তৃতীয় বরফ যুগে, আজ থেকে প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে, এক উন্নত ধরনের মানুষের আবির্ভাব ঘটে। জার্মানির নিয়াণ্ডার ভ্যালি (Neander Valley)-তে তাদের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া যায় প্রথম। সেই স্থান থেকেই এদের নাম হয়েছে “নিয়াণ্ডার্থাল মানুষ” (Neanderthal Man)। পরবর্তীতে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের অস্তিত্বের চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে।
নিরাণ্ডার্থাল মানুষ
শারীরিক গঠন
নিয়াণ্ডার্থাল মানুষরা শারীরিক দিক থেকে আধুনিক মানুষের তুলনায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল।
দেহের গঠন: খাটো, চওড়া ও মজবুত শরীর। উচ্চতা গড়ে পুরুষদের প্রায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি (১৬৫ সেমি) এবং নারীদের ৫ ফুট ১ ইঞ্চি (১৫৫ সেমি)। ওজন সাধারণত ৬৫–৮০ কেজি।
মাথা ও মুখমণ্ডল:
কপাল কিছুটা ঢালু ও ভুরু-চাপা (heavy brow ridges)।
মুখ সামান্য সামনে বেরিয়ে আসা (prognathism)।
চোয়াল শক্তিশালী, কিন্তু আধুনিক মানুষের মতো স্পষ্ট থুতনি (chin) ছিল না।
দাঁত তুলনামূলকভাবে বড় ও শক্ত, যা কঠিন খাদ্য কামড়ে খেতে সাহায্য করত।
নাক ও নাসারন্ধ্র: নাক ছিল বড় এবং প্রশস্ত।
গবেষকদের মতে, ঠান্ডা ও শুষ্ক পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার জন্য নাকের গঠন বিশেষভাবে অভিযোজিত ছিল।
হাত-পা:
হাত ও পায়ের হাড় মোটা ও মজবুত।
আঙুলগুলো মোটা ও ছোট, যা শক্তি প্রয়োগের কাজে উপযোগী।
হাড়ের ঘনত্ব বেশি, যা প্রমাণ করে তারা প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম করত।
মস্তিষ্ক:
গড় মস্তিষ্কের আকার প্রায় ১৪৫০ সিসি (আধুনিক মানুষের গড় ১৩৫০ সিসি)।
তবে তাদের মস্তিষ্কের গঠন আধুনিক মানুষের থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল—চোখের পেছনের অংশ (occipital lobe) বড়, যা দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে।
আধুনিক মানুষের তুলনায় তাদের frontal lobe (পরিকল্পনা ও সামাজিক দক্ষতার অংশ) কিছুটা ছোট হতে পারে।
জেনেটিক্স ও আধুনিক মানুষের সাথে সম্পর্ক
নিয়াণ্ডার্থালদের বিলুপ্তি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক থাকলেও, সাম্প্রতিক জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।
Neanderthal Genome Project (২০১০) প্রমাণ করেছে যে:
আধুনিক মানুষের সাথে নিয়াণ্ডার্থালদের সংমিশ্রণ (interbreeding) হয়েছিল।
আফ্রিকার বাইরে বসবাসকারী সকল আধুনিক মানুষের জিনোমে ১% থেকে ২% নিয়াণ্ডার্থাল ডিএনএ রয়েছে।
প্রভাব:
কিছু ইমিউন সিস্টেম সম্পর্কিত জিন নিয়াণ্ডার্থালদের থেকে এসেছে, যা আমাদের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
ত্বকের রঙ, চুল ও চোখের রঙ সম্পর্কিত জিনের কিছু বৈশিষ্ট্যও তাদের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে এসেছে।
তবে কিছু জিন আধুনিক মানুষের রোগপ্রবণতার সাথে সম্পর্কিত (যেমন টাইপ-২ ডায়াবেটিস, লুপাস, ক্রোনস ডিজিজ)।
মিশ্রণের সময়কাল: আনুমানিক ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার বছর আগে, আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার সময় নিয়াণ্ডার্থালদের সাথে মিশ্রণ ঘটে।
আধুনিক প্রভাব: পূর্ব এশীয় জনগোষ্ঠীতে নিয়াণ্ডার্থাল ডিএনএ-এর পরিমাণ কিছুটা বেশি (~২%)।
জীবিকা ও শিকার
১. পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট:
