আজকে আমরা আলোচনা করবো শ্রেণী ও জাতিবর্ণ স্তরবিভাজন নিয়ে। সামাজিক ভেদাভেদ বুঝবার জন্য বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হচ্ছে শ্রেণী। আমরা সাধারণভাবে এই ধারণার সঙ্গে পরিচিত। প্রায়শই আমরা ধনী গরিব এই শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। এখানে এই শব্দ দুটো দিয়ে আমরা কোন মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বুঝিয়ে থাকি। সেটা কেবল টাকা পয়সা অর্থে নয়।
ধনী বলতে সাধারণত সম্পদশালীকে বোঝানো হয়ে থাকে। আর গরিব বলতে সম্পদ নেই এমন মানুষকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে শব্দ দুটোর একটা তুলনামূলক ব্যবহার আছে। সেটা হচ্ছে কেউ কারো চেয়ে কম সম্পদশালী হলে বলা হয়ে থাকে তার তুলনায় গরিব। এই উদাহরণের – মধ্য দিয়ে শ্রেণী বোঝা যেতে পারে।
শ্রেণী ও জাতিবর্ণ স্তরবিভাজন

সাধারণভাবে সম্পদের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে যে ফারাক তাকে শ্রেণী বলে। সম্পদশালী শ্রেণীকে উচ্চ শ্রেণী বা ধনী শ্রেণী আর সম্পদহীনকে নি শ্রেণী বা গরিব শ্রেণী বলা হয়ে থাকে। তবে সামাজিক বিজ্ঞানের লেখাপড়ায় আরেক ভাবে এটাকে বলা হয়ে থাকে – উচ্চবিত্ত এবং নিবিত্ত। এর পাশাপাশি মধ্যবর্তী একটা শ্রেণীকে বোঝানোর জন্য মধ্যবিত্ত বলে একটা ধারণা ব্যবহার হরা হয়। এটা আমরা চলতি ভাষাতেও ব্যবহার করি।
যদিও সম্পদের ভিত্তিতেই শ্রেণী গঠিত হয় বলে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, অনেক বিশে ষকই বলেছেন শ্রেণী বুঝবার জন্য কেবল সম্পদের ভিত্তিতে এগোলে চলবে না। এর সঙ্গে মর্যাদা, ক্ষমতা এগুলোকে সম্পর্কিত করে দেখা লাগবে। পক্ষান্তরে, জাতিবর্ণ বলতে এমন এক ভেদাভেদ ব্যবস্থা বোঝায় যা কোন মানুষের জন্মের সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়। যেমন: ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণ বলেই পরিচিত হবে। শ্রেণী যদিও বর্তমান পৃথিবীর সকল সমাজেই দেখতে পাওয়া যায়, জাতিবর্ণ প্রথা কেবলমাত্র ভারতবর্ষ এবং আশেপাশে পাওয়া সম্ভব বলে অনেক নৃবিজ্ঞানীরা বলেছেন। তাঁদের মতে, এটা কেবল হিন্দু সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু অন্য অনেক নৃবিজ্ঞানীরা বলেছেন – ভারতবর্ষের এই জাতিবর্ণ আপাত স্বতন্ত্র হলেও এই স্তরবিন্যাস অন্য সমাজেও আছে। তাঁরা উল্লেখ করেছেন জাপান, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলের কথা। দুই একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ভেদাভেদকেও জাতিবর্ণ প্রথার মত বলে উল্লেখ করেছেন। নৃবিজ্ঞানে এই দুই স্তরবিভাজনকে সমাজে সত্যিকার ভেদাভেদকারী হিসেবে দেখা হয়েছে শ্রেণী এবং লিঙ্গ। এক্ষেত্রে এই দুইয়ের একটা সম্পর্ক টানার চেষ্টা করেছেন অনেক – নৃবিজ্ঞানী। তাঁদের ব্যাখ্যা হ’ল:এই দুই স্তরবিভাজনের পার্থক্য হচ্ছে একটাতে সদস্যরা তাঁদের স্তর অর্জন করেন, অন্যটাতে সদস্যদেরকে স্তরে সামিল করানো হয়।

