বিবর্তনবাদের সমালোচনা

আজকের আলোচনার বিষয় বিবর্তনবাদের সমালোচনা – যা পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ তত্ত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবর্তনবাদী তত্ত্ব সমালোচিত হয়েছে। ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছে “আর্মচেয়ার নৃবিজ্ঞান”। তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে, বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে নৃবিজ্ঞানের হতে হবে মাঠ-গবেষণা ভিত্তিক। বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন মানুষ দ্বারা (ঔপনিবেশিক সরকারের কর্মকর্তা, ধর্ম যাজক, ভ্রমণকারী), বিভিন্ন উপায়ে জড়ো করা তথ্য, এবং অনেকাংশেই কল্পনা-প্রসূত তথ্য, নৃবিজ্ঞানের কাঙ্ক্ষিত বৈজ্ঞানিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। বিবর্তনবাদের আরো মৌলিক সমালোচনা দাঁড় করিয়েছেন ঔপনিবেশিকতা বিরোধী নৃবিজ্ঞানীরা, নব্য মার্ক্সবাদীরা, এবং নারীবাদী নৃবিজ্ঞানীরা।

এঁদের সমালোচনাগুলোকে জড়ো করলে প্রধান যে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে, তা হ’ল, এই তত্ত্বের পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং এর মতাদর্শিক চেহারা। এই দুটো বিষয় আন্তঃসম্পর্কিত। দৈহিক নৃবিজ্ঞান যেভাবে বানর হতে মানুষে দৈহিক বিবর্তনের লুপ্ত ধাপগুলি অনুসন্ধান করতে থাকে, ঠিক একইভাবে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা লুপ্ত সাংস্কৃতিক ধাপগুলো অনুসন্ধান করতে থাকে।

 

বিবর্তনবাদের সমালোচনা

 

বিবর্তনবাদের সমালোচনা

এই ধাপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে, বিবর্তনবাদীরা সমসাময়িক ইউরোপীয় এবং অ-ইউরোপীয় সমাজ হতে প্রাপ্ত তথ্যকে “নিচু” থেকে “উঁচু” মানদন্ডে ক্রমান্বয়ে সাজান। তাঁদের পূর্বানুমান ছিল: সমসাময়িক অ-ইউরোপীয় সমাজ যদিও বর্তমান তবুও এটি মানব সভ্যতার একটি পূর্বতন, হারিয়ে যাওয়া অতীতকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই অনুমান সম্ভব হয়েছিল, সমালোচকদের মতে, কারণ বিবর্তনবাদীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, সমসাময়িক ইউরোপীয়রা, এবং তাদের সমাজিক প্রতিষ্ঠানাদি, বিবর্তনের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেছে। সেই অর্থে, বিবর্তনবাদী তত্ত্ব ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধের নামান্তর।

বিবর্তনবাদ মানব বিবর্তনের একটি বিশ্বজনীন তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। যদিও এঙ্গেলস সমসাময়িক বুর্জোয়া-শাসিত সমাজের কট্টর সমালোচক ছিলেন এবং সম্প্রতিক সমালোচকরা যে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল তাদের সমালোচনার বিষয় হচ্ছে এঙ্গেলসের অনুসৃত পদ্ধতি।

বর্তমানের সমালোচকরা বলেন, দৈহিক বিবর্তনবাদীদের যুক্তি মেনে নিলেও – যে বিশ্বের সকল মানুষ – একই প্রক্রিয়ায় বানর হতে মানুষে বিবর্তিত হয়েছে – সেই যুক্তি সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রয়োগ করা হলে – সেটা মেনে নেয়া কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, কি যুক্তিতে আমরা মেনে নিতে পারি যে পৃথিবীর সকল সমাজে বিবাহের অর্থ এক এবং অভিন্ন? তথ্যগত ভুল-ভালও রয়েছে। যেমন ধরুন মর্গানের তত্ত্ব মতে, নির্বিচার যৌন সম্পর্ক ছিল আদি অবস্থার বৈশিষ্ট্য।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই অবস্থান থেকে উত্তরণ ঘটে ভাই-বোন বিয়ের মাধ্যমে। ভাই-বোন বিয়ের প্রমাণাদি তিনি পান হাওয়াই সমাজে যেখানে সকল চাচা, মামা, ফুপা এবং খালুদের একই নামে সম্বোধন করা হ’ত, বোনদের ক্ষেত্রেও তাই। এ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ভাই-বোনদের মধ্যে নিশ্চয়ই বিয়ের প্রচলন ছিল এবং সে কারণেই “পিতা” ও “চাচা”কে পৃথক করার মত কোন শব্দের উদ্ভব হয়নি। সমালোচকেরা বলেন, এই যুক্তি নড়-বড়ে। আর যদিও বা এটি হাওয়াই সমাজের ক্ষেত্রে সত্য হয়ে থাকে, আমরা কেন ধরে নেব যে এই প্রচলন বিশ্বের সকল সমাজের জন্য প্রযোজ্য?

হাল-আমলের সমালোচকদের মতে, এঙ্গেলস মর্গানের নড়বড়ে পদ্ধতি গ্রহণ করে পরিবারের পরিবর্তনের যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-বিরুদ্ধ। মর্গানের পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে তিনি প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমরূপ করে ফেলেছেন। এটি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতির লঙ্ঘন।

মর্গানের কল্যাণে এঙ্গেলসের কাজে আরো কিছু তথ্যগত ভ্রান্তি দেখা গেছে। নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে আমরা জানতে পারি যে, ব্যক্তিমালিকানা বিহীন সমাজেও একপতিপত্নী বিবাহের প্রচলন রয়েছে। আর কেনই বা জৈবিক পিতৃত্বের সম্পর্ক নিশ্চিত করা আবশ্যিক হয়ে পড়বে সম্পদের আবির্ভাবের সাথে? এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে সমালোচকদের প্রধান অভিযোগ হ’ল, শ্রেণী এবং লিঙ্গীয় অসমতার গাঁথা একইসূত্রে গাঁথতে যেয়ে তিনি লিঙ্গীয় বৈষম্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উদঘাটনের রাস্তা কঠিন করে তুলেছেন।

 

বিবর্তনবাদের সমালোচনা

 

এতসব সমালোচনা এবং অভিযোগ সত্ত্বেও, নারীবাদীরা এঙ্গেলসের তত্ত্বকে গুরুত্ব দেন। সেটির কারণ হচ্ছে, এঙ্গেলসের প্রধান বক্তব্য: নারী অধস্তনতা স্বাভাবিক কিংবা প্রাকৃতিক কিংবা ঈশ্বর-প্রদত্ত নয়। এটি সামাজিক, এটি ঐতিহাসিক, এবং বদলযোগ্য।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment