আজকে আমাদের আলোচনা রাখাইন জনগোষ্ঠী সাধারণ পরিচিতি নিয়ে। রাখাইনরা হচ্ছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত একটি জনগোষ্ঠী। পটুয়াখালী, বরগুনা ও কক্সবাজার জেলাসমূহে রাখাইন জনপদ রয়েছে। কক্সবাজার জেলায় সদর এলাকা ছাড়া মহেশখালী, রামু, টেকনাফ প্রভৃতি অঞ্চলে তাদের বসতি রয়েছে। রাখাইনদের কিছু অংশ বান্দরবানেও দেখা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘মারমা’ নামে পরিচিত জনগোষ্ঠীর সাথে রাখাইনদের ঘনিষ্ঠ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিল তথা ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে। বাস্তবে অবশ্য মারমা ও রাখাইনরা আলাদা দুটি সম্প্রদায় হিসাবেই বিবেচিত হয়, যদিও এই বিভাজনের কারণ ভৌগোলিক দূরত্ব নাকি অন্য কোন কারণ, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা বইপত্রে চোখে পড়ে না।
রাখাইন জনগোষ্ঠী সাধারণ পরিচিতি
রাখাইনদের অনেকে একসময় “মারমা” হিসাবেও নিজেদের পরিচয় দিত বলে জানা যায়, যদিও সাম্প্রতিককালে তারা শুধু রাখাইন পরিচয়ই ব্যবহার করে। পক্ষান্তরে মারমারা কোনকালে রাখাইন পরিচয় ব্যবহার করেছে, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাখাইন শব্দটি ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘আরাকান’-এর সাথে সম্পর্কিত, পক্ষান্তরে ‘মারমা” শব্দটি সম্পর্কিত ‘বার্মা’ বা ‘মায়ানমার’-এর সাথে।
অর্থাৎ এই নাম দুইটি যথাক্রমে আরাকান ও মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক নির্দেশ করে। (রাখাইন শব্দটি বাংলায় ‘রাক্ষাইন’ হিসাবেও অনেকে লিখে থাকেন এবং এটিকে বিভিন্ন সংস্কৃত বা পালি শব্দের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস চোখে পড়ে, তবে এ ধরনের ব্যাখ্যার কোন যথাযথ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।) আরাকান বর্তমানে বার্মার একটি প্রদেশ হলেও একসময় তা ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। রাখাইনরা মনে করেন, আরাকান রাজ্য বার্মা কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের পূর্বসূরীরা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল। এভাবে নিজেদের ইতিহাসকে কারা কিভাবে মনে রেখেছে বা দেখছে, তার উপর নির্ভর করেই সম্ভবতঃ মারমা ও রাখাইনদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে উঠেছে।

বাঙালীদের কাছে অবশ্য রাখাইন তথা মারমারা “মগ” বলেই বেশী পরিচিত ছিল বেশ আগে থেকে। বাংলা ভাষায় ‘মগের মুল্লুক’ কথার অর্থই বলে দেয় কেন এই অভিধা রাখাইন বা মারমাদের কাছে আপত্তিকর হবে। ইতিহাসের পাঠ্যবইয়েও আমরা মগ (অর্থাৎ আরকানী) জলদস্যুদের কথা পড়ি। এসব জেনেশুনেই সমকালীন রাখাইন বা মারমাদের কেউকে ‘মগ” নামে সম্বোধন করলে তা হবে নিঃসন্দেহে অপমানসূচক।
এককালে সরকারী নথিপত্রে রাখাইন বা মারমাদের অনেকের নামের পেছনে অন্যরা “মগ” পদবী জুড়ে দিয়েছিল বটে, তবে সাম্প্রতিককালে এই আরোপিত পরিচিতি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে। (উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের বাঙালী বৌদ্ধ বা বড়ুয়াদেরও এককালে ‘বড়ুয়া মগ’ নামে অভিহিত করা হত। এমনকি নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা এখনো গালি হিসাবে চট্টগ্রামের মানুষদের ‘মগ’ বলে সম্বোধন করে।)
১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে রাখাইনদের সংখ্যা ছিল ১৭,০০০-এর মত, কিন্তু রাখাইনদের নিজস্ব একটি সংগঠনের দাবী অনুযায়ী এদেশে তাদের জনসংখ্যা হল দেড় লাখ। তাদের সংখ্যা যাই হোক, উপকূলীয় এলাকার উল্লেখযোগ্য পর্যটন এলাকাসমূহে (কক্সবাজার, কুয়াকাটা প্রভৃতি) রাখাইনদের স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত উপস্থিতি সহজেই অন্যদের নজর কাড়ে।
