পৃথিবীতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল ও রূপান্তরশীল। জগতের এই গতিশীলতার কারণেই তার ইতিহাস রয়েছে। যদি পৃথিবী স্থবির ও অপরিবর্তনীয় হতো, তবে ইতিহাস বলার কিছু থাকত না। ইতিহাস মানে মূলত পরিবর্তনের, রূপান্তরের এবং প্রগতির ইতিহাস।
মানবসমাজের ইতিহাসও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়—এটি হলো মানুষের উৎপত্তি, বিবর্তন ও প্রগতিশীল বিকাশের ধারাবাহিক কাহিনি।
পুরান পাথর যুগের শিকারী সমাজ
মানুষের উৎপত্তির ধারা
মানুষের ইতিহাস রচনায় তার উৎপত্তির কাহিনি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রূপে আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে। তার আগে ছিল ভিন্নধর্মী, কিছুটা অসম্পূর্ণ মানুষ—যাদের থেকে বিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটে।
এই পরিবর্তন কেবল শারীরবৃত্তীয় ছিল না, বরং প্রাণিজগতের অন্যান্য বিবর্তন থেকে পৃথক ছিল। কারণ মানুষের বিবর্তনে সামাজিকতা, পরিবেশের সাথে অভিযোজন ও মানসিক বিকাশ একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
প্রাণিজগতের বিবর্তন বনাম মানব বিবর্তন
মানুষের আগের প্রাণীদের বিবর্তন ঘটেছে মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে।
- উদাহরণস্বরূপ: ভূমিচর প্রাণীদের মাথার দুই পাশে চোখ থাকাটা উপযোগী, কারণ এতে তারা চারপাশে সহজে দেখতে পারে এবং শত্রু থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে।
- কিন্তু প্রায় ৭ কোটি বছর আগে এক শ্রেণির ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী যখন গাছে বাস করতে শুরু করল, তখন তাদের জন্য সামনে চোখ থাকা বেশি সুবিধাজনক হয়ে ওঠে।
বৃক্ষবাসীদের অভিযোজন ও প্রাইমেটের বিকাশ
গাছে লাফানো, ডাল আঁকড়ে ধরা ও দূরত্ব নিরূপণের জন্য নতুন কিছু দেহগত বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন হয়।
- মুখের সামনে চোখ থাকার ফলে দ্বিচক্ষু দৃষ্টি (binocular vision) তৈরি হয়। এতে দুটি চোখে পাওয়া আলাদা চিত্র মস্তিষ্কে একত্রিত হয়ে গভীরতা বা depth perception দেয়। ফলে কোনটি কাছে, কোনটি দূরে—এটি সহজে বোঝা যায়।
- এই ক্ষমতা গাছে ডাল থেকে ডালে লাফানোর জন্য অপরিহার্য ছিল।
প্রাইমেটদের মধ্যে এভাবেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটে—
- বাঁকানো নখরের পরিবর্তে চ্যাপ্টা নখ।
- স্বতন্ত্রভাবে নড়ানো যায় এমন আঙুল।
- বিশেষভাবে গড়ে ওঠা বুড়ো আঙুল, যা অন্য আঙুলের বিপরীতে থেকে মুঠি বানাতে সহায়তা করে।
- গাছে বসবাসের ফলে তাদের মাংসপেশি, ইন্দ্রিয় ও স্নায়ুতন্ত্র ধীরে ধীরে উন্নত হয়।
প্রাইমেট থেকে মানুষের উদ্ভব
এই প্রাইমেটদের এক শাখা থেকে ধীরে ধীরে মানুষের উৎপত্তি ঘটে। অন্য শাখার প্রাণীরা কিন্তু বানর বা নরবানর পর্যায়ে থেকে যায় (যেমন গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং)।
কিন্তু মানুষের পূর্বপুরুষেরা অভিযোজন ক্ষমতা, হাতের দক্ষতা ও মস্তিষ্কের জটিলতার কারণে ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়।
প্রাইমেটদের মস্তিষ্কের বিকাশ
প্রাইমেটদের বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশ।
