ভারতবর্ষে জাতিবর্ণ প্রথা

আজকের আলোচনার বিষয় ভারতবর্ষে জাতিবর্ণ প্রথা – যা  শ্রেণী ও জাতিবর্ণ স্তরবিভাজ এর অর্ন্তভুক্ত, এই অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে এক ধরনের ভেদাভেদ প্রথার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থাতে বিশ্বাস করা হয় কোন মানুষ জন্মের সময়ই তাঁর সামাজিক অবস্থান নিয়ে আসেন। আর সেই অবস্থানটা বদলানো যায় না। এই বিশ্বাসের সাথে ধর্মীয় কিছু ব্যাখ্যাও প্রচলিত আছে। কিন্তু ভেদাভেদটা কেবল বিশ্বাসের নয়, সামাজিক অনুশীলনেও তা দেখা যায়। এটাকে নৃবিজ্ঞানীরা জাতিবর্ণ (caste) বলেছেন। কারো কারো মতে এটা সাব-কাস্ট (sub-caste)।

ভারতবর্ষে জাতিবর্ণ প্রথা

 

ভারতবর্ষে জাতিবর্ণ প্রথা

 

লেখাপড়ার জগতে এটাকে জাতিবর্ণ বলা হলেও সমাজে চলতি ভাষায় মানুষজন একে ‘জাত’ শব্দ দিয়ে বুঝিয়ে থাকেন। অনেক নৃবিজ্ঞানীই মনে করেছেন এই বিশেষ ধরনের ভেদাভেদ ব্যবস্থা কেবল ভারতের সমাজেই আছে। এঁদের মধ্যে নাম বলা যায় লুই ডুমোর কথা। প্রত্যেকটি জাতিবর্ণ একটির থেকে আরেকটি ক্রমোচ্চভাবে সাজানো। এর মানে হ’ল সমাজের প্রত্যেক সদস্যেরই জাতিবর্ণের ভিত্তিতে একটা নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থান থাকে। নিচু জাতিবর্ণের লোকজন উঁচু জাতিবর্ণের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবেন না। অন্তত, অনেকগুলি সামাজিক বিধিনিষেধ আছে।

প্রধান বিধিনিষেধ হচ্ছে বিয়ে এবং খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে। যে সব জাতিবর্ণকে উঁচু বলে ধরে নেয়া হয় তার সদস্যরা ‘নিচু’দের সঙ্গে একত্রে খাবেন না। আর বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন না। একটা জাতিবর্ণের সদস্যরা কেবল নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করতে পারবেন · অর্থাৎ অন্তর্বিবাহ – ব্যবস্থা। কিন্তু বিয়ে এবং খাবার-দাবারের মধ্যেই এই ভেদাভেদ সীমিত নয়। সামাজিকভাবে অনেক ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন নিচু জাতিবর্ণের লোকজন। একটা চর্চা আছে ছোঁয়া-ছুঁই নিয়ে। “উঁচু’ মানুষজন ‘নিচু’ মানুষজনের শারীরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন। এক্ষেত্রে ধারণা করা হয় নিচু বর্ণের সংস্পর্শে উঁচু অপবিত্র হয়ে যাবেন। এর সামাজিক নাম হচ্ছে ‘জাত যাওয়া’। সুতরাং, বিয়ে বা খাদ্যগ্রহণে আপত্তির ভিত্তি হিসেবে এটাকে দেখা যায়।

নৃবিজ্ঞানীরা এটাকে শুচিতার ধারণা বলেছেন। শুচিতা-অশুচিতা কিংবা পবিত্রতা-অপবিত্রতা যাই বলি না কেন এর একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয় ধর্মগ্রন্থ থেকে। হিন্দু (সনাতন) ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ বেদ-এ চতুর্বর্ণ বা চারটি বর্ণের কথা উল্লেখ আছে। এগুলো হচ্ছে: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। এখানে ব্রাহ্মণকে সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং শূদ্রকে সবচেয়ে মর্যাদাহীন হিসেবে ব্যাখ্যা করা আছে। অন্য বর্ণ দুটিরও মর্যাদা নির্দিষ্ট করা আছে: –

