তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান

নৃবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান। এর মূল লক্ষ্য হলো—মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেবল একটি অঞ্চলে নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে তুলনা করে দেখা। এক সমাজকে অন্য সমাজের সাথে মিলিয়ে বোঝার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি কোন বৈশিষ্ট্যগুলো সর্বজনীন (universal) আর কোনগুলো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ। এই দৃষ্টিকোণ আমাদের শেখায় মানুষ ভিন্ন হলেও তার বেঁচে থাকার লড়াই, সামাজিক সম্পর্ক ও বিশ্বাস ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক মিল রয়েছে।

 

আফ্রিকা বনাম দক্ষিণ এশিয়া: উপজাতি সমাজের তুলনা

আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার উপজাতি সমাজ ভিন্ন ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে বিকশিত হলেও, উভয়ের জীবনযাত্রায় গোত্রীয় সংগঠন, টোটেমিক বিশ্বাস প্রথাগত নেতৃত্বব্যবস্থা বিদ্যমান। আফ্রিকায় উপজাতিদের টোটেমিক আচার বেশি শক্তিশালী হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার উপজাতিদের মধ্যে ধর্মীয় ও ভাষাগত বৈচিত্র্য বেশি। তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান এসব মিল-অমিলকে ব্যাখ্যা করে।

 

পশ্চিমা শিল্পসমাজ ও কৃষিভিত্তিক সমাজের পার্থক্য

শিল্পসমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রযুক্তি-নির্ভরতা, নগরায়ণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও দ্রুত অর্থনৈতিক পরিবর্তন। অপরদিকে কৃষিভিত্তিক সমাজে পরিবারকেন্দ্রিকতা, সম্প্রদায়িক সম্পর্ক ও ঐতিহ্য-নির্ভরতা প্রাধান্য পায়। তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান দেখায়, শিল্পসমাজ যেখানে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত, কৃষিভিত্তিক সমাজ সেখানে স্থিতিশীলতার দিকে ঝোঁকপ্রবণ।

 

ধর্মীয় আচার: ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় বিশ্বাসের তুলনা

বিশ্বের প্রধান ধর্মসমূহ যেমন ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মে রয়েছে আচার-অনুষ্ঠান, নৈতিক শিক্ষা সমাজসংগঠনের কাঠামো। উপজাতীয় বিশ্বাস সাধারণত প্রকৃতিনির্ভর ও টোটেমকেন্দ্রিক। তুলনামূলক দৃষ্টিতে দেখা যায়, যদিও প্রতিটি ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যবস্থা আলাদা আকারে গড়ে উঠেছে, তবুও সবার মধ্যেই মানুষের অস্তিত্ব, পরকাল ও নৈতিকতার প্রতি একধরনের সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

 

নগরায়ণ বনাম গ্রামীণ জীবন

নগরায়ণ নিয়ে এসেছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, কাজের বহুমুখিতা ও বহুসংস্কৃতির সংযোগ। অপরদিকে গ্রামীণ জীবনে রয়েছে কৃষি-নির্ভরতা, সামাজিক সংহতি ও প্রথার ধারাবাহিকতা। তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান এই দুই ধরনের জীবনের পার্থক্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিশ্লেষণ করে—যেমন নগর খাদ্যের জন্য গ্রামাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল, আবার গ্রামীণ অর্থনীতি নগরের বাজারের সাথে যুক্ত।

 

পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও আদিবাসী অর্থনীতির তুলনা

পুঁজিবাদের মূল ভিত্তি হলো মুনাফা, বাজার প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিগত সম্পদ।
সমাজতন্ত্রে জোর দেওয়া হয় সমষ্টিগত মালিকানা, সম্পদ বণ্টনের সমতা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে।
আদিবাসী অর্থনীতি আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন—এখানে বিনিময়, উপহার ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রাধান্য পায়। তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান এই তিনটি মডেলকে একসাথে বিশ্লেষণ করে বোঝে অর্থনীতি কেবল হিসাব-নিকাশ নয়, বরং সামাজিক সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডও।

 

উপসংহার

তুলনামূলক নৃবিজ্ঞান আমাদের শেখায় মানুষের সমাজ আলাদা হলেও তাদের মৌলিক প্রয়োজন, বিশ্বাস ও সম্পর্কের ধরন অনেকটাই মিল। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার উপজাতি সমাজ থেকে শুরু করে আধুনিক নগরায়ণ কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব—সবকিছু তুলনা করলে বোঝা যায়, মানবসমাজ বৈচিত্র্যময় হলেও তার ভিত্তি একই মানবিক চাহিদা ও সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতায় নিহিত।