- গবেষণায় দেখা যায়, যখন মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন তুলনামূলকভাবে চোয়ালের আকার ছোট হয়েছে।
- শিম্পাঞ্জি → অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ → খাড়া মানুষ (পিকিং ও জাভা মানুষ)—এ ধাপগুলোতে করোটির ভেতর মস্তিষ্কের আয়তন ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কারণ:
গাছের ডাল সর্বদা দুলতে থাকে। সেখানে বাস করতে হলে ভারসাম্য রাখতে হয়, দ্রুত চিন্তা করতে হয়, স্মৃতি ব্যবহার করতে হয়।
ফলস্বরূপ, বৃক্ষবাসী প্রাইমেটরা ক্রমশ বড় মস্তিষ্ক অর্জন করে।
প্রাইমেটদের বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা
যখন প্রাইমেটদের একটি শাখা গাছ থেকে নেমে এসে মানুষের পূর্বপুরুষে রূপান্তরিত হলো, তখনও তাদের মধ্যে চোখের বিশেষ গঠন, হাতের কাঠামো ও মস্তিষ্কের বিকাশ থেকে যায় এবং ক্রমশ উন্নত হয়।
এই কারণেই আজও মানুষ, বানর ও গরিলার মধ্যে বহু আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
বিবর্তনে বংশগতি ও পরিবর্তন
প্রশ্ন আসতে পারে: পরিবেশের প্রভাবে কি প্রাণী সরাসরি নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে?
- কেউ ইচ্ছা করলেই নখর চ্যাপ্টা করতে পারে না বা চোখের অবস্থান বদলাতে পারে না।
- কিন্তু বংশগত প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে।
উদাহরণ:
- যদি কোনো প্রাইমেটের চোখ সামান্য সামনের দিকে এগিয়ে আসে, তার সন্তানদের মধ্যেও এ বৈশিষ্ট্য দেখা দেবে।
- কয়েক প্রজন্ম পরে দেখা যাবে, পুরো একটি দলের বহু প্রাইমেটের চোখ সামনের দিকে।
- গাছে বাসের জন্য এ ধরনের চোখওয়ালারা সুবিধা পাবে, ফলে তারা বেশি বাঁচবে।
- অন্যদিকে দু’পাশে চোখওয়ালারা পড়ে গিয়ে মারা যাবে এবং ক্রমশ বিলুপ্ত হবে।
এভাবেই নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচন
এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)।
- প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্জনকারীরাই টিকে থাকে।
- যারা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না, তারা বিলুপ্ত হয় বা অপ্রধান হয়ে পড়ে।
প্রজাতি বলতে বোঝায়—একই জাতীয় প্রাণী যারা নিজেদের মতো সন্তান জন্ম দিতে পারে (যেমন মানুষ, গরু ইত্যাদি)।
মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্নতা
মানুষের উদ্ভব পর্যন্ত প্রাণিজগতের বিবর্তন কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটেছে।
কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়—
- মানুষ কেবল প্রাকৃতিক অভিযোজনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং নিজেদের সামাজিক কার্যকলাপ ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বিবর্তন ঘটিয়েছে।
- আধুনিক মানুষ আজ থেকে প্রায় ৪০–৫০ হাজার বছর আগে উদ্ভূত হয়।
- কিন্তু তার আগে ১০–২০ লক্ষ বছর আগেও আধা–মানুষ (Homo erectus, Australopithecus) বিদ্যমান ছিল।
আধা–মানুষ থেকে পূর্ণ মানুষ
যদিও শারীরিক গঠন অনুযায়ী তাদেরকে “আধা-মানুষ” বলা যায়, কিন্তু সামাজিক জীবন ও দলবদ্ধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা—
- ধীরে ধীরে নতুন শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে,
- দলবদ্ধ শিকার, খাদ্য সংগ্রহ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও আগুন ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।
ফলে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষ (Homo sapiens sapiens) আবির্ভূত হয়, যারা আজকের আমাদের মতোই মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও হাতের দক্ষতার অধিকারী ছিল।

আধা–মানুষদের অবদান
যদিও আমরা তাদের “আধা-মানুষ” বলি, তবুও গত কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তন ও আবিষ্কারের ধারায় তাদের অবদান অমূল্য।
- শারীরিক দিক থেকে তারা আধুনিক মানুষের তুলনায় অসম্পূর্ণ ছিল—অনেকেই পুরোপুরি খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারত না, তাদের মস্তিষ্কের আয়তনও ছিল কম।
- তবে তারা এমন সব বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল এবং এমন সব আবিষ্কার করেছিল, যা পরবর্তীকালে আধুনিক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
ভাষার আবিষ্কার
আধা-মানুষদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ভাষার আবিষ্কার।
- বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাংয়ের মতো প্রাণীদের হাত, চোখ ও মস্তিষ্ক মানুষের মতো হলেও তারা কথা বলতে পারে না।
- ভাষা মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পুরোপুরি আলাদা করেছে।
ভাষার গুরুত্ব:
- ভাষার মাধ্যমে মানুষ চিন্তা করতে পারে এবং ভাব আদান-প্রদান করতে পারে।
- নতুন কোনো জ্ঞান বা কৌশল আবিষ্কার হলে তা মুখে বলে অন্যদের শেখানো সম্ভব হয়েছে।
- ভাষা না থাকলে প্রতিটি প্রজন্মকে শূন্য থেকে শুরু করতে হতো; কিন্তু ভাষা থাকায় মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে জ্ঞান সঞ্চয় করতে পেরেছে।
ভাষা কীভাবে সৃষ্টি হলো?
- এটি কোনো একক মানুষের আবিষ্কার নয়, বরং একটি সামাজিক আবিষ্কার।
- দলবদ্ধভাবে শিকার করতে গিয়ে সমন্বয়ের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল যোগাযোগের। এই পারস্পরিক সহযোগিতা থেকেই ভাষার জন্ম।
- ভাষার জন্য দেহগত অভিযোজনও অপরিহার্য ছিল:
- বড় ও উন্নত মস্তিষ্ক
- উন্নত বাকযন্ত্র ও জিভ
- কান ও জিভের সমন্বয় ব্যবস্থা
অস্ট্রালোপিথেকাস ও প্রাথমিক হাতিয়ার
প্রায় ২০–২৫ লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী আধা-মানুষদের কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা তাদের নাম দিয়েছেন অস্ট্রালোপিথেকাস (অর্থ: দক্ষিণের বানর)।
তারা প্রথমবারের মতো ধারালো পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করেছিল।
- একটি পাথর দিয়ে আরেকটি পাথরে আঘাত করে ফাটিয়ে ছোট হাতিয়ার বানানো হতো।
- হাতিয়ারের ধরন:
- ছুঁচালো একমুখ – পশু হত্যা করার জন্য
- দুপাশ ধারালো পাথর – পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য
- চাপা ধারালো পাথর – মাংস কাটার জন্য
এগুলোই ছিল মানবজাতির প্রথম প্রযুক্তিগত সৃজনশীলতার নিদর্শন।
হাতিয়ার তৈরিতে হাত–চোখের সমন্বয়
প্রথম দিকের হাতিয়ারগুলো যতই আদিম হোক না কেন, এগুলো বানানোর জন্য প্রয়োজন ছিল—
- তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি,
- হাত ও চোখের সূক্ষ্ম সমন্বয়,
