেন, এই পদ্ধতি বাস্তবে জ্ঞাতিত্ব “কি” তা না বলে, বরং “কি হওয়া উচিত” সে ধারণা দেয়।
শক্তি ও গুরুত্ব
- আত্মীয়তার কাঠামো বোঝার প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা।
- মাঠগবেষকদের জন্য একটি পদ্ধতিগত নির্দেশিকা।
- তথ্য সংগৃহীত হওয়ার কারণে তুলনামূলক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি।
- পরবর্তী গবেষণা (Structuralism, Alliance Theory, ইত্যাদি) এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিকশিত হয়েছে।
তুলনামূলক সারণি
| বিষয় | শক্তি | সীমাবদ্ধতা |
| তথ্য সংগ্রহ | আত্মীয়তার পূর্ণাঙ্গ চার্ট তৈরি সম্ভব | কেবল রক্তসম্পর্কে সীমাবদ্ধ থাকে |
| তুলনা | বিভিন্ন সমাজের তথ্য তুলনা করা যায় | স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপেক্ষিত |
| বৈজ্ঞানিকতা | গবেষণাকে নথিভুক্ত ও সুনির্দিষ্ট করে | পাশ্চাত্য মানদণ্ড চাপিয়ে দেয় |
| প্রয়োগ | উত্তরাধিকার, বিবাহ, রাজনৈতিক কাঠামো বোঝা যায় | সামাজিক সম্পর্কের বহুমাত্রিক দিক অনুধাবন হয় না |
জ্ঞাতিত্ব অনুসন্ধান পদ্ধতি নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি নৃবিজ্ঞানকে তথ্যনির্ভর ও বৈজ্ঞানিক পথে পরিচালিত করেছিল। যদিও এর ইউরোকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সীমাবদ্ধতা আজ স্পষ্ট, তবুও এটি আত্মীয়তা ও সামাজিক সংগঠন বোঝার প্রথম পদ্ধতিগত উদ্যোগ। সমালোচনার মাধ্যমেই এই পদ্ধতি পরবর্তী গবেষণা ও নতুন কৌশলের পথ তৈরি করেছে। তাই বলা যায়, জ্ঞাতিত্ব অনুসন্ধান পদ্ধতি কেবল একটি গবেষণা-কৌশল নয়, বরং নৃবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক যাত্রার সূচনাবিন্দু।
