গ্রীক, শক ও পহ্লব

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় গ্রীক, শক ও পহ্লব। গ্রিক বা যবন শাসনের অন্তিম পর্বে শক-পহ্লবরা ভারত আক্রমণ করেন। তাদের আক্রমণে গ্রিক রাজ্যগুলো ভেঙ্গে পড়ে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের পদানত হয়। রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে তাে বটেই ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতেও শক-পহ্লব যুগ এই উপমহাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।

গ্রীক, শক ও পহ্লব

 

গ্রীক, শক ও পহ্লব

 

গ্রীক, শক ও পহৰ

মৌর্যদের পতনের পর ভারতে একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে সে সুযোগে নানা জাতের বিদেশি শত্রু এসে এদেশে রাজ্য স্থাপন করে। এ সময় যেসব বিদেশি জাতি ভারতবর্ষ আক্রমণ করে তারা হল ব্যাকট্রিয়ান গ্রীক, পার্থিয়ান (পারদ বা পহলব) ও শক জাতি।

ব্যাকট্রিয়ানদের বাংলায় বহলীক বলা হয়ে থাকে, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ব্যাকট্রিয়াতে ছিল এদের আদি বাসস্থান। উত্তর-পশ্চিম ভারত যখন বিদেশী শত্রুদের হস্তগত হয় তখন আন্ধ্ররাই ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির রক্ষাকর্তা হন এবং যুদ্ধ করে বহিরাগতদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে বহুদিন ধরে আন্ধ্রদের আধিপত্য বজায় থাকে। এ বংশে গোতমী-পুত্র সাতকর্ণী, যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী ইত্যাদি অনেক বড় বড় রাজার জন্ম হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিদেশীদের আক্রমণে কিছুকালের জন্য এঁদের প্রভাব ম্লান হয়। কিন্তু খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গোতমী-পুত্র সাতকর্ণী সমস্ত শত্রুকে পরাস্ত করে নিজ বংশের লুপ্ত গৌরব উদ্ধার করেন। কিন্তু পরবর্তী রাজারা তেমন শক্তিশালী ছিলেন না। শত্রুরা তাঁদের হারিয়ে দিয়ে আন্ধ্ররাজ্যের অনেক প্রদেশ জয় করেন। ক্রমশ আন্ধ্ররাজ্যের অধঃপতন শুরু হয় এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ স্বাধীন হয়ে পড়ে।

 

গ্রীক, শক ও পহৰ

 

আন্ধ্র রাজারা বহু জনহিতকর কাজ করেছিলেন। এ যুগে শিল্প ও সাহিত্যের অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। সাতবাহন যুগের গুহা-স্থাপত্যের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা অতি অপরূপ।

 

গ্রিক:

শুঙ্গ ও কাণ্ববংশীয় রাজারা যখন ভারতের অভ্যন্তরে রাজত্ব করছিলেন, তখন এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল কার্যত অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেশের এই রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযােগে এক বিদেশি জাতি ভারতের বিশাল অঞ্চল অধিকার করে বসেন। এরাই হলেন ব্যাকট্রীয় গ্রিক। তারা বিদেশিরূপে ভারতে এসেছিলেন কিন্তু দীর্ঘদিন আর বিদেশি ছিলেন না। ধীরে ধীরে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে তারা ভারতীয় জনসমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করেন।

এখন যেখানে উত্তর আফগানিস্তানের বল্খ‌, প্রাচীনকালে সেই বল্খ‌ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে ছিল ব্যাকট্রিয়া রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে আকিমেনীয় সম্রাট প্রথম সাইরাস ব্যাক্ট্রিয়া অধিকার করেন। এই বংশের শেষ রাজা তৃতীয় দারিউসকে পরাজিত করে আলেকজান্ডার ব্যাক্ট্রিয়ায় ম্যাসিডােনীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। আলেকজান্ডারের উৎসাহে তার অনুগামীদের অনেকে এখানে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যাবিলােন শহরে তার মৃত্যু হলে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্য তার সেনাপতিগণের মধ্যে বিভক্ত হয়। ব্যাক্ট্রিয়াসহ প্রাচ্য প্রদেশগুলোর অধীশ্বর হন সেনাপতি সেলুকাস।

