আজকের আলোচনার বিষয় নিবিড় কৃষি সমাজ এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় বদল – যা প্রাক্ পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থা এর অর্ন্তভুক্ত, কৃষিভিত্তিক সমাজকে অনেক সময়ে নিবিড় কৃষির সমাজও বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের সমাজে কৃষিজ প্রযুক্তি উদ্যান-কৃষির থেকে ভিন্ন। প্রধান পার্থক্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। নিবিড় কৃষিতে সেচ, লাঙ্গল ব্যবহার করা হয় এবং চাষও হয় নিয়মিতভাবে যা উদ্যান-কৃষিতে হয় না। এছাড়া আরেকটা বিরাট পার্থক্য হচ্ছে মানুষের প্রদত্ত শ্রমের ক্ষেত্রে। নিবিড় কৃষিতে মানুষের অনেক শ্রম দিতে হয়।
এটা ঠিক যে, প্রাক্-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হিসেবে অনেক সমাজেই কৃষির প্রচলন থাকতে পারে। কিন্তু, বর্তমান পৃথিবীর পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া লক্ষ্য করলে কৃষিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হিসেবে দেখা যেতে পারে । নৃবিজ্ঞানীরা অবশ্য এই প্রশ্নকে সামনে রেখে বিস্তর তর্ক করেছেন। তা হ’ল: কৃষির সঙ্গে পুঁজিবাদের সম্পর্ক কি? অনেক নৃবিজ্ঞানীই মনে করেছেন যে কৃষিভিত্তিক আর্থব্যবস্থা একটা স্বতন্ত্র ব্যবস্থা; যেমন, ফার্থ, বেইলী, পোল্যানয়ি প্রমুখ। এ ব্যাপারে আপনারা কৃষক আর্থব্যবস্থা পাঠে আলোচনা পাবেন। ফলে এখানে এই ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে না।
নিবিড় কৃষি সমাজ এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় বদল
একটা কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, বর্তমান দুনিয়া হচ্ছে প্রযুক্তির দুনিয়া এবং প্রযুক্তি যত অর্জিত হয় ততই মানুষের শ্রমের গুরুত্ব এবং প্রয়োজন কমে। শ্রমিকদের জীবনে এই কথাটার তেমন কোন অর্থ নেই বিশেষত বর্তমান দুনিয়ার কৃষিজ শ্রমিক যাঁরা তাঁদের জীবনে। মার্শাল সাহলিনস এবং অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীদের কাজ থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে, প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষের শ্রমের প্রয়োজন পড়ে কম। তাছাড়া তাঁরা এও বলেছেন যে, এ ধরনের সমাজে পরিপূর্ণতা ছিল কিংবা আছে। বর্তমান দুনিয়ার কৃষিতে নিয়োজিত মানুষজনের ফসল ফলাবার জন্য অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়।
যেহেতু নিবিড় কৃষিতে ফসল ফলে গড়ে বেশি তাই এই শ্রম দেবার একটা অর্থ রয়েছে। কিন্তু এখানে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে কৃষিক্ষেত্রে শ্রম দিচ্ছেন যে সকল কৃষক-কিষাণী তাঁরা এই সকল উৎপাদিত ফসলের কতটুকু হিস্যা পান। কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থায় বদল আসাতে তাঁদের জীবনের মৌলিক বদল কি ঘটেছে। এই কথা বিশেষত গরিব বিশ্বের কৃষকদের বেলায় আরও খাটে।

বর্তমান দুনিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থার একটা বৈশিষ্ট্যের কথা আমাদের সকলেরই খেয়াল রাখা দরকার। যদিও কৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা হয়ে থাকে অপরাপর উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে এতে অন্নসংস্থান হয় বেশি, কিন্তু লাভজনক ফসল ফলিয়ে মুনাফা অর্জনই বর্তমান কৃষিব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফা অর্জনের এই হিসাব নিকাশ কৃষকের হাতে থাকে না। বরং বৃহত্তর ব্যবস্থার মধ্যে মুনাফার ব্যাপারটা জড়িত থাকে। তাছাড়া, শিল্পভিত্তিক সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখবার জন্য কৃষিব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা এখানে কাঁচামালের যোগান দিয়ে থাকে।
এভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত মানুষজনের শ্রম মজুরি শ্রমে পরিণত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকের সকল শ্রম কিনে নেবার ব্যবস্থা থাকে। সেটা প্রাক্-পুঁজিবাদী সমাজে সম্ভব নয়। এই কারণেই প্রাক্- পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার তুলনায় পুঁজিবাদী সমাজের শ্রম ও শ্রমিককে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বোঝা প্রয়োজন।
শ্রমের সাথে উৎপাদনের সম্পর্ক নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভেবেছেন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকেরা। নৃবিজ্ঞানেও তাঁদের একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সমাজের উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করবার জন্য উৎপাদন পদ্ধতি (mode of production) বলে একটা ধারণা তাঁরা প্রয়োগ করেন। উৎপাদন পদ্ধতি বলতে কোন সমাজের প্রযুক্তি এবং অন্যান্য বস্তুগত আয়োজন যেমন বোঝায়, তেমনি একই সাথে তা উৎপাদনকারী এবং ভোগকারীদের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কও বোঝায়।
আরও দেখুনঃ