পারিবারিক সম্পর্ক হচ্ছে ইতিহাস-নির্দিষ্ট

আজকের আলোচনার বিষয় পারিবারিক সম্পর্ক হচ্ছে ইতিহাস-নির্দিষ্ট – যা পরিবারের ধরন এর অর্ন্তভুক্ত,  এ পাঠের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরিবারের শ্রেণীকরণের যে প্রবল ধারা জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে প্রায় একশ বছর ধরে প্রচলিত ছিল তা ছিল অনৈতিহাসিক। এই ধারার কাজ পড়ে মনে হয় যে, পরিবারের বিভিন্ন ধরন প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে অনড়, অটলভাবে পুনরুৎপাদিত হতে থাকে। মনে হয় যে, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে বহুস্ত্রী বিবাহ, দরুদের মধ্যে মাতৃসূত্রিতা এবং সামোয়ানদের বিয়ে ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, এবং থাকবে।

কিন্তু পর্যবেক্ষদের মতে, বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ অপাশ্চাত্য সমাজগুলোতে পরিবার গঠনে মৌলিক বদল এনেছে। এই পরিবর্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একজন বয়স্ক পোমো ইন্ডিয়ানের (আদিবাসী) দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এভাবে:

 

পারিবারিক সম্পর্ক হচ্ছে ইতিহাস-নির্দিষ্ট

 

পারিবারিক সম্পর্ক হচ্ছে ইতিহাস-নির্দিষ্ট

“মানুষ কি? মানুষ কিছু না। পরিবার ছাড়া একজন মানুষের গুরুত্ব পথের ধারের কীটের চাইতেও কম, থুথু বা মল সেটার চাইতেও নগণ্য সে…. আমাদের সমাজে একজন মানুষ যদি গুরুত্ব পেতে চায় তাহলে ওর নিজের পরিবারের সাথে থাকতে হবে। যদি ওকে সাহায্য করার কেউ না থাকে, তাহলে তো ও প্রথম যে ঝামেলাতে পড়বে সেটাতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। তার কারণ, ওর কোন আত্মীয় সাথে থাকবে না যে ওকে শত্রুট্রপক্ষের বিষ মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে।

কোন মেয়ে ওকে বিয়ে করতে চাইবে না… ওতো একজন নতুন শিশুর চাইতেও অনাথ, কেঁচোর চাইতেও দুবর্ল… কারও যদি বড় সংসার থাকে… এবং ওর বংশের যদি সুনাম থাকে, অমুক বংশের ছেলেমেয়েরা ভাল, তাহলে তো ও বড় কিছু। প্রতিটি পরিবার চাইবে ও তাদের মেয়ে বিয়ে করুক।

শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে পরিবার তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তোমাদের সমাজে পুলিশ আর সেনা বাহিনী আছে তোমাকে রক্ষা করার জন্য, কোর্ট কাচারী আছে তোমাকে বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য, ডাকঘর তোমার বার্তা আনা নেওয়া করে, স্কুল তোমাকে শিক্ষা দেয়। সব কিছুরই দেখ-ভাল করা হয়। এমনকি তুমি যদি মারা যাও, তোমার সন্তানদেরও [দেখ-ভাল করে]; কিন্তু আমাদের সমাজে, এসব কাজ পরিবার করে…….।

আমাদের জীবনে, পরিবার ছিল সব কিছু। এখন পরিবার কিছু না। আমরাও শ্বেতাঙ্গদের মত হয়ে যাচ্ছি এবং সেটা বয়স্ক মানুষদের জন্য খারাপ। তোমাদের মত আমাদের বৃদ্ধ আবাস ছিল না। বয়োজ্যেষ্ঠরা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা জ্ঞানী গুণী ছিলো। তোমাদের বৃদ্ধরা বোধ হয বোকা”। 