অর্থাৎ সমাজে কোন মানুষ কোন শ্রেণীতে জন্মালেও নানা উপায়ে তিনি তাঁর শ্রেণী বদলে অন্য শ্রেণীতে চলে যেতে পারেন। তাঁর সম্পদ কোন কারণে বৃদ্ধি পেলে বা খোয়া গেলে। আর কোন জাতিবর্ণের সদস্যরা সারা জীবন তাঁর অবস্থান বদলাতে পারবেন না। যেহেতু তিনি যাই করুন না কেন ঐ জাতিবর্ণের সদস্য পদ ত্যাগ করা সম্ভব নয়। শ্রেণী এবং জাতিবর্ণের মধ্যে এই পার্থক্য খুবই সরল এবং তেমন কোন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না, বিশেষত বর্তমান কালে। কোন একজন দুইজন দরিদ্র মানুষের হঠাৎ ধনী হয়ে যাবার গল্প নিশ্চয় আছে। কিন্তু তা দিয়ে সমস্ত দরিদ্র শ্রেণীর সামজিক জীবন ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।
কেবল সম্পদের বেশি পরিমাণ দিয়ে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সামাজিক সুবিধা এবং দাপট বোঝা যাবে না । সে কারণেই ক্ষমতা এবং মর্যাদার প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু খোদ সম্পদ থাকবার মানে কি – সেটাও তলিয়ে – দেখা দরকার। সম্পদ থাকার প্রধান মানে হচ্ছে নানান ধরনের দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা সম্ভব এই শ্রেণীর পক্ষে। বিশেষ করে এই মুহূর্তের পৃথিবীতে খোলা বাজারে সকল কিছু কেনা সম্ভব। নানান দ্রব্য কেনা বা জোগাড় করার মানে হচ্ছে সেই শ্রেণীর সুবিধা ও আরাম আয়েশ নিশ্চিত হচ্ছে। বাড়ি হোক, গাড়ি হোক, প্রসাধনী হোক আর খাবার হোক। সেটা একটা বিরাট ব্যাপার।
এক পক্ষের আরাম আয়েশ মানেই অন্য পক্ষের দুর্ভোগ এবং বঞ্চনা। ক্ষমতা, . মর্যাদা এবং নানারকম বাড়তি সুবিধা পাওয়ার মধ্য দিয়ে এই শ্রেণীর আচার-আচরণ, মনোভাব, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদিতেও বড়সড় পরিবর্তন ঘটে। আচার- আচরণ, ধ্যান-ধারণার এই বদল কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, এটা একটা শ্রেণীগত ব্যাপার। এভাবে শ্রেণী বলবার সাথে সাথে কেবল সম্পদের পার্থক্যই নয়, আমরা মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণার পার্থক্যও বুঝতে পারি।

সেই সঙ্গে শ্রেণীগুলোর মধ্যকার সম্পর্ককেও বুঝতে পারি। উপরন্তু সম্পদ থাকার আর একটা অর্থ হচ্ছে সম্পদশালী ব্যক্তি অন্যান্য সম্পদহীনকে কাজ দিতে পারে। এটা শুনতে যে রকম আরামদায়ক শোনায় তেমন নয় মোটেই। এর মানে হ’ল: ধনী শ্রেণী সম্পদের জোরে গরিব শ্রেণীর শ্রম কিনে নিতে পারে।
শ্রেণী ও জাতিবর্ণ স্তরবিভাজন অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় শ্রেণী ও জাতিবর্ণ স্তরবিভাজন অধ্যায়ের সারাংশ – যা শ্রেণী ও জাতিবর্ণ স্তরবিভাজ এর অর্ন্তভুক্ত, সম্পদের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য তাকে শ্রেণী বলা হয়। তবে শ্রেণী বলবার সাথে সাথে কেবল সম্পদের পার্থক্যই নয়, আমরা মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণার পার্থক্যও বুঝতে পারি।
আমাদের পরিচিত সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিক আর মালিক বিবদমান দুইটি শ্রেণী। আর আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। শ্রমিক শ্রম দিয়ে চলেছেন ন্যূনতম মজুরিতে। অন্যদিকে মালিক কোন শ্রম না দিয়ে সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জ করছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীও কোন উৎপাদন কাজে অংশ নেন না।
জাতিবর্ণ বলতে এমন এক ভেদাভেদ ব্যবস্থা বোঝায় যা কোন মানুষের জন্মের সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়। অনেকের মতে এই অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যেই কেবল এই ধরনের ভেদাভেদ প্রথা চালু আছে। কিন্তু অন্য নৃবিজ্ঞানীদের যুক্তি হ’ল এরকম বৈষম্য অন্য সমাজেও রয়েছে।
আরও দেখুনঃ