পতি-পত্নী সংখ্যা

আজকের আলোচনার বিষয় পতি-পত্নী সংখ্যা – যা  বিয়ের ধরন এর অর্ন্তভুক্ত,  এই মূলনীতির ভিত্তিতে বিয়েকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়: (ক) বহু-পত্নী (polyandrous) বিবাহ, (খ) বহু-পতি (polygynous) বিবাহ, এবং (গ) এক-পতিপত্নী (monogamous) বিবাহ । বহু-পত্নী বিবাহ বহু বিবাহের (polygamous, polygamy) একটি ধরন। বিয়ের এই ব্যবস্থায় স্বামীর থাকে একাধিক স্ত্রী। কোন কোন সমাজে, স্ত্রীরা জ্ঞাতি সম্পর্কে হন পরস্পরের ভগ্নী। নৃবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বিয়ের নামকরণ করেছেন ভগ্নী বহু-পত্নী বিবাহ (sororal polygyny)। বহু-পতি বিয়ের তুলনায়, বহু-পত্নী বিয়ে বেশি প্রচলিত এবং নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে এর প্রচলন আঞ্চলিক নয়।

বিশ্বের বহু অঞ্চলে বিয়ের এই ধরনকে স্বাভাবিক ভাবা হয়। এই ভাবনার ব্যতিক্রম হচ্ছে খ্রিস্টীয়- প্রধান ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। খ্রীস্টিয় ধর্ম মতে বিয়ে হতেই হবে এক-পতিপত্নী বিবাহ। বহু পতি-পত্নী বিবাহ খ্রিস্টীয়-প্রধান ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় আইনগতভাবে নিষিদ্ধ।

 

পতি-পত্নী সংখ্যা

 

পতি-পত্নী সংখ্যা

যে সকল অঞ্চলে বংশধারা ব্যবস্থা বিদ্যমান সেখানে দেখা গেছে যে, সকল পুরুষ নয় বরং শুধুমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ক্ষমতাশালী পুরুষেরা বহু-পত্নী বিবাহ করে থাকেন। কিছু কিছু সমাজে, এটি শুধু মাত্র দলনেতা অথবা মাতব্বর বা সর্দারদের জন্য রক্ষিত। আমাজন অঞ্চলের সমাজে, একাধিক স্ত্রী থাকা ক্ষমতার চিহ্ন, আবার ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করবার পথ। একাধিক স্ত্রীর মাধ্যমে জ্ঞাতিকুল বৃদ্ধি করা সম্ভব, বহু সন্তান-সন্ততি লাভ করা সম্ভব। বিবাহসূত্রে অর্জিত এই বিশাল জ্ঞাতিকুল একজন দলনেতার দলকে ভারী করে, নানান ধরনের কৌশলী মিত্রসম্পর্ক স্থাপনে এটি তাঁর কাজে লাগে।

এই বিবাহ প্রথা পুরুষটির অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয় কারণ আংশিকভাবে হলেও, তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের শ্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বহু-পত্নী বিবাহ অনেক ক্ষেত্রেই বয়সের অসমতার সাথে যুক্ত। বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষেরা বিয়ে করেন অল্প বয়স্ক নারীদের; এবং এ সমাজগুলোতে দেখা যায়, অল্পবয়স্ক পুরুষেরা হয় বহু বছর অবিবাহিত থাকেন অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষদের বিধবাদের বিয়ে করেন। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বহু-পত্নী বিবাহের প্রচলন ঘটে এমন ধরনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেখানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে মানুষ। যে সকল সমাজে জমি এবং অন্যান্য ধরনের ব্যক্তিসম্পত্তি বিদ্যমান, সেখানে এক পতিপত্নী বিবাহের প্রচলন দেখা যায়।

বহু -পতি ব্যবস্থায় একজন স্ত্রীর থাকে একাধিক স্বামী। তিব্বত, নেপাল এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে এধরনের বিয়ের প্রচলন দেখা গেছে। দক্ষিণ ভারতের টোডাদের মাঝে দেখা গেছে যে, একজন নারীর যে পুরুষের সাথে বিয়ে হয়, তাঁর অপর ভাইয়েরা সকলেই তাঁর স্বামী। যদি বিয়ের পর স্বামীর ভাই জন্মায়, তাহলে সেও স্বীকৃত হয় তার ভাইয়ের বউয়ের স্বামী হিসেবে। স্ত্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা হন, তাঁর সন্তানের জৈবিক পিতা কে, সেটা নির্ধারণ করা জরুরী মনে করা হয় না। বাচ্চা যখন সাত মাস পেটে, তখন “ধনুক দেয়ার” (“ giving the bow”) অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজ ও আইনের দৃষ্টিতে সন্তানের বাবা কে, তা ঠিক করা। ঘাস-ডালপালা দিয়ে একটি প্রতীকী তীর-ধনুক বানিয়ে, সাধারণত যে ভাই সকল স্বামীর মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি হবু সন্তানের মাকে এটি উপহার দেন। স্বামীর জ্ঞাতগোষ্ঠী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। তীর-ধনুকের এই সম্প্রদান অনুষ্ঠান উপস্থিত সকলকে জানিয়ে দেয় যে তিনি হচ্ছেন হবু সন্তানের পিতা। একাধিক সন্তান হবার পর, দ্বিতীয় ভাই “ধনুক” উপহার দেন তাঁর/তাঁদের স্ত্রীকে।

কিছু নৃবিজ্ঞানীদের মনে হয়েছে, বহু-পতি ব্যবস্থা শিশুকন্যা হত্যার সাথে সম্পর্কিত কারণ যেসব অঞ্চলে এ ধরনের বিয়ের প্রচলন, সেখানে জন্মের পরপরই শিশুকন্যাকে হত্যা করার রীতি আছে। কিন্তু যেহেতু শিশুকন্যা হত্যা বহু-পত্নী বিবাহ অঞ্চলেও প্রচলিত, সে কারণে এই সিদ্ধান্ত অনেক নৃবিজ্ঞানীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নৃবিজ্ঞানী বেরিম্যান-এর অভিমত হচ্ছে, হিমালয় অঞ্চলের বহু-পতি প্রথার মূল কারণ হচ্ছে ভূমির স্বল্পতা।

বহু-পতির ফলে পরিবারের সাইজ ছোট থাকে। এবং, এতে জমি খন্ড-বিখণ্ডিত হয় না। এখানে লক্ষণীয় যে, বহু-পত্নী ব্যবস্থায় একজন স্বামী বহু সন্তান লাভ করতে পারেন কিন্তু বহু-পতি ব্যবস্থায়, এমনটি ঘটে না। তার কারণ, স্বামীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে নারীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না, সেটি অপরিবর্তিত থেকে যায়। বেরিম্যানের মতে, বহু-পতি প্রথা ভূমিজ সম্পদ এবং শ্রম সম্পদের সামঞ্জস্য সাধন করে তোলে। তিনি আবার একইসাথে আমাদের সতর্ক করে দেন যে, সামঞ্জস্য সাধনের একটি মাত্র সম্ভাব্য কৌশল হচ্ছে বহু-পতি বিবাহ। তার কারণ, হিমালয় অঞ্চলের এই হিন্দু সমাজগুলোতে, একই সাথে এক-পতিপত্নী বিবাহেরও প্রচলন আছে।

 

পতি-পত্নী সংখ্যা

 

এক-পতিপত্নী বিবাহ প্রথা অনুসারে একজন নারীর সাথে একজন পুরুষের বিবাহ ঘটে। দেখা গেছে, কিছু অঞ্চলে এক-পতিপত্নী বিয়ের অর্থ হচ্ছে বিবাহিত থাকা অবস্থায় অন্য কোন পতি বা পত্নী গ্রহণ নিষিদ্ধ। কিন্তু, যদি স্বামী কিংবা স্ত্রীর মৃত্যুর মাধ্যমে, অথবা ছাড়াছাড়ির মাধ্যমে, বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে স্ত্রী কিংবা স্বামী পুনরায় বিয়ে করতে পারেন। কিছু অঞ্চলে, এমনটি নয়। অর্থাৎ, ছাড়াছাড়ি অনুমোদিত নয়; উপরন্তু স্বামী কিংবা স্ত্রীর মৃত্যুর পর, পুনরায় বিয়ে করা অনুমোদিত নয়। পুনরায় বিয়ের প্রচলনের নামকরণ নৃবিজ্ঞানীরা করেছেন ক্রমাম্বিক এক-পতিপত্নী বিবাহ (serial monogamy)।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment