আজকের আলোচনার বিষয় সংজ্ঞা এবং ইতিহাস – যা স্বাস্থ্য ভাবনা এবং স্বাস্থ্যের নৃবিজ্ঞান এর অর্ন্তভুক্ত, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞানের পরিধি এতটা ব্যাপক এবং এত নানাবিধ বিষয় এতে পঠিত হয়ে থাকে যে এর একটি একক সংজ্ঞা নির্ধারণ কঠিন। একদিকে অ-ইউরোপীয় সমাজের চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ওষুধপাতি থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ভূমিকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞানের বিস্তৃতি।
অন্যদিকে, বিভিন্ন সমাজের মানুষের স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা সংক্রান্ত ভাবনা থেকে শুরু করে আধুনিক দর্শনে শরীর ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জ্ঞান কিভাবে তৈরি হয়ে চলেছে – তার সবই স্বাস্থ্য-নৃবিজ্ঞানের অন্তর্গত। কারো কারো গবেষণায় এসেছে গরিব শ্রেণীর উপর স্বাস্থ্যনীতির প্রভাব। এছাড়া স্বাস্থ্য-নৃবিজ্ঞানের বড় একটা এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশ্বাস ও আচার- র-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত গবেষণা ও পড়াশোনা।

সংজ্ঞা এবং ইতিহাস
এক্ষেত্রে ধারণা করা হয় যে, বিভিন্ন সমাজ যেগুলো শিল্পভিত্তিক নয় সেখানে নানান ধরনের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান – রোগবালাইয়ের সাথে সম্পর্কিত হয়ে আছে। সেই সমস্ত সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে গবেষকগণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ কারণেই মেডিক্যাল এনথ্রপলজিকে অনেকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞান বলে থাকেন যা ইতোমধ্যেই আপনারা জেনেছেন। কিন্তু সে আলোচনায় আমরা এখন যাব না। নামকরণ বিষয়ক সংকট নিয়ে পরে কিছু কথা বলার সুযোগ আছে।
সাধারণভাবে মেডিক্যাল এ্যান্থ্রোপলজি বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞান বলতে বোঝানো হয়ে থাকে স্বাস্থ্য, অসুস্থতা এবং ওষুধের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অধ্যয়ন। একাধারে একজন ডাক্তার এবং নৃবিজ্ঞানীকে এই শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ভাবা হয়ে থাকে। তিনি হচ্ছেন ডবি- উ. এইচ. আর. রিভার্স। যদিও ওষুধ নিয়ে তিনি যে গবেষণাকর্ম করেছেন তার থেকেই খুব রাতারাতি নৃবিজ্ঞানের একটা উপশাখা দাঁড়ায়নি। রিভার্সের যুক্তি ছিল, ‘আদিম ঔষধ’কে একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে সেই একই সূত্রাবলী এবং পদ্ধতিমালা প্রয়োগ করা যেতে পারে যা কিনা সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠান অধ্যয়ন করার সময় নৃবিজ্ঞানীরা প্রয়োগ করে থাকেন। কিছু অনুশীলনের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ একটা সমগ্র হিসেবে ‘আদিম ঔষধ’কে বিবেচনা করা হয়েছে এখানে। আর এই অনুশীলন গড়ে উঠেছে কোনও নির্দিষ্ট একটা সমাজের মানুষজনের মধ্যে রোগের কারণ সম্পর্কিত ধারণার উপর ভিত্তি করেই। আবার, রোগের কারণ সম্পর্কিত এই ধারণাবলী ঐ বিশেষ সমাজের মানুষের বিশ্ব সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তার সাথে যুক্ত। রিভার্সের এই উদ্যোগের পর ৩০ ও ৪০ এর দশকে আরো কিছু গবেষণা হয়েছে।

৬০ এর দশকে নৃবিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে মেডিক্যাল এ্যান্থ্রোপলজি দাঁড়ানোর পেছনে এ সকল গবেষণা ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। এই গবেষণাগুলোর একটা সুগভীর গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এর আগে পর্যন্ত ভাবাই হ’ত না যে ‘আধুনিক’ এবং ‘আদিম’ ওষুধের মধ্যে কোন প্রকার তুলনা চলতে পারে। ভাবা হ’ত যে সাবেক কালের ওষুধপত্তর হচ্ছে যাদু-ধর্ম ধরনের বিষয়।
গোড়া থেকেই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক পশ্চিমা ওষুধের একটা গভীর যোগাযোগ ছিলই। তা স্বপক্ষে বা বিপক্ষে যাই হোক না কেন। ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে প্রধান বিতর্ক ছিল অ- পশ্চিমাদের চিকিৎসা-জ্ঞান ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠান থেকে স্বতন্ত্র কিনা। তবে এই বিতর্ক ছিল মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নৃবিজ্ঞানীদের।
নৃবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এই স্বাতন্ত্র্য দাবি করে আসছিলেন। তাঁদের মতে অ-পশ্চিমা সমাজের মানুষজনের চিকিৎসা জ্ঞান যাদু, ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠান থেকে একেবারে স্বতন্ত্র বিষয় ছিল এবং আছে। কিন্তু কিছু নৃবিজ্ঞানীর কাছে কতক ধরনের বিষয় বরাবরই আরো আগ্রহের থেকে গেছে। যেমন: জ্বিনে ধরা, আছর পড়া, মন্ত্র-তন্ত্র ইত্যাদি। এর ফলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত (বা চিকিত্সা) নৃবিজ্ঞানীদের পক্ষে তাঁদের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে গেছিল। তবে দীর্ঘদিন বিতর্ক চলতে চলতে নৃবিজ্ঞানের এই শাখায় এখন এটা স্বীকৃত যে, আধুনিক পশ্চিমা ওষুধের ঐতিহ্যেরও নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট আছে।
বিজ্ঞানের নামে একে সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা করা যাবে না। সে কারণে বর্তমান কালের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞান (medical anthropology) আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিজ্ঞান (medical science) এবং চিকিৎসা জ্ঞান (medical knowledge) নিয়েও প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞানের এ সমস্ত বিতর্ক তোলার কারণেই, আপনারা খেয়াল করবেন, ‘আধুনিক’, ‘বিজ্ঞানসম্মত’ এ সমস্ত শব্দের বদলে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বানানো – ওষুধপত্তরকে এখন জৈব-ওষুধ’ (biomedicine) বলা হয়ে থাকে।

গত ত্রিশ বছরে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেডিক্যাল এ্যান্থ্রোপলজি শাখাটি দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছে। অসুস্থতা সংক্রান্ত নৃবৈজ্ঞানিক আলাপ-আলোচনা আরও সূক্ষ্ম হয়েছে – সেটা স্বাস্থ্য- নৃবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যাবার একটা কারণ। তবে এর পাশাপাশি ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যনীতির পরিকল্পনাকারীদের ভূমিকাও আছে। তাঁরাও সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ক্রমে ক্রমে আগ্রহ বাড়িয়েছেন।
আরও দেখুনঃ