আজকের আলোচনার বিষয় ইভানজেলিকেলবাদ এবং নারীর গৃহী-সত্তা নির্মাণ – যা বিয়ের ধারণা এবং সংজ্ঞা এর অর্ন্তভুক্ত, নারী এবং পুরুষের পৃথকীকরণ ইংল্যান্ডের নব্য বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণীর জীবনযাত্রার (culture) কেন্দ্রে ছিল। সূচনার মুহূর্ত হতেই শ্রেণী ছিল লিঙ্গায়িত। বুর্জোয়া শ্রেণীর “পুরুষ এবং “নারী”র পার্থক্য সুনির্দিষ্টভাবে রচিত হয়।
নারীত্বের অর্থ কি – তার সামাজিক ভূমিকা কি হওয়া উচিত, নারী-পুরুষের আদর্শ সম্পর্ক কি হওয়া উচিত, নারী কি করলে বা কি ভাবলে নারীত্বের অবমাননা ঘটে, কোন সামাজিক ভূমিকা পালন হচ্ছে তার নিয়তি – এসব প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ডে ১৭৮০-১৮৩০ সময়কালে, বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়। এই – তর্ক-বিতর্কে বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ, নারী এবং পুরুষ, গীর্জার পুরোহিত এবং সাধারণ খ্রিস্টান উপাসক, ডাক্তার-মোক্তার, লেখক – এঁদের অংশগ্রহণ ছিল। ঔচিত্যের ধারণা প্রকাশিত হয় বই আকারে, পুস্তিকা আকারে, পত্রিকার সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠিতে, ব্যক্তিগত রোজ-নামচায়, গল্প-উপন্যাসে, ছড়ায় ও কবিতায়।
কেস স্টাডি : ইভানজেলিকেলবাদ এবং নারীর গৃহী-সত্তা নির্মাণ
ঔচিত্যের ধারণা সভা-সমিতিতে, পাড়া-ভিত্তিক অনুষ্ঠানে, গীর্জার যাজকের বেদী হতে, বিভিন্নভাবে, নানান সময়ে উচ্চারিত হয়। ডেভিডফ এবং হলের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, নারীত্ব কি – সেটির – সংজ্ঞা ১৮৩০-১৮৪০এর মধ্যে ইংরেজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় । নতুন (বুর্জোয়া) নারীত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় গৃহ এবং পরিবারকে কেন্দ্র করে। নারীর গৃহী সত্তার উপর জোর দেয়া হয়; এই সংজ্ঞা অনুসারে, নারী হচ্ছে প্রধানত “স্ত্রী” এবং “মা”। ডেভিডফ এবং হল ( এবং আরও বহু ইতিহাসবিদদের) অভিমত হল, এই সংজ্ঞায়নে ইভানজেলিকেল ধর্মীয় আন্দোলন (ইভানজেলিকেলবাদ খ্রিস্টান ধর্মের একটি উপধারা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৭৮০ হতে ১৮৩০, পঞ্চাশ বছরের এ সময়কালে, ইংল্যান্ডের সমাজে মৌলিক এবং গভীর রূপান্তর ঘটছিল। ইংল্যান্ড রূপান্তরিত হচ্ছিল একটি দাপুটে অভিজাত শ্রেণী এবং বাণিজ্য-ভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজ, যেখানে ভূমি হচ্ছে ক্ষমতার ভিত্তি সেটি হতে একটি শিল্প-ভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজে, যেখানে বুর্জোয়া শ্রেণী হচ্ছে একচ্ছত্রভাবে অধিপতিশীল। এই রূপান্তরনে ইভানজেলিকেল ধর্মীয় আন্দোলন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। এই ধর্মীয় আন্দোলন মানুষজনের প্রাত্যহিক আচার-আচরণ এবং নীতি-নৈতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ইভানজেলিকেলদের দৃষ্টিতে, সংস্কার হতে হবে ভেতর থেকে।
১৭৯২ সালে ইংরেজ নারীবাদী মেরী ওলস্টোনক্রাফটের এ ভিন্ডিকেশান অফ দ্য রাইটস অফ উইমেন বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির প্রধান বক্তব্য ছিল, নারীর নিকৃষ্টতা (inferior) প্রতিবেশের কারণে; এটি প্রকৃতি প্রদত্ত নয়। নারী সুযোগ বঞ্চিত। বুর্জোয়া পুরুষ যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক পরিসরে এবং আইনের দৃষ্টিতে – – সেগুলো নারীকেও প্রদান করতে হবে।

ওলস্টোনক্রাফটের বক্তব্যের সমালোচনা করেন ইভানজেলিকেলরা; এই ধর্মীয় আন্দোলনে নারীরাও ছিলেন। তাঁদের প্রধান বক্তব্য ছিল; নারী এবং পুরুষ সমান নয়, তাদের মধ্যকার ভিন্নতা প্রকৃতি-প্রদত্ত। নারীর অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে কিন্তু নারী-শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাল স্ত্রী এবং ভাল মা হওয়া, চাকরি-বাকরী করা বা বহির্জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নয়।