ধর্মীয়ভাবে বৌদ্ধ রাখাইনদের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এবং প্রচলিত অর্থে তাদেরকে কোনভাবেই ‘আদিম’ হিসাবে গণ্য করা যায় না। তথাপি তাদের স্বাতন্ত্র্যের কারণে অনেকক্ষেত্রে তারা বিদ্রুপ-বিদ্বেষের শিকার হয়, যদিও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যে কোন বাংলাদেশীই সহজেই বুঝবে যে রাখাইনদের উপস্থিতি সামাগ্রিকভাবে এদেশকে সমৃদ্ধ করেছে।
রাখাইন জনগোষ্ঠী অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় রাখাইন জনগোষ্ঠী অধ্যায়ের সারাংশ – যা রাখাইন -জনগোষ্ঠী এর অর্ন্তভুক্ত, উপকুলীয় এলাকায় কক্সবাজার-বরগুনা-পটুয়াখালী জেলাসমূহে রাখাইন- জনগোষ্ঠীর বসবাস। রাখাইনদের অতীত ইতিহাস আরাকান তথা বার্মার (অধুনা মায়ানমার) সাথে সম্পৃক্ত।
তবে এদেশে রাখাইনরা দুইশতাধিক বছর ধরে বসবাস করছে, এবং উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে তারাই প্রথম আবাদী ভূমি গড়ে তুলেছিল। কৃষি ছাড়া রাখাইনদের অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথেও জড়িত। তবে ভূমি হাতছাড়া হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এদেশের রাখাইনরা আর্থসামাজিক চাপের মুখে রয়েছে |
বৈরী পারিপার্শ্বিকতার কারণে তাদের কিছু অংশ দেশান্তরীও হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, যেটাকে লালন করা দরকার শুধু তাদের আত্মপরিচয়ের স্বার্থে নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্যের সমৃদ্ধি ঘটানোর জন্যও।
রাখাইন জনগোষ্ঠীর ইতিহাস
বলা হয়ে থাকে রাখাইনরা দুইশতাধিক বছর আগে আরাকান থেকে এদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। রাখাইনরা নিজেরাও তাই মনে করেন। তবে এক্ষেত্রে এটাও লক্ষ্য রাখা দরকার যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে আরাকানী শাসন বা প্রভাব ছিল (চট্টগ্রামে মুগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এ অঞ্চল কখনো কখনো ত্রিপুরা রাজ্যের মাণিক্য রাজাদের শাসনাধীনেও ছিল)।
কাজেই রাখাইনদের অভিবাসনের যে সময়কালের কথা সচরাচর বলা হয়, তার বেশ আগে থেকেই তাদের পূর্বসূরীদের অনেকে বর্তমান কক্সবাজার-রামু-টেকনাফ প্রভৃতি অঞ্চলে ছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে পটুয়াখালী অঞ্চলে রাখাইন বসতি গড়ে ওঠার সময়কাল হিসাবে কোন কোন প্রকাশিত বিবরণে ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীর কথা উল্লেখ করা হলেও এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে পটুয়াখালী অঞ্চলে রাখাইন বসতি গড়ে উঠেছিল অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে। তবে সংশ্লিষ্টদের অনেকে চট্টগ্রাম ও রামু অঞ্চল থেকে পটুয়াখালী অঞ্চলে এসেছিল। অবশ্য ওই সময় বার্মা কর্তৃক আরাকান আক্রান্ত হওয়ায় আরকান থেকে অনেক শরণার্থী চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিল।
পটুয়াখালী অঞ্চলে এদেরই অনেকে পুনর্বাসিত হয় বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে ১৭৮৪ সালে ১৫০ পরিবার নিয়ে গঠিত রাখাইনদের একটি বড়সড় দল ৫০টি নৌযানে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সরাসরি আরাকান থেকে বর্তমান গলাচিপা থানার অন্তর্গত রাঙাবালি দ্বীপে এসে বসতি গড়েছিল, এমন বিবরণও পাওয়া যায়।
বর্তমান কক্সবাজার-পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলসমূহে যেভাবেই রাখাইনদের প্রথম আগমন ঘটে থাকুক না কেন, উপকূলীয় বনাঞ্চলের অনেক স্থানকে আবাদী ভূমিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। পটুয়াখালী অঞ্চলে বনভূমি পরিষ্কার করিয়ে চাষাবাদের সূচনা ঘটানোর লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার রাখাইনদের ভূমি বন্দোবস্তি দানের ব্যবস্থা নিয়েছিল।
