আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ধর্মীয় আন্দোলন : কার্গো কাল্ট, ব্রাহ্ম ও ফরায়েজী আন্দোলন । মুসলিম ধর্মীয় আন্দোলন ছিল প্রধানত ঊনিশ শতকে বাংলার ধর্মীয় পুনর্জাগরণধর্মী আন্দোলন। তবে অংশত এ আন্দোলনগুলি উদার আধুনিকতাবাদী সংস্কারমূলক প্রকৃতিরও ছিল। এছাড়া অন্যান্য ধর্মগুলোর আন্দোলন নিয়ে আজকের আলোচনা।
ধর্মীয় আন্দোলন : কার্গো কাল্ট, ব্রাহ্ম ও ফরায়েজী আন্দোলন
পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন
ধর্মের কার্যাবলী আলোচনার সময় এ বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে যে, ধর্ম সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে একথাও উল্লিখিত হয়েছে যে, ধর্ম সমাজ পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় সকল প্রধান ধর্মেরই আবির্ভাব ঘটেছে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে বা প্রয়াসে। এছাড়া সরাসরি নূতন কোন ধর্মের প্রবর্তন না ঘটলেও বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সময়ে অনেক পরিবর্তনকামী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে ধর্মীয় ভাবাদর্শের আলোকে। স্বাভাবিক ভাবেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধর্মীয় আন্দোলনের স্বরূপ ও গতি-প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
তবে ধর্মীয় আন্দোলনের বিষয়টি নৃবিজ্ঞানে বিশেষভাবে নজরে এসেছে একটা সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে – ইউরোপীয় – ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সম্প্রসারণের মুখে নৃবিজ্ঞানীদের অধীত বিভিন্ন উপনেবিশত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, সেগুলির একটা অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধ্যান- ধারণার আলোকে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলন।
নৃবিজ্ঞানীরা এ ধরনের আন্দোলনকে ইংরেজীতে nativistic, revivalistic millenarian, messianic ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন, যেগুলোকে সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য এন্থনি ওয়ালেস revitalization movement প্রত্যয়টি চালু করেন, হয়েছে, যার বাংলা করা যেতে পারে ‘পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন’।
ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী বা শ্রেণী ও জাতিগত বৈষম্যমূলক নিপীড়নের মুখে পতিত কোন অধস্তন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সূচিত ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন বিভিন্ন রূপ নিতে পারে। কোন কোন আন্দোলনে নূতন কিছুকে গ্রহণ করার পরিবর্তে পুরাতন কিছুকে আঁকড়ে থাকার বা লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যকে নবউদ্যমে ফিরিয়ে আনার প্রবণতা দেখা যায়।
আবার অনেক ক্ষেত্রে নূতন ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রসার ঘটতে পারে। কোন কোন আন্দোলনে এক ধরনের নিষ্ক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাবল্য থাকতে পারে, যেখানে ক্ষমতাসীনদের সাথে সংঘাত ও সংঘর্ষ পরিহার করে চলা হয় এবং ইহজাগতিক মুক্তির পরিবর্তে পারলৌকিক পরিত্রাণের উপর জোর দেওয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের প্রত্যক্ষ আহ্বান থাকতে পারে, এবং শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, সশস্ত্র কর্মকান্ড পরিচালিত হতে পারে। পুনরীজ্জবনবাদী আন্দোলনসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত কোন নেতার অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে।
উনিশ শতকে উত্তর আমেরিকার অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিলক্ষিত একটা বিশেষ ধরনের ধর্মীয় আন্দোলন, যা ‘প্রেত নৃত্য’ (Ghost Dance) নামে অভিহিত, পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। উক্ত আন্দোলনে আদিবাসীদের মৃত পূর্বসূরীরা প্রেত-জগত থেকে ফিরে এসে শ্বেতাঙ্গদের নির্মূল করতে সহায়তা করবে, এই ধরনের ভবিষ্যৎবাণীতে বিশ্বাসীরা সেই প্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি হিসাবে ব্যাপকভাবে নৃত্য-নির্ভর আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে শুরু করে।
অনেক ক্ষেত্রেই এই ‘প্ৰেত নৃত্য’সমূহ সংশ্লিষ্ট আদিবাসীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছিল, এবং তাদের অনেকে শ্বেতাঙ্গদের বন্দুকের গুলি ঠেকাতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হত, এমন জাদুকরী জামা গায়ে পরিধান করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসীদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের মুখে এ ধরনের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় বা অর্ন্তমুখী রূপ লাভ করে।