- এবং সর্বোপরি চিন্তাশক্তির প্রয়োগ।
মানুষ যখন পাথর ভেঙে ধারালো টুকরো বানাত, তখন শুধু শক্তি নয়, বরং চোখে দেখা জিনিসটিকে নির্দিষ্টভাবে হাত দিয়ে আঘাত করার সমন্বয় দরকার হতো।
আজকের দিনে যেমন একজন দক্ষ ক্রিকেটার শূন্যে লাফিয়ে বল ক্যাচ করতে পারেন, বা একজন শিকারি সঠিক লক্ষ্যভেদ করতে পারেন—এগুলো সম্ভব হয় মস্তিষ্ক, দৃষ্টি ও হাতের মধ্যে নিখুঁত সমন্বয়ের কারণে।
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর সংযোগব্যবস্থা
মানুষের দেহে এ সমন্বয় সম্ভব হয়েছে জটিল স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের কারণে।
- মস্তিষ্কে রয়েছে অগণিত স্নায়ুকোষ (neurons)। সেখান থেকে সূক্ষ্ম স্নায়ু সারা দেহে ছড়িয়ে আছে।
- এক ধরনের স্নায়ু মস্তিষ্কের নির্দেশ হাত, পা, চোখ, মুখসহ বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছে দেয়।
- গুরুমস্তিষ্কের কর্টেক্স অংশে রয়েছে দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্পর্শ, ব্যথা ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র।
- কর্টেক্সের ভেতর বিভিন্ন কেন্দ্র একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখে, ফলে মানুষ জটিল কাজ সম্পাদন করতে পারে।
ফলাফল:
মানুষের মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশই হাত ও চোখের সমন্বয়ের কাজে নিয়োজিত। এ কারণেই মানুষ হাতিয়ার বানাতে, যন্ত্র চালাতে ও নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারে।
প্রাইমেটদের থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার
হাত-চোখের সমন্বয় ব্যবস্থা আংশিকভাবে মানুষ তার পূর্বপুরুষ বৃক্ষবাসী প্রাইমেটদের কাছ থেকে পেয়েছিল।
- কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন ঘটেছে হাতিয়ার তৈরি ও শিকার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে।
- এই ক্রমাগত অনুশীলন ও প্রয়োগই মানুষের মস্তিষ্ককে আরও জটিল করেছে।
মস্তিষ্কের বিকাশ ও শিকার জীবন
শিকারী জীবনের প্রায় শেষ ২০ লক্ষ বছরে মানুষের (বা আধা–মানুষের) মস্তিষ্কের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
- হাতের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি
- জটিল জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা
—এই দুই মিলে মস্তিষ্ককে বড় হতে বাধ্য করেছিল।
হাতের ব্যবহার বনাম মুখের ব্যবহার
বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি প্রভৃতি প্রাণীরা খাদ্য খাওয়ার ক্ষেত্রে মূলত মুখ ও দাঁতের উপর নির্ভরশীল।
- শক্ত খাদ্য কামড়ে টুকরো করতে হয় বলে তাদের চোয়াল ও দাঁত বড় এবং শক্তিশালী।
- অপরদিকে আদিম মানুষরা হাতিয়ার ব্যবহার করে খাদ্য টুকরো করত।
- ফলে মুখের উপর চাপ কমে যায় এবং হাতের ব্যবহার বাড়তে থাকে।
এই পরিবর্তন শুধু খাওয়ার কৌশলই বদলালো না, বরং মানুষের শারীরবৃত্তীয় কাঠামোতেও পরিবর্তন আনল—চোয়াল ও দাঁতের আকার ছোট হতে শুরু করল, আর হাতের দক্ষতা বৃদ্ধি পেল।
চোয়াল ছোট হওয়া ও মস্তিষ্ক বড় হওয়া
মানুষের চোয়াল ক্রমশ ছোট হতে থাকায় মস্তিষ্ক বড় হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি হয়।
- আগুন ব্যবহারের মাধ্যমে রান্নার কৌশল আবিষ্কার করলে খাদ্য নরম হয়ে যায়।