 

শক:

গ্রিক বা যবন শাসনের অন্তিম পর্বে শক-পহ্লবরা ভারত আক্রমণ করেন। তাদের আক্রমণে গ্রিক রাজ্যগুলো ভেঙ্গে পড়ে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের পদানত হয়। রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে তাে বটেই ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতেও শক-পহ্লব যুগ এই উপমহাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।

শকরা ছিলেন আসলে মধ্য এশিয়ার এক যাযাবর গােষ্ঠী। অতি প্রাচীনকালেই মধ্য এশিয়ার কয়েকটি স্থানে তাদের বসতি গড়ে উঠেছিল। আধুনিক কিরগিজস্তানের উত্তর-পূর্বপ্রান্তস্থিত ইশিক্কুল হ্রদ সংলগ্ন অঞ্চলই ছিল এই শকদের এক প্রাচীন আবাস। কালক্রমে ইউ-চি, হুণ প্রভৃতি প্রতিদ্বন্দ্বী যাযাবর গােষ্ঠীর আক্রমণে তারা এই বাসভূমি ত্যাগ করে একটু পশ্চিমে সরে এসে উজবেকিস্তান ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করেন। শকদের দক্ষিণাভিমুখী একটি শাখা ইরানের সিস্তান অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। এ দু’টি শাখার শকরাই ভারত আক্রমণ করেছিলেন। উজবেকিস্তানে শকরা কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির মধ্য দিয়ে কাশ্মীরে এসে উপনীত হয় আর সিস্তানের শকরা বেলুচিস্তান হয়ে বােলান গিরিপথের ভেতর দিয়ে সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। মূল চীনা ইতিবৃত্তে স্থানটিকে কি-পিন বলা হয়েছে।

অনেকেরই অভিমত, কি-পিন ও কাশ্মীর এক ও অভিন্ন। কোনও কোনও বিদ্বান কি-পিনের অবস্থান কাশি বা কফিরিস্তান (নুরীস্তান) অঞ্চলে নির্দেশ করেছেন। শেষে অভিমত যথার্থ হলে সিদ্ধান্ত করতে হবে, কারাকোরাম নয়, হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী পেরিয়েই শকদের এই শাখা উওর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে। তবে বেশির ভাগ শকরা সিস্তান থেকেই ভারতে আসে। শকরা দীর্ঘদিন তাদের পুরানাে বাসভূমি সিস্তানের কথা মনে রেখেছিল। তাদের ভারতে আসার অনেক পরে উৎকীর্ণ মথুরা সিংহস্তম্ভ লেখমালায় সিস্তান বা শকস্থানের উল্লেখ আছে।

 

পহ্লব:

মউয়েস যখন কাপিশ, গান্ধার ও পাঞ্জাবে শক আধিপত্য বিস্তার করছেন তখন কান্দাহার ও হেরাতেও রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গেল। এক পহ্লব ভাগ্যান্বেষী এই পালা বদলের নায়ক। তার নাম ভােনােনেস। বয়সে তিনি মউয়েসের থেকে হয়তােবা একটু ছােটোই ছিলেন। মউয়েসের যেমন প্রচুর মুদ্রা পাওয়া গেছে ভােনােনেসের মুদ্রা কিন্তু সেই তুলনায় অনেক কম। আর যেকটিই-বা পাওয়া গেছে তার সব কটিতেই ভােনােনেসের নামের সঙ্গে হয় তার ভাই স্পলহাের বা ভ্রাতুপুত্র স্পলগদমের নাম উৎকীর্ণ হয়েছে। এর থেকে দুটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে – এক. ভােনােনেস বেশিদিন রাজত্ব করেননি। তিনি দীর্ঘদিন রাজত্ব করে থাকলে তার মুদ্রা অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যেত। দুই. শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি তার রাজ্য দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। তার ভাই স্পলহাের হলেন এক অঞ্চলের সহযােগী প্রশাসক, অন্য অঞ্চলের সহযােগী প্রশাসক হলেন তার ভ্রাতুস্পুত্র স্পলগদম।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment