আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচীন ভারতের নগর জীবন। পৌরাণিক বৈদিক বৌদ্ধ সাহিত্যে ও রামায়ণ , মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্য থেকে ভারতবর্ষে অবস্থিত জনপদ প্রভৃতির বিশাল তালিকা পাওয়া যায় । বিশেষত মানুষের আবাসভূমির নাম হল নগর ও জনপদ। প্রাচীনকালে কোন কোন গ্রাম আর নগর মিলে একটি জনপদ অর্থাৎ রাজ্যে পরিণত হত। সমস্ত জনপদের শাসনতন্ত্র করতো সেই সময়কার রাজারা। জনপদ গুলির পৃথক পৃথক রাজ্যের রাজা থাকতো তারা ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে এক রাজ্যের রাজা অন্য রাজ্যে আক্রমণ করে বিজয় লাভ করত এবং আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা প্রকাশ করত। ঠিক তেমনি কিছু প্রাচীন ভারতের নগর ও জনপদ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল।
প্রাচীন ভারতের নগর জীবন
প্রাচীন-ভারতের নগর জীবন
প্রায় অর্ধশতাব্দীরও কিছু পূর্বে ব্রিটিশভারতের (বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদাড়োতে এবং পাঞ্জাবে মন্টগোমারি জেলার হরপ্পাতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে যে ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়, তাতে জানা যায় যে মিশর, ব্যবিলনিয়া প্রভৃতি সভ্যতার সমসাময়িক এক ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা পাঁচ হাজার বছরেরও পূর্বে ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল।
এ ধ্বংসস্তূপের আবিষ্কার ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণা একেবারে পাল্টে দেয়। বৈদিক সভ্যতাকেই ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা বলে যে ধারণা এতদিন চলে এসেছিল, নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে তা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়।

সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠেছিল বলে এ সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয়। মাটির অভ্যন্তরে ধ্বংসস্তূপের স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করে যে কালপর্ব নির্ণয় করা হয়েছে তাতে অনুমান করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের মধ্যে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এ সভ্যতা ছিল মূলত নগরসভ্যতা।
কাঞ্চি:-
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর উত্তরে চেন্নাইয়ের খুবই কাছে অবস্থিত কাঞ্চি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রচিত পতঞ্জলির ভাষ্য গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে কাঞ্চির নাম। পল্লবদের রাজধানী ছিল এই শহর যা বর্তমানে কাঞ্চীপুরম নামে পরিচিত তবে এই শহরটি আজও বর্তমান।
মিথিলা :-
এই শহর নেপালের সীমান্তে অবস্থিত যার উত্তরে মুজাফরপুর ও দ্বারভাঙ্গা জেলায় মিলিত হয়েছে। রামায়ণের উল্লেখ অনুসারে নিমি নামে এক রাজা মিথিলার রাজবংশ পত্তন করেন। মিথিলার সকল রাজাদের বংশ কে জনক বংশ বলা হত। রামায়ণে উল্লেখ আছে যে সীতা মিথিলার এই ভূমি থেকেই তার পিতা জনকের হাতে উঠে এসেছিলেন। তবে বর্তমানে মিথিলায় ললিত নারায়ন নামে একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্গীসমা মন্দির রয়েছে।
কাশী:-
পুরাণ অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ বছর পূর্বে সুহােত্রপুত্র কাশ্য উক্ত নগরের পত্তন করেন। কাশী রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল তিনশাে যােজন পর্যন্ত। এর রাজধানী ছিল বারাণসী (বেনারস)।বারাণসী বিশ্বের প্রাচীনতম নগর । কাশ্যের নামানুসারে কাশী নামকরণ হয়। পরবর্তীকালে কাশীরাজ বারণা বারাণসী’ নামে এক দেবীর প্রতিষ্ঠা করলে কাশী ও বারাণসী এক হয়ে যায়। প্রাচীন যুগে কাশী ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। বরুণা ও অসি নদীর সংগমে হিন্দুদের এই স্থান দুটি একত্রিত হয়ে বারাণসী নামকরণ হয়। কাশীতে বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণাদেবীর মন্দির রয়েছে। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত সংস্কৃত কলেজ এবং ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় যা BHU নামে পরিচিত। দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বমহিমায় আজও বিরাজ করছে।
উজ্জয়িনী:-
এটি বর্তমানে মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতের মােড়শ মহাজনপদের মধ্যে অন্যতম অবম্ভীর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। মৌর্য শাসনের প্রাণকেন্দ্র ও বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। চম্বলের শাখা শিপ্রা নদীর তীরে মালভূমির উপত্যকায় উজ্জয়িনী অবস্থিত।‘মেঘদূত’ গীতিকাব্যে মহাকবি কালিদাস তাঁর এই নগরীর নাম উল্লেখ করেছেন।
রাজগৃহ:-
রাজগৃহ ষােড়শ মহাজনপদের অন্যতম প্রধান জনপদ । মহাভারতে দেখা যায় জরাসন্ধের রাজধানীর নাম ছিল গিরিব্রজ। পরবর্তীকালে মগধের রাজধানী রাজগৃহ, যা বর্তমানে নালন্দার নিকটবর্তী রাজগীর নামে পরিচিত (দক্ষিণ বিহারের পাটনা ও গয়া জেলা)। মহাকাব্য, পুরাণ এবং বৌদ্ধ-সাহিত্যে এর উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয় হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন-এর বর্ণনাতেও এই নগরের রাজগীরের শান্তি শতরূপা মন্দির উল্লেখ রয়েছে।
কপিলাবস্তু :-
গৌতম বুদ্ধের নাম জড়িয়ে আছে কপিলাবস্তু এই স্থানটির সঙ্গে । গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনি। এই স্থানটি কপিলাবস্তু থেকে ১৭ কিমি দূরে নেপালের তরাই অঞ্চলে অবস্থিত। স্থাপত্যের নিদর্শনরূপে অশােকের স্তম্ভলিপি রয়েছে এখানে। কপিলাবস্তু শাক্যদের রাজধানী ছিল। ভগবান বুদ্ধ এই শাক্যকুলে জন্মগ্রহণ করেন। পালি সাহিত্যে কপিলাবস্তু থেকে ভ্রমক্রমে নামটিকে কখনও কপিলাবস্তু বলা হয়েছে। এই নগর উত্তরপ্রদেশের বস্তী জেলার নিপ্ৰাহ্বা গ্রামে অবস্থিত । ফা-হিয়েন এই স্থান বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র বলে বর্ণনা করেছেন।
মথুরা:-
যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত যা ভারতের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র। কংসের গৃহে শ্রীকৃয়ের জন্মভূমিতে শাক্য রাজাদের আমলে গড়ে ওঠে প্রথম শ্রীকৃষ্ণুমন্দির। দ্বিতীয়বার চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের দ্বারা নির্মিত ১০১৭ খ্রিস্টাব্দের মন্দির গজনীর মামুদ ধ্বংস করেন। তৃতীয় মন্দিরটি মহারাজ বিজয় পালের নির্মিত ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার লােদি ধ্বংস করেন। চতুর্থ মন্দিরটি রাজা রাজাবীর সিংহের গড়া, ঔরঙ্গজেব ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি ধ্বংস করেন এবং ওই স্থানে তিনি নির্মাণ করেন।
শ্রাবস্তী:-