বিশ্বের অন্যান্য উপনেবিশিত অঞ্চলেও আমেরিকার আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ আন্দোলন লক্ষ্য করা গেছে, যেগুলির মধ্যে মেলানেশীয়দের মাঝে পরিলক্ষিত ‘কার্গো কাল্ট’ নামে পরিচিত আন্দোলনের প্রতি নীচে আমরা নজর দেব। কিছুটা ভিন্ন চরিত্রের হলেও এই উপমহাদেশেও ব্রিটিশ শাসনের সময় বেশ কিছু ধর্মীয় সংস্কারবাদী বা পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যেগুলির মধ্যে আমরা ‘ব্রাহ্ম আন্দোলন’ ও ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ সম্পর্কে নীচে আলোচনা করব।

কার্গো কান্ট (Cargo Cult)
ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শিকার হওয়ার পর বর্তমান পাপুয়া নিউ গিনি ও মেলানেশিয়া অঞ্চলের অনেক দ্বীপের আদিবাসীদের মধ্যে একসময় এ ধরনের বিশ্বাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তাদের মৃত পূর্বপুরুষেরা জাহাজে (বা উড়োজাহাজে) ইউরোপীয় দ্রব্যসামগ্রী বোঝাই করে ফিরে আসবে, এবং এই ধরনের বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন স্থানে দলে দলে অনেকে বিভিন্ন জাদু-ি -নির্ভর আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকে।
এই প্রবণতার বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশকেই সাধারণভাবে ‘কার্গো কাল্ট’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে (‘কার্গো’ শব্দ দিয়ে জাহাজ বা উড়োজাহাজের মালামালকে বোঝায়, অন্যদিকে ‘কাল্ট’ শব্দের বাংলা প্রেক্ষাপট-ভেদে ‘পূজা’, ‘ধৰ্ম’ ইত্যাদি হতে পারে)।
নৃবিজ্ঞানী পিটার ওরলে (Worsley) কার্গো কাল্টসমূহের যে বিবরণ ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, তা থেকে জানা যায়, প্রায় চারশ’ বছর আগে থেকে ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার পর ধীরে ধীরে মেলানেশীয়দের মধ্যে ইউরোপীয় দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা তৈরী হয়। মিশনারীরা ধর্ম প্রচার শুরু করার পর মেলানেশীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ হলে তারা ব্যাপকভাবে ইউরোপীয় দ্রব্যসামগ্রীর অধিকারী হবে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে নি।
বরং, ইউরোপীয়দের বাগানে শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার ফলে উল্টো তারা ব্যাপক সংখ্যায় স্থানচ্যুতি (নিজ এলাকা থেকে দূরে গিয়ে কাজ করতে হওয়া) ও অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়। এই পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে মেলানেশীয়দের মধ্যে যেসব প্রশ্ন দেখা যেতে থাকে, সেগুলোর উত্তর দিতে এগিয়ে আসে কিছু ধর্মীয় নেতা, যারা ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকে যে মৃত পূর্বপুরুষরা জাহাজ-বোঝাই কাঙ্খিত দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে শীঘ্রই ফিরে আসবে, এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে।
অনেক জায়গাতে জাহাজ নোঙ্গর করার বা উড়োজাহাজ নামার জায়গা প্রস্তুত করা হত। বিশ্বাসীদের অনেকে পশ্চিমা পোশাক পরে পশ্চিমাদের কায়দায় কাগজে আঁকি-বুকি করত, যে ধরনের ক্রিয়ার জাদুকরী প্রভাবে তাদের কাছে কাঙ্খিত দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে যাবে বলে তারা মনে করত।
আসলে কার্গো কাল্টের মাধ্যমে মেলানেশীয়রা শ্বেতাঙ্গদের ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের রহস্য উদ্ঘাটনেরই চেষ্টা করছিল। তাদের চোখে শ্বেতাঙ্গরা যা কিছু করত, তা তাদের কাছে জাদুর মতই মনে হত। যেমন, তাদের চোখে বাগানের মালিক বা অন্যান্য ইউরোপীয় কর্মকর্তারা কোন কাজ করত না, বরং সারাক্ষণ শুধু কাগজে কিসব রহস্যময় চিহ্ন আঁকত। কাজ করত স্থানীয়রা, অথচ দ্রব্যসামগ্রীর প্রাচুর্য দেখা যেত শুধু ইউরোপীয়দের বেলায়। তার মানে ইউরোপীয়রা নিশ্চয় এমন কোন জাদু জানে, যা রপ্ত করা গেলে নিজেরাও প্রাচুর্যের অধিকারী হবে, এমন বিশ্বাস মেলানেশীয়দের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে।
এভাবেই তারা ইউরোপীয়দের কর্মকান্ডের অনুকরণে বিভিন্ন জাদু-ধর্মী আচার-অনুষ্ঠানে লিপ্ত হতে থাকে। বাস্তবে অবশ্য মৃত পূর্বপুরুষরা কোথাও জাহাজ-বোঝাই করে মালামাল নিয়ে আসেনি। তবে প্রতিশ্রুত মালামাল এসে না পৌঁছালে ধর্মীয় নেতাদের অনেকে এই ব্যাখ্যা দিত যে, শ্বেতাঙ্গ লোকেরা জাহাজগুলোকে ভিড়তে দেয় নি, তাদের প্রতারণার কারণে সেগুলো অন্যত্র নোঙ্গর করেছে, ইত্যাদি। মারভিন হ্যারিস বলেন, এই ব্যাখ্যা রূপক অর্থে সত্য ছিল বই কি। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক আচরণ বা পাগলামি মনে হলেও কার্গো কাল্টের পেছনে একটা বৃহত্তর ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে ছিল বইকি।