ইভানজেলিকেলবাদ “গৃহের ধর্ম” হিসেবে পরিচিত ধর্ম প্রচারে গৃহ এবং পরিবারের গুরুত্ব অসীম। এই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, কেবলমাত্র গৃহ এবং পরিবারকে ঘিরেই সাচ্চা ধর্মীয় জীবন গড়ে উঠতে পারে। এই মতবাদ অনুসারে, গৃহে নারী এবং পুরুষের পরিসর ভিন্ন। নারী স্বভাবজাতভাবে কমনীয়, নাজুক, সরল, সহজ এবং সচ্চরিত্রের অধিকারী। এসকল কারণে, নারীর সতর্ক থাকা, আড়ালে থাকা এবং গৃহের আশ্রয়ে থাকা জরুরী। অপর পক্ষে, পুরুষ হচ্ছে স্বভাবজাতভাবেই বহির্জাগতিক; তার আছে শক্তি, মাহাত্ম্য এবং মান-মর্যাদা। ইভানজেলিকেলরা প্রত্যাশা করতেন যে, নারীর উপস্থিতি পুরুষের নীতি-নৈতিকতা বোধকে জাগ্রত রাখবে, সম্ভব হলে সেটির উন্নতিও ঘটাবে।
আরও প্রত্যাশা করতেন যে, নারীর এই বিশেষ গুণ এবং তার প্রভাব কেবলমাত্র তার স্বামীতে সীমাবদ্ধ না থেকে সমগ্র জাতিকে প্রভাবিত করবে। সমগ্র জাতি সংস্কারের মাধ্যমে নৈতিকভাবে উন্নত হয়ে উঠবে। কিছু ইভানজেলিকেল চিন্তকেরা এ মতও প্রকাশ করেন যে, অল্প শিক্ষিত হওয়ার কারণে, শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে স্বল্প জ্ঞান থাকার কারণে, পুরুষের তুলনায় নারী বেশি ধর্মকেন্দ্রিক। এবং, তাদের দৃষ্টিতে, ধর্মের প্রতি নারীর আগ্রহকে জিইয়ে রাখার জন্য তার গৃহকেন্দ্রিক জীবন জরুরী। ডেভিডফ এবং হলের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ইভানজেলিকেল ধর্মীয় আন্দোলনের অবসান ঘটার পর ইংল্যান্ডে একটি ধর্ম-নিরপেক্ষ সমাজ গড়ে উঠে ঠিকই, কিন্তু নারী-পুরুষের এই লিঙ্গীয় সত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার ফলে এ ধারণাসকল টিকে যায়।
উপরের কেস স্টাডি হতে স্পষ্ট যে, পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাব নারী সত্তার মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়, নারীত্বকে নির্মাণ করে “স্ত্রী” এবং “মা” হিসেবে। এই নির্মাণের ভিত্তি হচ্ছে বিয়ে এবং এ কারণেই বিয়ে নারীর জীবনে, তার ভরণপোষণের জন্য, তার পূর্ণতাবোধের জন্য, হয়ে ওঠে অপরিহার্য। নির্ভরশীল নারীর বিপক্ষে পুরুষ প্রতিষ্ঠিত হয় দায়িত্বশীল হিসেবে, স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষক এবং প্রতিপালনকারী হিসেবে। বুর্জোয়া । শ্রেণীর এই পুরুষকেন্দ্রিকতা অধিকতর শক্তি সঞ্চার করে অন্য একটি, কিন্তু যুক্ত, বদলের মধ্য দিয়ে। প্রাক্- পুঁজিবাদী সমাজে গৃহ এবং পরিবার ছিল উৎপাদনের স্থান।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে আবাসিক অঞ্চল হতে বহু দূরে কল-কারখানাগুলোকে নির্মাণ করা হয়। অর্থাৎ, পুঁজিবাদের আবির্ভাবের ফলে গৃহ ও পরিবার উৎপাদনের একক হিসেবে তার পূর্বতন গুরুত্ব হারায়। ‘গৃহী’ সত্তা এবং অধিকতর ‘নীতি-নৈতিকতাপূর্ণ লিঙ্গ হিসেবে নারীত্বের নির্মাণ ‘অনুৎপাদনশীল’ ভূমিকার সাথে যুক্ত হয়। ফলে, একই সাথে বেশ কয়েকটি জিনিস ঘটে: নারী হয়ে উঠে গৃহিণী, গৃহশ্রম অনুৎপাদনশীল কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দরুন নারী হয়ে উঠে অনুৎপাদক, স্বভাবজাতভাবে গৃহী হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দরুন নারী বিয়ের উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ক্যাথরিন হলের বক্তব্য হচ্ছে, বিভিন্ন আইনী সংস্কার সত্ত্বেও, বিয়ে হচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনিভাবে একটি বৈষম্যপূর্ণ সম্পর্ক। এ কারণে, পুঁজিবাদী সমাজে বিয়ে এবং পরিবার হচ্ছে নারী অধস্তনতা, এবং পুরুষ আধিপত্যের ভিত্তি। নীচের কেস স্টাডিতে ক্যাথরিন হলের এই বক্তব্যের একটি অংশ – গৃহিণীর ইতিহাস – উপস্থাপন করা হয়েছে।
আরও দেখুনঃ