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

১৯৫০-১৯৬০ এর দশকে ভিন্ন ধারার কাজ জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে তৈরি হয় (এ প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ইউনিট ৪ এর শেষতম পাঠে পাবেন)। নতুন ধারায় পরিবারকে “কাঠামোর” পরিবর্তে “প্রক্রিয়া” হিসেবে, এবং সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠান এবং সম্পর্ক হতে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে, সামগ্রিক ব্যবস্থার সাপেক্ষে দেখার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

এ ধরনের একটি কাজ নিচে কেস স্টাডি আকারে উপস্থাপিত হয়েছে। কলকাতা শহরে ১৯৭৯-১৯৮৫ সময়কালে বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী হিলারী স্ট্যান্ডিং তাঁর গবেষণা করেন। তাঁর কাজ থেকে এই কেস | স্টাডিটি তৈরি করা হয়েছে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু হচ্ছে, নারীর কর্মসংস্থান এবং পরিবারে সেটির প্রভাব। ইদানিং কালে, নৃবিজ্ঞান চর্চায় যে ধারা ঐতিহাসিক রূপান্তর এবং সেটিতে ঔপনিবেশিকতার ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করে, স্ট্যান্ডিং সেই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন।

স্ট্যান্ডিং বলছেন, ১৯ এবং ২০ শতকে বাংলা অঞ্চলের সমাজ এবং অর্থনীতি পুনর্গঠিত হয়। উনিশ শতকের | শেষার্ধে বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠে। ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত গঠনের ভিত্তি ছিল শিল্প পুঁজি, কিন্তু উপনিবেশিত বাংলার মধ্যবিত্ত স্বতন্ত্রভাবে গড়ে উঠেনি, গঠিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থে। সেই শক্তির প্রয়োজনে এই অঞ্চলে একটি প্রশাসনিক এবং পেশাজীবী (শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী ইত্যাদি) শ্রেণী গড়ে উঠে।

শ্রেণী গঠনের সাথে সাথে নারী এবং পুরুষের পরিসরের পূর্বতন বিভাজন – “ঘর” এবং “বাহির” – পুনর্গঠিত হয়। পরিসরের নতুন বিভাজন তৈরী হয়: “চাকরি” চিহ্নিত হয় পুরুষের ক্ষেত্র হিসেবে আর “ঘর”, “গৃহী কাজ” নির্দেশিত হয় নারীর পরিসর হিসেবে। এই শ্রেণীর মতাদর্শে, নারীর ভূমিকা অঙ্কিত হয় পুরুষের “সহযোগী” হিসেবে। চাকরিজীবী বাঙ্গালী পুরুষের উপযুক্ত বিবাহ সঙ্গী হতে হবে শিক্ষিত নারী।

যেহেতু এই শ্রেণীর পুঁজি হচ্ছে শিক্ষা এবং চাকরি, সে কারণে নারী শিক্ষার গুরুত্ব কেবলমাত্র “স্ত্রী”র ভূমিকা রূপে নয়, “মা” হিসেবেও নারীর শিক্ষিত হওয়া এই শ্রেণীর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মজুরি ভিত্তিক অর্থনীতির সূত্রপাত এবং প্রসার নব্য-গঠমান বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পারিবারিক টানাপোড়েন ও সংঘাত তৈরী করে।

 

পারিবারিক সম্পর্ক হচ্ছে ইতিহাস-নির্দিষ্ট

 

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে, বেতন বা পারিশ্রমিক বা মজুরি হচ্ছে যে ব্যক্তি শ্রম দেন তার ভোগের বস্তু। ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছানুসারে, তাঁর উপর যারা নির্ভরশীল তাদের ভরণপোষণের জন্য মজুরি বা বেতন, ব্যয় করে থাকেন। পুঁজিবাদী এবং ব্যক্তিবাদী মতাদর্শ অনুসারে, একজন আয়কারী পুরুষের উপর নির্ভরশীল হবেন তার স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান। স্ট্যান্ডিংয়ের বিশ্লেষণে, আধুনিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, ব্যাংক, সঞ্চয়, বীমা পলিসি মূল্যবোধের এই কাঠামোকে প্রতিষ্ঠিত করে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment