নব্য প্রস্তর যুগে ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে ধীরে ধীরে মানুষের স্থায়ী বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। এর সঙ্গে গড়ে ওঠে একের পর এক নগরী—উগারিত, আরাদুস, তারাব্লুস (ত্রিপলি), বেরিতুস (বৈরুত) এবং টায়ার। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ইতিহাসে কানানাইট নামে পরিচিত ছিলেন। সময়ের সাথে তারা তিনটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়—দক্ষিণে ফিলিস্তিনীয়, মাঝখানে হিব্রু এবং উত্তরে ফিনিশীয়। নিজেদের কেনানীয় পরিচয়ে গর্বিত এই ফিনিশীয়রা বিশ্বসভ্যতায় নতুন মাত্রা যোগ করে। শুধু বর্ণমালা উদ্ভাবন বা নৌ-বাণিজ্যে অগ্রগামী হওয়া নয়, তারাই প্রথম সার্থক উপনিবেশবাদের নজির স্থাপন করে।
ফিনিশীয় সভ্যতা
নামের উৎপত্তি ও প্রাচীন পরিচয়
ফিনিশীয় শব্দটি এসেছে গ্রিক Phoinikes থেকে, যার অর্থ বেগুনি রঙ। প্রাচীন ভূমধ্যসাগরে বিশেষ প্রজাতির শামুক ও খোলসযুক্ত মাছ থেকে এই বেগুনি রঙ আহরণ করা হতো, এবং যারা এ কাজে যুক্ত ছিল, গ্রিকরা তাদের বলত “বেগুনি বর্ণের মানুষ”। পরে, পূর্ব ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সেমিটিক গোষ্ঠীভুক্ত কানানাইটরা ফিনিশীয় নামে পরিচিত হয়।
সর্বপ্রথম এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায় গ্রিক মহাকবি হোমার-এর রচনায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে দক্ষিণ সিরিয়া, উত্তর ইসরায়েল ও লেবাননের উপকূলে তারা বসতি স্থাপন করে। তাদের আদি নিবাস ছিল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, যা অনেক গবেষক বর্তমান বাহরাইন বলে দাবি করেন।
ভৌগোলিক অবস্থান
ফিনিশিয়া ছিল সিরিয়ার উত্তরাংশে, সিরিয়া মরুভূমির পশ্চিমে, লেবানন পর্বতমালার পূর্ব ঢাল ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল অপ্রতুল, ফলে ফিনিশীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রপথে নতুন ভূমির সন্ধানে যাত্রা শুরু করে। ভৌগোলিকভাবে স্থলভাগে বিস্তার সম্ভব না হওয়ায়, তারা সমুদ্রকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা গড়ে তোলে। লেবানন পর্বতের প্রচুর সিডার গাছ তাদের উন্নত জাহাজ নির্মাণে সহায়ক হয়।
নৌ-বাণিজ্য ও নগররাষ্ট্র
ফিনিশীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষ জাহাজ নির্মাতা ও নাবিক হিসেবে পরিচিত ছিল। সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বন্দরসমূহ ফিনিশিয়াকে বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী করে তোলে। এর নগরীগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। ফিনিশিয়া কোনও একক ঐক্যবদ্ধ রাজ্য ছিল না; বরং এটি ছিল একাধিক স্বাধীন নগররাষ্ট্রের সমন্বিত এক সভ্যতা। এর মধ্যে টায়ার, সিডন এবং বিবলস (Byblos) ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রাজনৈতিক ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের পর ফিনিশীয় নগরীগুলো মিশরীয় ও হিট্টাইট শাসনের অধীনে আসে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে তারা স্বাধীনতা লাভ করে এবং টায়ার প্রধান নেতৃত্ব গ্রহণ করে।
টায়ারের রাজা প্রথম হিরাম (৯৬৯–৯৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সাইপ্রাস ও আফ্রিকায় একাধিক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময়ে টায়ার সিডন ও বিবলসের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং একটি শক্তিশালী বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
শীর্ষ বিকাশ ও পতন
টায়ারের নেতৃত্বে ফিনিশীয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ১০ম থেকে ৮ম শতাব্দীতে সর্বোচ্চ বিকাশ লাভ করে। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ফিনিশিয়া প্রথমে ক্যালডীয় এবং পরে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। অবশেষে ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট টায়ার অবরোধ করে ধ্বংস করে দেন।
ফিনিশীয় সভ্যতার সাধারণ পরিচয়
ফিনিশিয়ার প্রধান ফসল ছিল শস্য ও আঙুর। কৃষি বা শ্রমশিল্পে এখানে দাসশ্রমের ব্যাপক ব্যবহার ছিল না, এবং দাস নিয়োগের প্রচলনও তুলনামূলকভাবে নগণ্য ছিল। শহরের অধিবাসীরা মূলত শিল্পকর্ম ও ব্যবসায়ে যুক্ত ছিল।
ফিনিশীয়রা মদ, কাঠ এবং দক্ষ কারিগরের তৈরি নানান দ্রব্য রপ্তানি করত।
প্রাচীন বিশ্বে ফিনিশীয়রা বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল—
- সূক্ষ্ম কাঁচের সামগ্রী
- উন্নত ধাতব শিল্প
- বিরল রক্ত–বেগুনি রঙ (শামুক থেকে আহরিত), যা রাজা ও অভিজাতদের পোশাক রঙ করার জন্য বহুল ব্যবহৃত হত
তারা এক দেশ থেকে পণ্য কিনে অন্য দেশে বিক্রি করত, দক্ষ ভূগোলবিদ ও নৌ–নাবিক হিসেবে পরিচিত ছিল, এবং প্রয়োজনের তাগিদে ঈজিয়ান ও ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করত। তারাই সর্বপ্রথম জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে।
উপনিবেশ স্থাপন
যেখানে মূল্যবান পণ্যের সরবরাহের সম্ভাবনা ছিল, ফিনিশীয়রা সেখানে কলোনি বা উপনিবেশ স্থাপন করত। উল্লেখযোগ্য উপনিবেশগুলো হলো—
- ঈজিয়ান সাগরের রোডস ও অন্যান্য দ্বীপ
- ভূমধ্যসাগরের সাইপ্রাস, মাল্টা, সিসিলি
- আফ্রিকার উত্তর উপকূলে কার্থেজ (যা পরে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয়)
- স্পেনের বিভিন্ন বন্দরনগর
একদল ফিনিশীয় আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করেছিল বলেও কথিত আছে। নৌচালনায় তাদের এমন দক্ষতা ছিল যে, তারা নক্ষত্র দেখে রাত্রিকালেও জাহাজ চালাতে পারত। এ কারণে প্রাচীন বিশ্বে “ফিনিশীয় তারা” বলতে ধ্রুবতারাকে বোঝানো হতো। নৌবিদ্যায় পারদর্শিতার জন্য অনেক প্রাচীন রাজা তাদের জাহাজ ও নাবিক নিয়োগ করতেন।
বিকাশের সামাজিক কারণ
ব্রোঞ্জ যুগের শেষে লোহার আবিষ্কার মানবসভ্যতার বিকাশে নতুন দ্বার উন্মোচন করলেও, কেবল সেসব জাতি এর সুফল ভোগ করতে পেরেছিল যাদের হাতে ছিল সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুযোগ। মিশর ও মেসোপটেমিয়ায় উৎপাদন পদ্ধতি এতটাই গেঁথে গিয়েছিল যে নতুন প্রযুক্তি বিশেষ পরিবর্তন আনতে পারেনি।
ডোরিয়ান আক্রমণে ক্রীট ও মাইসিনির বাণিজ্যের ক্ষতি হলে ফিনিশীয় নগরসমূহ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধি লাভ করে।
ফিনিশিয়া সভ্যতার বাণিজ্যিক কার্যকলাপ
প্রাচীন যুগে ফিনিশিয়া তার বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। এ অঞ্চলে প্রাচুর্য ছিল বনজ সম্পদের, এবং এর অবস্থান ছিল উত্তর আরব, মধ্য প্যালেস্টাইন ও দক্ষিণ সিরিয়া থেকে আগত স্থল-বাণিজ্যপথগুলোর সংযোগস্থলে।
ব্রোঞ্জ যুগে মিশরের সঙ্গে যে উপকূলীয় বাণিজ্য চলত, তা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে আবার সক্রিয় হয়। এ সময়ে টায়ার ও সিডন-এ উত্তর ও দক্ষিণমুখী যমজ বন্দর স্থাপন হওয়ায় সামুদ্রিক বাণিজ্য আরও প্রসারিত হয়। বিবলস নগরেও ছিল একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।
ফিনিশিয়ার মূল ভূখণ্ডের উত্তরে আরাডাস (আরভাদ) নামক ক্ষুদ্র দ্বীপ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরদ্বীপ, যা ঈজিয়ান ও দক্ষিণ আনাতোলিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের ওপর অবস্থিত ছিল। টায়ার ও আরভাদ—দুটিই ছিল শক্তিশালী দুর্গনগর, যা আক্রমণ প্রতিরোধে দুর্ভেদ্য ছিল।

আরও দেখুন :