- নরম খাদ্য খাওয়ার ফলে চোয়ালের কাজ কমতে থাকে, ফলে চোয়ালের আকার ছোট হয়।
- এর ফলেই মস্তিষ্কের আকার ক্রমশ বড় হতে থাকে।
অর্থাৎ শিকারী জীবনের সাথে সাথে রান্নার আবিষ্কারও মানুষের শারীরিক বিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
হাত ও মস্তিষ্কের পারস্পরিক বিকাশ
হাতের দক্ষ কাজ মানুষের মস্তিষ্ককে বাড়তে সাহায্য করেছে, আবার বড় ও উন্নত মস্তিষ্ক হাতের কাজের দক্ষতাকে আরও বাড়িয়েছে।
- হাত মস্তিষ্কের নির্দেশে কাজ করে।
- মস্তিষ্ক যত উন্নত হয়েছে, হাত তত জটিল হাতিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
এই পারস্পরিক সম্পর্ক মানুষকে প্রাণীজগতে অনন্য করে তুলেছে।
দলবদ্ধ শিকার ও ভাষার প্রয়োজন
শিকারী সমাজ যত অগ্রসর হয়েছে, ততই শিকার করতে গিয়ে সমন্বয় ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
- একটি বড় হাতি শিকার করতে হলে বহু মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার হতো।
- কে কোন দিক থেকে আক্রমণ করবে, কে কোন দিক থেকে তাড়া করবে—এসব নির্ধারণের জন্য ভাব বিনিময়ের ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়েছিল।
প্রথমে অঙ্গভঙ্গি ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে ভাব আদান-প্রদান হতো।
- আফ্রিকার অনেক শিকারীগোষ্ঠী এখনও শিকারের সময় ইঙ্গিত ব্যবহার করে।
- পরে অর্ধোচ্চারিত শব্দ যুক্ত হয়, যদিও তখনও চোয়াল বড় থাকায় শব্দ ছিল অস্পষ্ট।
চোয়াল ছোট হওয়ার সাথে সাথে মুখে জিভের নড়াচড়ার যথেষ্ট জায়গা তৈরি হয়, ফলে সুস্পষ্ট শব্দোচ্চারণ সম্ভব হয়।
- এর সাথে গলার বাকযন্ত্র ও কান-জিভের সমন্বয় ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে।
- কর্টেক্সের শ্রবণ কেন্দ্র ও ভাষা কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ স্নায়ুসূত্র এ সমন্বয় সহজ করে তোলে।
- ফলে মানবশিশু সহজে কথা শিখতে পারে।
আধা-মানুষ থেকে পূর্ণ মানুষ
মানুষ তার উৎপত্তির পর থেকেই কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকেনি, বরং নিজেদের সামাজিক কার্যকলাপ ও সৃজনশীল প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের দৈহিক বিবর্তন ঘটিয়েছে।
- তাই শারীরিকভাবে আধা-মানুষ হলেও সামাজিকভাবে তাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়।
- প্রাগৈতিহাসিক সমাজে আধা-মানুষরা যে সব কলাকৌশল, সামাজিক রীতি ও মানবিক সম্পর্ক প্রবর্তন করেছিল, তার অনেকগুলো আজও আধুনিক মানুষের মধ্যে টিকে আছে।
উপসংহার
প্রাগৈতিহাসিক আধা-মানুষদের জীবন ছিল মানুষের ইতিহাসের ভিত্তি।
- আমাদের মানবপ্রেম, সাম্যবোধ ও সহযোগিতার মতো চিরায়ত মূল্যবোধের সূচনা হয়েছিল তখনকার সমাজেই।
- অপরদিকে স্বার্থপরতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কুসংস্কারের মতো নেতিবাচক প্রবণতা এসেছে পরে, ঐতিহাসিক যুগে তথাকথিত সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে।
তাই “পুরান পাথর যুগের শিকারী সমাজ” শুধু আদিম হাতিয়ার, শিকার বা খাদ্যের গল্প নয়, বরং মানুষের মস্তিষ্ক, দেহ, সমাজ ও মূল্যবোধের আদিম ভিত্তি-গাঁথা। এখান থেকেই আধুনিক মানবসভ্যতার শেকড় গড়ে উঠেছিল।