নিয়াণ্ডার্থালরা মূলত ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বরফ যুগের কঠোর পরিবেশে বসবাস করত।
- তখনকার আবহাওয়া ছিল শীতল, শুষ্ক এবং প্রায়শই বরফে ঢাকা।
- এ সময়ে বেঁচে থাকার জন্য শিকার ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করতে হতো।
- তারা ছিলেন দক্ষ শিকারী ও সংগ্রাহক (hunter-gatherers)।
২. শিকার করা প্রাণী:
নিয়াণ্ডার্থালরা অনেক বড় ও বিপজ্জনক প্রাণীর শিকার করত। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পাওয়া প্রমাণ অনুযায়ী তাদের প্রধান শিকার ছিল—
- বাইসন – শক্তিশালী মহিষজাতীয় প্রাণী।
- লোমশ ম্যামথ – বিশাল হাতি, যা তীব্র ঠান্ডার সাথে মানিয়ে বেঁচে থাকত।
- লোমশ গণ্ডার – বরফ যুগের বিশেষ প্রাণী।
- বন্য ঘোড়া, হরিণ, রেইনডিয়ার – খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
- বন্য মহিষ, আইবেক্স (পাহাড়ি ছাগল), শূকর, খরগোশ প্রভৃতি প্রাণীও তারা শিকার করত।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা নিয়াণ্ডার্থালদের আস্তানায় পোড়া হাড় ও কাটার দাগযুক্ত হাড় পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে তারা শুধু শিকার করতই না, বরং মাংস রান্না করেও খেত।
৩. শিকার কৌশল:
নিয়াণ্ডার্থালরা শিকার করত সংগঠিত দলবদ্ধ কৌশলে।
- দলবদ্ধ আক্রমণ: অনেক বড় প্রাণী (যেমন ম্যামথ বা বাইসন) ধরতে হলে দলবদ্ধভাবে পরিকল্পনা করে আক্রমণ চালাত।
- ফাঁদ ব্যবহার: পশুদের খাড়া পাহাড়ি ঢাল বা জলাভূমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেত, যেখানে তারা আটকে যেত।
- অস্ত্রের ব্যবহার:
- ভারী পাথরের হাতিয়ার, স্পিয়ার (বর্শা) ব্যবহার করত।
- শিকারের জন্য তারা কাঠের বর্শার অগ্রভাগে ধারালো পাথর বসাত।
- প্রমাণ আছে যে, তারা তাপে শক্ত করা কাঠের বর্শা ব্যবহার করত।
- আগুনের ব্যবহার: আগুন জ্বালিয়ে পশুদের ভয় দেখিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হতো।
৪. খাদ্যাভ্যাস
- মাংস: নিয়াণ্ডার্থালদের খাদ্যতালিকায় প্রধানত বড় প্রাণীর মাংস ছিল।
- অস্থিমজ্জা: তারা হাড় ভেঙে মজ্জা খেত, কারণ এটি শক্তি ও পুষ্টির সমৃদ্ধ উৎস।
- উদ্ভিদজাত খাদ্য: যদিও শিকারই প্রধান, তারা কিছু ফল, বাদাম, বীজ, শিকড়, এমনকি ভেষজও সংগ্রহ করত।
- সামুদ্রিক খাদ্য: স্পেন ও পর্তুগালের উপকূলে পাওয়া নিদর্শনে প্রমাণ মেলে যে তারা শামুক, ঝিনুক, মাছও খেত।
৫. শিকারী সমাজের জীবনযাত্রা
- গুহাবাসী: অনেক সময় তারা গুহায় বাস করত, যা শীত ও হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে নিরাপত্তা দিত।
- সামাজিক সহযোগিতা: বড় শিকারের জন্য পরিকল্পনা, দলে কাজ করা, খাবার ভাগ করে খাওয়া—এসব প্রমাণ করে তারা একে অপরের উপর নির্ভরশীল ছিল।
- কবর দেওয়ার রীতি: মৃতদের সাথে খাদ্য, হাতিয়ার বা ফুল রেখে সমাধিস্থ করা হতো। এটি নির্দেশ করে তারা সমাজজীবনে সহমর্মিতা ও আচারবোধ গড়ে তুলেছিল।
৬. দক্ষতার প্রমাণ
- শিকার ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে তারা ছিল অত্যন্ত দক্ষ।
- মাংস কাটতে বিশেষ স্ক্র্যাপার, পশুর চামড়া ছাড়াতে আলাদা হাতিয়ার, এমনকি হাড় কেটে সরঞ্জাম তৈরি করত।
- কিছু প্রত্নস্থলে প্রমাণ মেলে, নিয়াণ্ডার্থালরা পশুর চামড়া দিয়ে পোশাকও বানাতো, যা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেঁচে থাকার জন্য জরুরি ছিল।
নিয়াণ্ডার্থালদের হাতিয়ার ও প্রযুক্তি
১. হাতিয়ারের বৈচিত্র্য
নিয়াণ্ডার্থালরা আধুনিক মানুষের পূর্বসূরী হলেও তাদের হাতিয়ার ব্যবহারে উচ্চমাত্রার জটিলতা দেখা যায়।