ব্রাহ্ম আন্দোলন
বাংলার ইতিহাসে উনিশ শতকের গোড়ায় সূচিত ব্রাহ্ম আন্দোলন একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই আন্দোলন এমন এক সময়ে সূচিত হয়েছিল যখন ব্রিটিশ শাসনের আওতায় বাংলায় ব্যাপক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, বাঙালী সমাজে কলিকাতা-কেন্দ্রিক একটি নূতন শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, যাদের মাধ্যমে বাংলার একটা ‘নবজাগরণ’ ঘটেছিল বলে বলা হয়। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সাথে একজনের নাম বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন রামমোহন রায়।
তবে এটি তাঁর একার আন্দোলন ছিল না, বরং সংখ্যায় খুব বেশী না হলেও এতে তাঁর সাথে যাঁরা শরীক ছিলেন, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁরা ছিলেন তৎকালীন সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রভাবশালী শ্রেণীর প্রতিনিধি। ব্রাহ্ম আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্যের আলোকে আধুনিক প্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য একেশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। তবে এই আন্দোলনের লক্ষ্য বা ফলাফল শুধু ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যেই সীমিত ছিল না, বরং বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে এর প্রভাব পড়েছিল।
ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান রামমোহন রায় বেশ অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। ফারসী ও আরবী ভাষায় তাঁর দখল ছিল এবং পরবর্তীতে তিনি ইংরেজীও রপ্ত করেন এবং সেসূত্রে তথা ব্যবসায়িক সূত্রে ইউরোপীয়দের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে সমকালীন পশ্চিমা ধ্যান ধারণা সম্পর্কেও ঘনিষ্ঠভাবে অবগত হন।
হিন্দু ধর্মের অনেক কিছু অযৌক্তিক, মিশনারীদের এ ধরনের প্রচারণার বিপরীতে রামমোহন রায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ইসলামী বা খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের অনুরূপ ধর্মীয় বিশ্বাস আদি বৈদিক ঐতিহ্যেও রয়েছে। এই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ।
ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারীরা পৌত্তলিকতা পরিহার করে নিরাকার ইশ্বর বা ব্রহ্মার উপাসনার পথ বেছে নেয়, এবং মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মত সাপ্তাহিক সমবেত প্রার্থনা-সভার আয়োজন করেছিল। একসময় মিশনারীদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে, রামমোহন রায় খ্রিস্টান হতে যাচ্ছিলেন। তিনি তা হন নি, তবে তাঁর প্রবর্তিত ব্রাহ্ম রীতি-নীতিতে খ্রিস্টীয় প্রভাব শনাক্ত করা কঠিন নয়।
রামমোহন রায় ও তাঁর সহযোগী-অনুসারীরা মূলতঃ কলিকাতায় গড়ে ওঠা শিক্ষিত ও বিত্তবান ভদ্রলোকদের শ্রেণীকেই প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁরা পশ্চিমা উদারনৈতিক চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এবং আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংস্কার করে যুগোপযোগী করে তুলতে আগ্রহী করেন।
একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় ধারা হিসাবে ব্রাহ্ম আন্দোলন পরবর্তীকালে তেমন প্রসার লাভ করে নি, তবে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরা বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। যেমন, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন রায় ছিলেন সোচ্চার। একইভাবে বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ চালু করা, ইত্যাদি সামাজিক আন্দোলনে ব্রাহ্মরা সক্রিয় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত ব্যক্তিত্ব তথা ঠাকুর পরিবার ও অনুরূপ অন্যান্য প্রভাবশালী ব্রাহ্ম পরিবার একত্রে বাঙালী ভদ্রলোক শ্রেণীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কাজেই এসব বিবেচনায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
ফরায়েজী আন্দোলন
উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজেও একাধিক ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলন দেখা গিয়েছিল। এগুলির একটি ছিল ফরায়েজী আন্দোলন, যা পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষক সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফরিদপুরের হাজী শরিয়তউল্লাহর (জন্ম: ১৭৮১ মৃত্যু: ১৮৪০) নেতৃত্বে এই আন্দোলন – গড়ে উঠেছিল, যিনি হজ্জ্ব করতে গিয়ে তখনকার আরবদেশে আলোড়ন তোলা ওয়াহাবী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ওয়াহাবী আন্দোলনের মতই ফরায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল অনৈসলামিক বলে বিবেচিত বিভিন্ন বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান দূর করে কোরান-ভিত্তিক বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা।
হাজী শরিতউল্লাহর পুত্র ও অনুসারী দুদু মিঞার নেতৃত্বে ওয়াহাবী আন্দোলন পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে তৎকালীন ফরিদপুর, বাখেরখঞ্জ, ত্রিপুরা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা ও নোয়াখালী জেলায়।
ফরায়েজী আন্দোলন অবশ্য শুধুমাত্র ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়নি, এর সাথে নিবিড়ভাবে মিশে ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি। জমিদার (যাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু) ও ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষক শ্রেণীর ক্ষোভ ও বিদ্বেষের প্রেক্ষিতে দুদু মিঞা ঘোষণা করেছিলেন। যে সকল মানুষ সমান, এবং নিরলস প্রচারকার্য চালিয়ে বহু অনুসারী তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজেই ফরায়েজী আন্দোলন ধর্মীয় ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হলেও এটিকে শ্রেণী-সংগ্রাম তথা উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রাম হিসাবেও গণ্য করা যায়।
উপরে যেসব উদাহরণ আমরা আলোচনা করেছি, সেগুলো থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্টভাবেই বেরিয়ে আসে যে, পুনরুজ্জীবনবাদী বা অনুরূপ অন্য কোন নামে অভিহিত কোন ধর্মীয় আন্দোলনই শুধুমাত্র, বা এমনকি প্রধানত, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তন আনার ব্যাপার নয়। বরং বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় এ ধরনের আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ধর্মীয় আন্দোলন অধ্যায়ের সারাংশ
ধর্মীয় আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ রয়েছে, যেগুলির একটা বিশেষ বর্গকে ‘পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের আন্দোলন লক্ষ্য করা যায় নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার বিভিন্ন শ্রেণী, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষতঃ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে। আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে পরিলক্ষিত ‘প্রেত নৃত্য’ বা মেলানেশীয়দের মধ্যে একসময় ছড়িয়ে পড়া ‘কার্গো কাল্ট’ হচ্ছে পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের উদাহরণ।
বাংলায়ও একাধিক ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যেগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা লক্ষ্যে কলিকাতার শিক্ষিত-বিত্তবান শ্রেণীর কিছু মানুষের পরিচালিত ব্রাহ্ম আন্দোলন, এবং জমিদার ও নীলকরদের শোষণে অতিষ্ঠ পূর্ববাংলার দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে পরিচালিত ফরায়েজী আন্দোলন। ধর্মীয় ভাবাদর্শে পরিচালিত হলেও এ ধরনের আন্দোলনের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ থাকে।
আজকের আলোচনার বিষয় ধর্মীয় আন্দোলন অধ্যায়ের সারাংশ – যা ধর্মীয়- আন্দোলন এর অর্ন্তভুক্ত, ধর্মীয় -আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ রয়েছে, যেগুলির একটা বিশেষ বর্গকে পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।
এ ধরনের আন্দোলন লক্ষ্য করা যায় নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার বিভিন্ন শ্রেণী, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষতঃ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে। আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে পরিলক্ষিত ‘প্রেত নৃত্য’ বা মেলানেশীয়দের মধ্যে একসময় ছড়িয়ে পড়া ‘কার্গো কাল্ট’ হচ্ছে পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের উদাহরণ।

বাংলায়ও একাধিক ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যেগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা লক্ষ্যে কলিকাতার শিক্ষিত-বিত্তবান শ্রেণীর কিছু মানুষের পরিচালিত ব্রাহ্ম আন্দোলন, এবং জমিদার ও নীলকরদের শোষণে অতিষ্ঠ পূর্ববাংলার দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে পরিচালিত ফরায়েজী আন্দোলন। ধর্মীয় ভাবাদর্শে পরিচালিত হলেও এ ধরনের আন্দোলনের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ থাকে।
আরও দেখুনঃ