শ্রাবন্তী একটি ঐতিহাসিক স্থান । শ্রাবস্তী কোশলের রাজধানী ছিল ।কোশল রাজ্যের উত্তরে নেপালের পার্বত্য অঞ্চল, উত্তরপ্রদেশের গােন্ডা ও বহরাইচ জেলার সংযােগস্থলে অবস্থিত শ্রাবস্তী। রামায়ণে উল্লিখিত রাজধানী অযােধ্যা, এটি ছিল ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত। এটি ছিল প্রাচীনযুগের বিশিষ্ট বাণিজ্যকেন্দ্র, সেজন্য বৌদ্ধ ও জৈনগণ এই নগরে প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করেন। এই নগরের উপকণ্ঠে জেতবন বিহারে গৌতম বুদ্ধ দীর্ঘকাল অবস্থান করেছিলেন। মহাবীর ও এই শ্রাবন্তীতে এসেছিলেন।
বিদিশা :-
মধ্যপ্রদেশের বেত্রবতী ও বেশ নদীর সংগমস্থলে বিদিশা অবস্থিত। প্রাচীন বিদিশার নাম বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে ভিলসা’ হয়েছে। বিদিশা হল বেসনগরের পূর্বরূপ। পূর্বমালবের রাজধানী। মহাভারতের সময় এটি মহম্মদ গড় করদ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে অশােক ভিলসা ও সাঁচির স্তুপ পড়া করেন।
লঙ্কা:-
দক্ষিণ ভারতের সাগর পারে রাক্ষসরাজ রাবণের লঙ্কাপুরী অবস্থিত ছিলরামায়ণে উল্লিখিত, যা লকা নামে পরিচিত এবং পরবর্তীকালে সিংহল নামে পরিচিত হয়। যার আধুনিক নাম শ্রীলঙ্কা। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বীপটি রাষ্ট্রপে পরিগণিত হয় ।
মালব :-
বিন্ধ্যাচলের উত্তরে রাজস্থানের দক্ষিণে মধ্যভারতের অন্তর্গত মালভূমির নাম হল মালব। মালব বা মল্ল নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডারের মক্কায় অবস্থিত বুদ্ধ মন্দির সময় বসবাস করত। এই জাতি পরবর্তীকালে মালব ও দক্ষিণ মালাবার মালয়ালমে গিয়ে বসবাস করত।
মগধ:-
প্রাচীন মগধদেশ আধুনিক বিহারের দক্ষিণাংশে পাটনা-গয়া অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে হর্ষঙ্ক বংশীয় বিম্বিসার (আনুমানিক ৫৪৬-৪৯৪ খ্রিস্টপূর্ব) মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাজা বিম্বিসার গিরিব্রজের উপকণ্ঠে রাজগৃহ (রাজগীর) নগর স্থাপন করে সেখানে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মগধের নালন্দা ছিল জ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। কিন্তু কালক্রমে নালন্দা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
অযােধ্যা :-
মহাভারত অনুসারে এই থানটি ছিল পৌরাণিক রাজা ঋতুপর্ণের রাজধানী। অযােধ্যা এই নামটির মধ্যে বা স্থানটির মধ্যে ব্ৰত্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে নির্দেশ করে বলেই স্থানটির মধ্যে পবিত্রতা অনুভূত হয়। এই পবিত্র স্থানটি সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত। এর প্রাচীন নাম ছিল সাকেত। রামায়ণের কালে এটি ছিল দশরথাদি রাজাদের রাজধানী। পাঞ্জাবের ইরাবতী ও চন্দ্রভাগা নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে মদ্রদেশ অযােধ্যার প্রসিদ্ধ মন্দির অবস্থিত।
গান্ধার:-
গান্ধার বর্তমান পাকিস্তানের পেশােয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি অঞলে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ অব্দে পারসিক সম্রাট দায়ুস দ্বারা পর্বতে খােদিত গিরিলেখতে গান্ধার নাম উল্লেখিত হয়েছে। মহাভারতের গান্ধারী গান্ধারের রাজকন্যা ছিলেন এবং শকুনী ছিলেন গান্ধারের রাজপুত্র। পেশােয়ারের নিকট পুষ্করাবতী এবং রাওয়ালপিণ্ডির নিকট তক্ষশিলা গান্ধারের দুটি রাজধানী ছিল। কিন্তু অশােকের সময় তক্ষশিলা অঞ্চলটি সম্ভবত গারের অন্তর্গত ছিল না। বৌদ্ধ যুগে গান্ধারে সর্বপ্রথম বুদ্ধের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। গান্ধার শিল্প, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে রােমান শিল্পকলা দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
আরও দেখুন :