- মুস্টেরিয়ান সংস্কৃতি (Mousterian Culture): নিয়াণ্ডার্থালদের সাথে সম্পর্কিত প্রধান হাতিয়ার সংস্কৃতি।
- তারা পাথর কেটে নানা কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রকার সরঞ্জাম তৈরি করত, যেমন—
- স্পিয়ার/বর্শার অগ্রভাগ – শিকারের জন্য।
- স্ক্র্যাপার (scraper) – পশুর চামড়া ছাড়ানো ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য।
- পয়েন্টেড টুলস – মাংস কাটতে বা হাড়ে ফুটো করতে।
- বিফেসড টুলস – একাধিক কাজে ব্যবহারের জন্য ধারালো পাথরের হাতিয়ার।
২. হাতিয়ার তৈরির কৌশল
তাদের হাতিয়ার শুধু এলোমেলোভাবে পাথর ভেঙে বানানো হতো না, বরং পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হতো।
- লেভালোয়া কৌশল (Levallois technique):
- নিয়াণ্ডার্থালরা প্রথম পাথরকে বিশেষভাবে প্রস্তুত করত, তারপর নির্দিষ্ট আঘাতে সমান আকারের টুকরো আলাদা করত।
- এতে ধারালো, সুনির্দিষ্ট আকারের পাথর তৈরি হতো।
- কাঠের হাতিয়ারের অগ্রভাগকে আগুনে পোড়ানো হতো, যাতে তা শক্ত ও টেকসই হয়।
- অনেক ক্ষেত্রে পাথরের ফলককে কাঠের সাথে জুড়ে কম্পোজিট টুলস (Composite tools) বানানো হতো।
এসব প্রমাণ করে যে নিয়াণ্ডার্থালরা শুধু হাতিয়ার ব্যবহারকারীই নয়, বরং দক্ষ কারিগরও ছিল।
৩. আগুন ও তাপের ব্যবহার
- নিয়াণ্ডার্থালরা আগুন নিয়ন্ত্রণে দক্ষ ছিল।
- আগুন ব্যবহার করত—
- শিকার তাড়াতে,
- খাবার রান্না করতে,
- ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণতা পেতে,
- পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে।
- কিছু প্রত্নস্থলে প্রমাণ পাওয়া গেছে তারা পাথর গরম করে তারপর ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে তাপ-প্রক্রিয়াজাত ফ্লিন্ট ব্যবহার করত, যা আরও ধারালো হতো।
৪. পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও পোশাক
- নিয়াণ্ডার্থালরা পশুর চামড়া কেটে ও স্ক্র্যাপার দিয়ে পরিষ্কার করে তা পোশাক বানাতো।
- শীতল ইউরোপীয় জলবায়ুতে পোশাক ছিল বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত।
- প্রমাণ পাওয়া গেছে, তারা পশুর চামড়া সেলাই করত—যা সূঁচের আদলে ধারালো হাড় দিয়ে তৈরি করা হতো।
৫. বস্তু ও হাড় ব্যবহার
- পাথরের পাশাপাশি তারা হাড়, শিং, দাঁত ও কাঠ দিয়েও সরঞ্জাম বানাতো।
- শিকার করা প্রাণীর হাড় শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বরং কাটার টুল, হাতল ও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
- কিছু নিদর্শনে দেখা গেছে তারা রঙ ব্যবহার করেছে (ওখর বা লাল মাটি), যা হয়তো প্রতীকী কাজ বা শরীর সাজানোর জন্য।
৬. প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রমাণ
- প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক স্থানে সংগঠিত হাতিয়ার কারখানা (workshop)-এর নিদর্শন পেয়েছেন।
- শিকারের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও দৈনন্দিন জীবনের কাজের জন্য আলাদা হাতিয়ার বানানো হতো।
- হাতিয়ারের মান দেখে বোঝা যায় তারা অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতো, যা জ্ঞান হস্তান্তরের নিদর্শন।
৭. প্রতীকী প্রযুক্তির ইঙ্গিত
যদিও বিতর্কিত, তবে প্রমাণ আছে যে নিয়াণ্ডার্থালরা—
- গয়না, শাঁখা বা দাঁত দিয়ে অলঙ্কার বানাতো।
- ওখর (ochre) নামক রঙ ব্যবহার করত, যা হয়তো ধর্মীয় আচার, শিকার কৌশল বা শরীর রঙ করার জন্য ব্যবহৃত হতো।
এগুলো নির্দেশ করে তাদের মধ্যে প্রতীকী চিন্তা ও সৃজনশীলতার বীজ বিদ্যমান ছিল।
কবর দেওয়ার প্রথা
নিয়াণ্ডার্থাল মানুষের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল মৃতদের কবর দেওয়া।
- মৃতদেহকে পাথরের গর্তে রাখা হতো।
- পাশে রাখা হতো তাদের ব্যবহৃত হাতিয়ার, খাদ্য, এমনকি ফুল-মালা ও উষ্ণতা রাখার জন্য আগুনের পাত্র।
এটি প্রমাণ করে যে নিয়াণ্ডার্থালদের মধ্যে আচার-অনুষ্ঠান, সহানুভূতি এবং পরকাল সম্পর্কে বিশ্বাসের বীজ বিদ্যমান ছিল। - মানুষের ইতিহাসে এটাই ছিল ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার প্রথম দিকের নিদর্শন।

বিলুপ্তি ও উত্তরাধিকার
প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে নিয়াণ্ডার্থালরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সম্ভাব্য কারণ:
- প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া – তখনকার আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) আরও দক্ষ শিকারী ছিল।
- পরিবেশ পরিবর্তন – বরফ যুগের অবসান ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়া।
- জাতিগত মিশ্রণ – অনেক গবেষকের মতে নিয়াণ্ডার্থালরা আধুনিক মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিল। ফলে তারা আলাদা প্রজাতি হিসেবে বিলীন হলেও তাদের কিছু জিন আজও আমাদের মধ্যে টিকে আছে।
আধুনিক মানুষের জিনোমে প্রায় ১–২% নিয়াণ্ডার্থাল ডিএনএ বিদ্যমান বলে সাম্প্রতিক জেনেটিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
নিয়াণ্ডার্থাল মানুষ ছিল মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তারা—
- শক্তিশালী শিকারী,
- আগুন ও হাতিয়ারের দক্ষ ব্যবহারকারী,
- সামাজিক আচরণের ধারক,
- এবং প্রথমবার মৃতদেহের কবর দেওয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চেতনার সূচনা করেছিল।
যদিও তারা বিলীন হয়েছে, তবে তাদের কিছু শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য এবং জেনেটিক উত্তরাধিকার আজও আধুনিক মানুষের মধ্যে বেঁচে আছে।
তাই নিয়াণ্ডার্থাল মানুষকে শুধু একটি বিলুপ্ত প্রজাতি হিসেবে নয়, বরং আমাদের প্রাগৈতিহাসিক আত্মীয় ও মানব বিবর্তনের সোপান হিসেবে দেখতে হবে।
নিয়াণ্ডার্থাল মানুষ মানব ইতিহাসের এক অসাধারণ অধ্যায়, যেখানে আমরা দেখি প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ কীভাবে নিজেকে ক্রমে গড়ে তুলেছে। বরফ যুগের কঠিন বাস্তবতায় তারা শুধু বেঁচে থাকেনি, বরং আগুন, হাতিয়ার, পোশাক, সামাজিক সহযোগিতা ও কবর দেওয়ার মতো মানবীয় রীতির প্রবর্তন ঘটিয়েছিল। শিকার কৌশল, হাতিয়ার নির্মাণ, পশুর চামড়া ব্যবহার, এবং প্রতীকী আচরণের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছিল যে তারা ছিল কেবল “শক্তিশালী প্রাণী” নয়, বরং চিন্তাশীল ও সামাজিক মানুষ।
যদিও প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে আধুনিক মানুষের সাথে মিশ্রণের ফলে তাদের জিন আজও আমাদের শরীরে বহমান। আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা, ত্বক ও চোখের বৈশিষ্ট্য, এমনকি কিছু রোগপ্রবণতার জিনেও তাদের উত্তরাধিকার রয়ে গেছে। তাই নিয়াণ্ডার্থাল মানুষ কেবল অতীতের এক বিলুপ্ত প্রজাতি নয়, বরং আমাদের নিজেদের পরিচয়েরই একটি অংশ।
মানব সভ্যতার প্রাচীন যাত্রায় নিয়াণ্ডার্থাল মানুষকে আমরা দেখতে পাই শক্তি, দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং মানবীয় চেতনার এক অনন্য মেলবন্ধন হিসেবে। তাদের অস্তিত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের ইতিহাস মানেই বেঁচে থাকার লড়াই, অভিযোজন ও নতুন পথ নির্মাণের ইতিহাস।