আজকে আমরা আলোচনা করবো বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন নিয়ে। বলা হয়ে থাকে বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন পৃথিবীর সকল জাতিতে এবং সকল কালে বজায় আছে। অর্থাৎ সমাজের মানুষের মধ্যে সকল সমাজেই বয়সের ভাগ আছে। সাধারণভাবে এই ভাগ হচ্ছে: অপ্রাপ্ত বয়স্ক, বয়স্ক এবং বয়োবৃদ্ধ। কিন্তু সকল জাতি আর সকল কালে এই বিভাজনের মানে কোনমতেই এক নয়।
সাধারণভাবে নৃবিজ্ঞানের আলাপ-আলোচনায় অ-ইউরোপীয় সমাজের বয়স বিভাজন বেশি করে । প্রধানত আফ্রিকা, আমেরিকার আদিবাসী জাতিসমূহ নিয়ে মনোযোগ দেয়া হয়েছে। অনেক জাতির মধ্যে বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। একে বলা হয় বয়স বৰ্গ (age grade)। এক একটি বর্গে সকল সদস্যরা একটি বয়স সীমার মধ্যে হয়ে থাকেন। এই বর্গে ঢুকতে পারাটা প্রায় ক্ষেত্রেই কোন বিশেষ প্রক্রিয়ার ব্যাপার নয়।
বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন
কোন একজন একটা নির্দিষ্ট বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার মানে তিনি আপনা আপনিই সেই বয়সের নির্দিষ্ট বর্গের সদস্য হয়ে যাবেন। যেমন : পূর্ব আফ্রিকার তিরিকি জাতির মধ্যে। তবে এসব ক্ষেত্রে কোন কোন জাতির মধ্যে নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠানের রেওয়াজ আছে। যেমন: উত্তর-আমেরিকার অনেক আদিবাসী জাতিসমূহের মধ্যে কোন কিশোর তার বয়স বর্গে ঢুকতে চাইলে অবশ্যই কিছু প্রথা মেনে নিতে হবে। তার নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে, আর নাচ-গানে অংশ নিতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ মন উল্লেখ পাওয়া যায় যে নির্দিষ্ট বয়স বর্গে প্রবেশ করবার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে বেশ খরচ হয়। ফলে সমাজের কোন কোন সদস্যের পক্ষে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢোকা সম্ভব হয় না ।
নির্দিষ্ট বয়স বর্গে ঢুকবার জন্য কতকগুলি ব্যক্তিগত অর্জন থাকতে পারে। সেটা জৈবিক হতে পারে যেমন সাবালগ হওয়া, আবার সামাজিক হতে পারে – যেমন বিয়ে করা, বা বাচ্চা জন্মানো। বয়স বর্গের সদস্যদের অনেক কিছুই এক রকম হতে পারে, তাঁদের কাজ-কর্ম এক ধরনের হতে পারে, পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক থাকতে পারে, এমনকি একই ধরনের উদ্যম ও আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে কিন্তু একই বর্গের সদস্যদের বয়স আক্ষরিক অর্থে এক নয়, একটা সীমার মধ্যে তাঁদের বয়স। বয়স বৰ্গ (age grade)-এর পাশাপাশি আরেকটি ধারণা নৃবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়েছে।

সেটা হচ্ছে বয়স সেট (age set)। বয়স সেট বলতে বোঝানো হয়ে থাকে এমন একটা সামাজিক সংগঠন যেখানে একদল মানুষ সম-বয়সের এবং একই লিঙ্গের হয়ে থাকেন এবং সারা জীবন কিংবা জীবনের একটা বড় সময় একই সঙ্গে অতিবাহন করেন। যেমন: পূর্ব আফ্রিকার তিরিকিদের মধ্যে একটা বয়স বর্গের সেই সব সদস্য যাঁরা ১৫ বছরের মত একত্রে কাটিয়েছেন তাঁদেরকে একটা বয়স সেটে গণ্য করা হয়। অনেকেই এটাকে বয়স বর্গের একটা অংশ হিসেবে দেখেছেন। কারণ বয়স সেটের সদস্যরা সকলে একই বয়স বর্গের হয়ে থাকেন। তবে একটা সাধারণ পার্থক্য হচ্ছে বয়স সেট সাধারণত একই লিঙ্গের সদস্যদের দ্বারা গঠিত।
আর এর সদস্যরা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট থেকে যান সারা জীবন বা জীবনের বড় একটা সময়। তবে কোন কোন নৃবিজ্ঞানীর মতে এই ধরনের বয়স সেট বয়স বর্গের তুলনায় ক্ষমতার বিচারে স্বতন্ত্র। অনেক সমাজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নেতৃত্ব দেবার ব্যাপারে এই ধরনের বয়স সেট হস্তক্ষেপ করতে পারে। কোন কোন সমাজে বয়স সেট জ্ঞাতি সম্পর্কের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এই ব্যাপারটা সাধারণ বয়স বর্গের থেকে একেবারেই ভিন্ন। বয়স বর্গের ব্যাপারটা ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে যখন এর সদস্যরা বয়স্ক হতে থাকেন ।
কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সাধারণত এক বর্গের সদস্যরা অন্য বর্গে প্রবেশ করেন। বয়স্কবর্গের লোকজন সাধারণত স্পষ্টভাবেই নিজেদের আলাদা মনে করে থাকেন, এবং একই সঙ্গে তাঁরা কিছু দায়িত্বও বোধ করে থাকেন তাঁদের ‘কনিষ্ঠদের প্রতি – কিন্তু এর – মানে এই নয় যে বয়স্করা কিংবা বয়োকনিষ্ঠরা কেউ কারো বর্গের চেয়ে ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’। নৃবিজ্ঞানীরা যে সকল সমাজকে সরল সমাজ বলেছেন সেখানকার বয়স বিভাজন সম্পর্কে এই রকম ব্যাখ্যাই অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, কোন একটা বয়সের বর্গকে ভাল বা মন্দ ভাবা আধুনিক কালের এবং আধুনিক সমাজে সৃষ্টি হয়েছে।
অ-ইউরোপীয় সমাজে এই বর্গগুলো দিয়ে সমাজের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য ভাগাভাগি করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে কোন বর্গকে খাটো করে দেখা হয়নি। তবে কোথাও কোথাও বয়স ভিত্তিক দলের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক এবং সামরিক দায়-দায়িত্ব দেয়া থাকে। যেমন: পূর্ব আফ্রিকার কারিমোজোং, মাসাই এবং নান্দী জাতি। এখানে দুই একটা সমাজের উদাহরণ ধরে বয়স ভিত্তিক বিভাজনের চর্চা দেখা যেতে পারে।
বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন অধ্যায়ের- সারাংশ – যা বয়সের- ভিত্তিতে বিভাজন এর অর্ন্তভুক্ত, বিশেষত ইউরোপের বাইরের সমাজে বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়সের- ভিত্তিতে সমাজের মানুষজনের মধ্যে ভাগ করা হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট একটা বয়সের সদস্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে।
বয়স্ক মানুষজনের প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি থাকে এবং তাঁরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ নিয়ে থাকেন। তবে সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্যকে খেয়াল রাখা দরকার। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে,শহুরে সমাজে বয়সের -ভিত্তিতে মান-মর্যাদার ভেদবিচার নেই। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। বরং, এই সমাজে পেশাগত মর্যাদার ক্ষেত্রে অল্প বয়সীদের গুরুত্ব কম দেয়া হয়। একই সঙ্গে বয়স্ক অবসরপ্রাপ্তদের নানারকম অবহেলার শিকার হতে হয়।
আরও দেখুনঃ