ব্রাহ্মণ -> ক্ষত্রিয় -> বৈশ্য -> শূদ্র

অনেক গবেষকই জাতিবর্ণ প্রথা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বেদ-এ বর্ণিত চার বর্ণের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু বাস্তবে সমাজে ঠিক এইভাবে চারটি বর্ণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যেমন: বাংলা অঞ্চলে ] ব্রাহ্মণ পাওয়া গেলেও বৈশ্য বা শূদ্রের একক অখন্ড কোন রূপ পাওয়া যায় না। বরং অনেক ধরনের বিভাজন পাওয়া যায় যাঁরা পরস্পরের থেকে আলাদা মনে করেন নিজেদের এবং সামাজিক নিয়ম- | কানুনও সেভাবে গঠিত। বিয়ে-শাদী এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের বেলায় ভেদাভেদ প্রক্রিয়াটা কাজ করে থাকে। ক্ষত্রিয় বলতে এই অঞ্চলে তেমন কোন বর্ণ কখনোই ছিল না।

প্রায় একশ’ বছর আগে উত্তর | বাংলার একটা অংশ নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে ঘোষণা দেন। সেই ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয়দের অনেক পার্থক্য। বাংলা অঞ্চল হতে নিজেদের ক্ষত্রিয় ঘোষণা দেয়া এই পদক্ষেপকে বর্ণব্যবস্থার অবিচারের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হিসেবেও দেখা সম্ভব।

আবার বাংলা অঞ্চলে ব্রাহ্মণরাও কোন একটা নির্দিষ্ট বর্গ নন। পরস্পরের সাথে নানা সামাজিক দূরত্ব তাঁরা বোধ করেন এবং সেগুলো চর্চা করেন। কায়স্থ বলে একটা জাতিবর্ণ বিশেষভাবে বাংলা অঞ্চলেই দেখা যায়। এই ধরনের কোন নাম ভারতবর্ষের অন্য কোথাও দেখা যায় না। বস্তুত, ভারত বর্ষের সকল স্থানে নানাবিধ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় এবং এক অঞ্চলের জাতিবর্ণ ভেদাভেদ অন্য অঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। এক কথায় যত সরলভাবে জাতিবর্ণ-এর চার ভাগের কথা বলা হয় তত সরলরূপে সেটি সমাজে পাওয়া যায় না, নানাবিধ বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। এই পরিস্থিতি সামলাতে গিয়েই কোন কোন গবেষক sub-caste ধারণা ব্যবহার করেছেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অনেক গবেষকই জাতিবর্ণ প্রথাকে প্রাচীন ভারতের শ্রম বিভাজন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ, সমাজে কার কি কাজ এবং উৎপাদন কাজে কার কি অংশগ্রহণ হবে তার ব্যবস্থা এই জাতিবর্ণ। এই ব্যাখ্যার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। বেদের ব্যাখ্যানুযায়ী ব্রাহ্মণ হবেন জ্ঞানী, ক্ষত্রিয় যোদ্ধা, বৈশ্য ব্যবসায়ী এবং শূদ্র মজুর বা কায়িক শ্রমিক।

ঠিক এরকম চারটি ভাগে ঐতিহাসিক দলিল না পাওয়া গেলেও এটা লক্ষ্য করা গেছে যে ভারতবর্ষের সমাজে জাতিবর্ণের সঙ্গে পেশার একটা যোগাযোগ ছিল। কিছুকাল আগে পর্যন্তও অনেক নজির পাওয়া গেছে যেখানে কোন একটি জাতিবর্ণের সদস্যরা বংশানুক্রমিকভাবে একটা নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত আছেন। যেমন: নাপিত, জেলে, কুমার, কামার, তাঁতী ইত্যাদি। এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখা দরকার, সাধারণভাবে ‘উঁচু জাতিবর্ণের সদস্যরা আর্থিক ভাবেও স্বচ্ছল।