এ লক্ষ্যে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের একজন বিশেষ কর্মকর্তাও নিযুক্ত ছিল, তবে পাকিস্তান আমলে এই পদ বিলুপ্ত করা হয়। রাখাইনদের দৃষ্টিতে এই পদক্ষেপ তাদেরকে নিজেদের হাতে গড়ে তোলা আবাদী ভূমি থেকে ধীরে ধীরে উচ্ছেদের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। বাস্তবেও বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান আমলে এদেশে রাখাইনদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল বলে জানা যায়, তাদের অনেকে নানান্ প্রতিকূলতার মুখে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়া এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয় নি বলেই প্রতীয়মান হয়।
রাখাইন জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থান
রাখাইনদের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলে। কৃষি-নির্ভর রাখাইনদের অনেকেরই বিগত দশকগুলোতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভূমি হাতছাড়া হয়েছে, ফলে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ভঙ্গুর হয়ে গেছে।
ভূমি হারানোর পাশাপাশি তাদের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে, সংখ্যাল্পতার কারণে, বিভিন্ন সময়ে তারা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হয়েছে। প্রতিবেশী বাঙালীদের অনেকে এখনো তাদের ‘মগ’ হিসাবে হেয় করে থাকে। এভাবে বৈরী একটি পরিমন্ডলেই অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের মত রাখাইনরাও এদেশে বসবাস করছে।
অবশ্য এমন নয় যে প্রতিকুলতার মুখে তারা সবাই হতাশ ও নিস্ক্রিয় হয়ে বসে রয়েছে। বরং নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার জন্য, এবং সেগুলোর সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে, তারা সংগঠন গড়ে তুলেছে। রাখাইনদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত। কক্সবাজার শহরে রাখাইনদের পরিচালিত দোকান পাট চোখে পড়ে।
অন্যত্রও, যেমন বান্দরবান শহরে, রাখাইনদের দোকান রয়েছে। তাদের অনেকে পাহাড়ীদের মধ্যে জনপ্রিয় ‘নাপ্পি’ নামে পরিচিত একধরনের শুটকি-মন্ড উৎপাদন ও বিপণনের সাথেও জড়িত। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে রাখাইনদের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারীদের পরিচালিত তাঁত ছিল, যা দিয়ে পরিবারের বজ্রচাহিদা মেটানো হত। সূতার দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে এই শিল্প বর্তমানে হুমকির মুখে, তবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হলে এর বিকাশ ও প্রসার সম্ভব বলে মনে করা হয় ।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের জীবনে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রথাগতভাবে রাখাইনদের অধিকাংশই নিজেদের ভাষায় লিখতে পড়তে পারত, এবং এখনো পারে, যার পেছনে তাদের ‘কিয়ং” বা বৌদ্ধ-বিহার ভিত্তিক শিক্ষা-ব্যবস্থার ভূমিকা রয়েছে। তবে রাখাইনদের অনেকে জাতীয় শিক্ষাকার্যক্রমের আওতা-বহির্ভূত রয়ে গেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তবে অল্পসংখ্যক যাঁরা রয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ উচ্চ পদে চাকুরিতে নিয়োজিত রয়েছেন।
যেসব রাখাইনরা এদেশে রয়ে গেছে, সাংস্কৃতিকভাবে তারা নিজেদের উৎসভূমি হিসাবে আরাকান বা মায়ানমারকে চিহ্নিত করলেও এদেশের নাগরিক হিসাবে পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার জন্মগত অধিকার তাদের অবশ্যই রয়েছে, এবং এটা প্রত্যাশিত যে ‘স্বদেশে পরবাসী’ হিসাবে যেন তাদের জীবন কাটাতে না হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সুব্যবস্থা করা হবে।