পেশার দিক থেকে জাতিবর্ণের এই বিভাজন সমাজের অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে বর্তমান বাজারের প্রসারের আগে সেটা বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। বিভিন্ন পেশার (নাপিত, কামার, কুমার ইত্যাদি) মানুষজন স্বচ্ছল গেরস্তদেরকে নিজেদের পেশার কাজ করে দিতেন। বিনিময়ে ফসল পেতেন। এই ধরনের আদান-প্রদানের নাম দেয়া হয়েছে যজমানি ব্যবস্থা। ব্রিটিশরা আসার পর বাজার ব্যবস্থার প্রসার ঘটে এবং বিভিন্ন শ্রমিক পেশার মানুষজন নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য বাজারে বিক্রির চেষ্টা করেন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাতিবর্ণ ভিত্তিক উপাধিও দেখা যায়। অর্থাৎ নামের শেষে যে অংশ ব্যবহার করা হয় সেটা দিয়েই জাতিবর্ণের অনুমান করা সম্ভব হয়। বাংলা অঞ্চলে সবচেয়ে সহজে বোঝা যায় ব্রাহ্মণদের পরিচয়। কতগুলি পরিচিত উপাধি হচ্ছে: ভট্টাচার্য্য, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, চক্রবর্তী ইত্যাদি। যেহেতু ‘নিচু’ জাতিবর্ণের নির্দিষ্ট পেশার প্রচলন ছিল – তাই উপাধি – দেখে তাঁদের বেলায় পেশাও বোঝাত অনেক ক্ষেত্রে। তবে নামের সঙ্গে উপাধি জুড়ে দেবার এই চল ব্রিটিশরা এখানে আসার আগে একই রকম ছিল না।

আর্থনীতিক বিরাট বদলের মধ্য দিয়ে বর্তমান কালে পেশার এই ব্যাপারগুলো আর আগের মত নেই। যেমন: নাপিতদের সাবেক পেশায় এখন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের জাতিবর্ণ ‘নাপিত’ নয়, এমনকি অনেকে হিন্দু ধর্মের বাইরে। কাপড়ের কলে আর জাতিবর্ণ হিসেবে ‘তাঁতী’রা কাজ করছেন না। ফলে নানা ধরনের পেশায় এসব জাতিবর্ণের সদস্যরা যাবার চেষ্টা করছেন। ‘উচ্চবর্ণ’ হিন্দুদের স্বচ্ছলতার কারণে ব্রিটিশ কালে তাঁরা শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছেন সাধারণভাবে।

জাতিবর্ণ ভেদাভেদের এই প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবেই নিপীড়নমূলক। নিপীড়নের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন সমাজের একেবারে নিচে যাঁদের ভাবা হয়। এই ব্যবস্থার বিপক্ষে ‘নিবর্ণ’ হিন্দুরা নানা সময়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। কখনো কখনো উচ্চবর্ণের কিছু সদস্য এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। এখানে দুইজনের নাম উল্লেখ করা যায়: মহাত্মা গান্ধী এবং স্বামী বিবেকানন্দ।

 

ভারতবর্ষে জাতিবর্ণ প্রথা

 

বিশেষভাবে ভারতে নিবর্ণ হিন্দু আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ সেখানে সমতল বাংলার চেয়ে অনেক আক্রমণাত্মক ধরনের ভেদাভেদ রয়েছে। ‘অস্পৃশ্য’ বলে একটা বর্গ আছেন যাঁর সদস্যরা নিপীড়নের চরম সীমায় বসবাস করেন। কিন্তু বড়মাপের কোন পরিবর্তন এখনো লক্ষ্য করা যায় না। কয়েক বছর আগে চাকুরিতে নিবর্ণ হিন্দুদের কিছু সুবিধা দেবার চেষ্টা যখন সরকার করেছে – তখন ব্রাহ্মণ সহ অন্যান্য তুলনামূলক উচ্চবর্ণ হিন্দুরা সারা দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে আস্ফালন শুরু করে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment