আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সফিস্ট তত্ত্বের উৎপত্তি ও বিকাশ। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের আলোচনায় সোফিস্তেস কথাটি দিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম ও ৪র্থ শতকের সময়ে প্রাচীন গ্রিসের এমন এক ধরনের শিক্ষককে নির্দেশ করা হয়, যিনি এক বা একাধিক পাঠ্যবিষয়ের উপরে বিশেষজ্ঞ ছিলেন; বিষয়গুলির মধ্যে দর্শন, অলঙ্কারশাস্ত্র, সঙ্গীত, মল্লক্রীড়া ও গণিত উল্লেখ্য। তারা মূলত তরুণ রাষ্ট্রপরিচালক, কূটনীতিবিদ ও অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিদেরকে “আরেতে” তথা সদগুণ বা উৎকৃষ্ট নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতেন। এদেরকে ইংরেজিতে সফিস্ট (Sophist) বলা হয়।
সফিস্ট তত্ত্বের উৎপত্তি ও বিকাশ
![এরিস্টটল [ Aristotle ]](/wp-content/uploads/2023/10/Aristotle-এরিস্টটল-2-300x157.jpg)
সফিস্ট তত্ত্বের উৎপত্তি ও বিকাশ
প্রাচীন গ্রীসের দর্শনের ইতিহাসে এক সংকটের উদয় ঘটার ফলেই সফিস্ট তত্ত্বের উ ৎপত্তি ঘটেছিল। প্রথম যুগের অর্থাৎ আয়োনীয় যুগের প্রকৃতি বিজ্ঞানী, যথা, থালেস, এ্যানাক্সিম্যাণ্ডার এ্যানাক্সিমেনিস্ প্রভৃতি দার্শনিকদের ধারণা ছিল, কোন একটিমাত্র মূল পদার্থ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন বিচিত্র পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে। এবং ঐ আদি বা মূল পদার্থের সন্ধানেই তাঁরা নিমগ্ন ছিলেন। এ পর্যায়ের দার্শনিকরা সত্যজ্ঞান লাভের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কখনও সন্দিহান ছিলেন না।
থালেস বলেছিলেন, পৃথিবীর সবকিছু পানি থেকে তৈরি হয়েছে। অপর এক দার্শনিক হেরাক্লিটাস (Heraclitus) বললেন যে, বিশ্বের মূল উপাদান হচ্ছে আগুন। এ পর্যন্ত কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু হেরাক্লিটাস যখন বললেন যে, সব জিনিসই অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে তখন তিনি নিজেই নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে, কোনো জিনিস সম্পর্কে পুরোপুরি বা প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব না।
এক অর্থে হেরাক্লিটাস ছিলেন গোঁড়াপন্থী, কারণ তিনি নিঃশর্তভাবে এবং নিঃসন্দিগ্ধভাবে নিজের তত্ত্বের ওপর আস্থাবান ছিলেন। কিন্তু আর সব বিচারে তিনি ছিলেন সন্দেহবাদী। আবার দার্শনিক ইলিয়া-নিবাসী পারমেনাইডিস (Parmenides) বললেন যে, একটি মূল পদার্থই প্রকৃত অস্তিত্বশীল এবং এটাকে জানাই জ্ঞানের লক্ষ্য; অপরপক্ষে, তাঁর মতে, বিশ্বের সকল বস্তুর বহুমুখী রূপ ক্রমশ গড়ে ওঠে এবং সেটা মানুষের অভিমতের ওপর নির্ভরশীল।
এরপর দার্শনিক জেনো (zeno) এ তত্ত্বের সপক্ষে একটি যুক্তিও প্রদান করেন। কিন্তু এ সকল তত্ত্ব ছিল স্ববিরোধিতায় পূর্ণ এবং এ দার্শনিকরা ছিলেন সন্দেহবাদী। এরপর দ্বিতীয় এক ধারার প্রকৃতিবিজ্ঞানীর উদয় ঘটে। যথা, এমপেডোক্লিস, এনাক্সাগোরাস, লিউসিপ্পাস।
এঁরা রহস্যময় এক ও বহুর তত্ত্বকে সরাসরি আক্রমণ করেননি, কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রবণতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে বহির্জগৎ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ এঁরাও কার্যত সন্দেহবাদেরই প্রচার করেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, উপরোক্ত তিন পর্যায়ের দার্শনিকরা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের প্রবর্তন করলেও, প্রতিটি তত্ত্বই ছিল সন্দেহবাদী তত্ত্ব, যদিও তাঁরা নিজেরা একথা বুঝতে পারেননি।
খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচের শতকের মধ্যভাগে আবডেরা-বাসী প্রোটাগোরাস প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের মত বিশ্লেষণ করে এক সন্দেহবাদী দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান। অপরপক্ষে লিওনটিনিবাসী দার্শনিক গর্জিয়াস (Gorgias) ইলিয়াপন্থী তথা পারমেনাইডিসপন্থীদের অধিবিদ্যামূলক (metaphysical) দর্শন অধ্যয়ন করে একই সন্দেহবাদী সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। এ সন্দেহবাদী সিদ্ধান্ত থেকে এতকাল গ্রীক দার্শনিকরা দূরে ছিলেন, কিন্তু আর তা এড়ানো গেল না।
‘সত্য’ (truth) নামক একটা বইয়ে প্রোটাগোরাস নিম্নোক্ত যুক্তি প্রদান করলেন : ‘যদি সব কিছুই অনবরত পরিবর্তনশীল হয়, তার অর্থ হবে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞানলাভ করি তা মানসিক চিন্তামাত্র (subjective); এবং সে ক্ষেত্রে বলতে হয়, মানুষই সব কিছুর পরিমাপ স্থির করে— যেটা অস্তিত্বশীল সেটার যে অস্তিত্ব আছে এবং যেটা অস্তিত্বহীন সেটার যে, অস্তিত্ব নেই, সে কথা মানুষই স্থির করে।’ এ কথা দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে বস্তুনিষ্ঠ (objective) সত্য বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।
অনুরূপভাবে, গর্গিয়াস ‘প্রকৃতি সম্পর্কে (On Nature) নামক রচনায় বলেন যে (১) কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই (nothing is); (২) যদি কোনো কিছু অস্তিত্বশীল হয় তা’ হলেও সেটা জানা সম্ভব না (if anything is, it cannot be known); (৩) যদি কোনো কিছু অস্তিত্ববান হয এবং তাকে জানা সম্ভব হয়, তাহলে তাকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না (if anything is and can be known, it cannot be expressed in spech)।
গর্গিয়াসের রচনার যেসব সারাংশ পাওয়া গেছে, তা থেকে জানা যায় যে তিনি উপরোক্ত তত্ত্বের সমর্থনে জেনোর যুক্তিসমূহকে ব্যবহার করেছিলেন। পৃথিবীতে ‘বহু’ তথা ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণাকে খণ্ডন করার জন্যে জেনো যে-যুক্তি ব্যবহার করেছিলেন, গর্গিয়াস ঐ যুক্তিকেই নিজের তত্ত্ব প্রমাণ করার কাজে ব্যবহার করেন। এর অর্থ হল, গর্গিয়াস জেনোর ধ্বংসাত্মক যুক্তিপ্রণালীকে পারমেনাইডিসের গণনামূলক দর্শনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেন।
এর দ্বারা গর্গিয়াস শুধু যে ইলিয়াপন্থীদের (তথা পারমেনাইডিসের) তত্ত্বকে অর্থহীন বলে প্রতিপন্ন করলেন তাই নয়, বরং জেনোর যুক্তির চেয়ে ভাল যুক্তিপ্রণালী আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত দার্শনিক অনুসন্ধান যে নিতান্তই অর্থহীন, কার্যত সে কথাও ঘোষণা করলেন। এর ফল হল এই যে, পূর্বে উল্লিখিত তিন পর্যায়ের দার্শনিকরা যে ক্ষেত্রে নিজেদেরকে দার্শনিক অর্থাৎ সত্যের সন্ধানকারী বলে গণ্য করতেন, প্রোটাগোরাস এবং গর্গিয়াস সে ক্ষেত্রে স্পষ্টতই পরাজয় স্বীকার করে দর্শনের মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়ালেন।
যদিও আয়োনীয় যুগের প্রাথমিক কালের দার্শনিকরা জ্ঞানের রাজ্যে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রসর হতে পারেননি, তথাপি প্রোটেগোরাসের কার্যকলাপের ফলে এমন একটা সময়ে গ্রীকজগৎ থেকে দর্শনচর্চার অবলুপ্তি ঘটল, যখন উদারনৈতিক বিষয়সমূহের অনুশীলন বিশেষজ্ঞদের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং অবসর বিনোদনের পন্থা হিসাবে শিল্প-সাহিত্য-দর্শনচর্চা সাধারণ গ্রীক নাগরিকদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবার উপক্রম হয়েছে।

এ রকম সংকটকালে দর্শনের অবলুপ্তির ফলে গ্রীকদের মানসজীবনে একটা শূন্যতাসৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিল। এ পরিস্থিতিতে প্রোটাগোরাস একদিকে যেমন দর্শনকে দূরে ঠেলে দিলেন, অপরদিকে তেমনি দর্শনের একটি বিকল্পকে উপস্থিত করলেন।
দার্শনিকদের আধিপত্যের কালে শিক্ষকদের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল; প্রোটাগোরাস শিক্ষকদের গুরুত্বকে তুলে ধরলেন এবং বললেন মননচর্চা এবং জ্ঞানচর্চার সঠিক লক্ষ্য ‘সত্য’ বা ‘প্রজ্ঞালাভ’ নয়, কারণ সেটা অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়; বরং জ্ঞানচর্চার লক্ষ্য হল সদগুণ বা দক্ষতা অর্জন। তিনি প্রাচীন দার্শনিকদের মতো বিশ্ব সম্পর্কে তত্ত্ব উপস্থিত করলেন না, বরং সামাজিক জীবনযাপন সম্পর্কে দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথাই প্রচার করলেন।
প্লেটোর উদ্ধৃতি থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রোটাগোরাস বলেছেন: ‘যে শিক্ষা আমি আপনাদের দিতে চাই তা’ হল সাংসারিক ও রাষ্ট্রীয়ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা ও সৎ পরামর্শ প্রদান, যেন সব মানুষ তাদের সাংসারিক জীবনে ও রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পাদনে যথোপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এক কথায় আমি মানুষকে যোগ্য নাগরিকে (good citizen) পরিণত করতে চাই।’ শিক্ষাদানের পদ্ধতি হিসেবে তিনি ব্যাকরণ, রচনাশৈলী, কবিতা ও বাগ্মিতাকে বেছে নিয়েছিলেন।
ইতিপূর্বে গ্রীক তরুণরা প্রচলিত প্রাথমিক ধরনের বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষালাভের পর কর্মজীবনে প্রবেশ করত, কেউ দর্শনচর্চায় মনোনিবেশ করত, কেউ ভাস্কর্য বা অন্যান্য শিল্পচর্চায় আত্মনিয়োগ করতে বা ভিন্নতর কোনো পেশা গ্রহণ করত। এখন থেকে উচ্চাভিলাষী তরুণরা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর প্রোটাগোরাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর নিকট থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে শুরু করলেন।
এ নতুন শিক্ষার পাঠক্রম পুরোপুরি সাহিত্যবিষয়কই ছিল, কিন্তু ঐ সময়ে প্রোটাগোরাস গ্রীকজগতে এমন এক চাহিদা পূরণ করলেন যা তিনি অংশত আবিষ্কার করেছিলেন এবং যার অভাববোধ তিনি অংশত তরুণদের মনে জাগ্রত করেছিলেন। তিনি গ্রীক জগতের যেখানেই যেতেন সেখানেই আগ্রহী শ্রোতারা তাঁর বক্তৃতাকক্ষে জড়ো হত এবং তাঁর অর্থ ও খ্যাতি দুয়েরই বৃদ্ধি ঘটত।
প্রোটাগোরাসের পরে যিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সফিস্ট হিসেবে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁর নাম হল প্রডিকাস। তিনি নিজেকে এথেন্স নগরে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাঁর ছাত্রদের সদগুণ ও দক্ষতা শিক্ষা দেন। তিনি প্রাধানত সাহিত্যসংক্রান্ত বিষয়াদি এবং বাস্তবমুখী নীতিশাস্ত্র বিষয়ে আলোচনা দ্বারা শিক্ষাদান করতেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে প্রডিকাস পাণ্ডিত্যের ভান করলেও, তাঁর সফল ও সর্বজনগ্রাহ্য নীতিজ্ঞান তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
সফিস্টদের জনপ্রিয়তা বর্ণনা প্রসঙ্গে প্লেটো প্রডিকাস এবং প্রোটাগোরাসের নাম একসাথে উচ্চারণ করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচের শতকের মাঝামাঝি সময়ে এথেন্সই গ্রীকজগতের সাংস্কৃতিক ও মননশীল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এখানে ক্রমশ প্রচুরসংখ্যক সফিস্ট-এর সমাবেশ ঘটে। এঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন স্থানীয় নাগরিক, আবার অনেকে ছিলেন অন্য অঞ্চল থেকে আগত।
এঁদের মধ্যে কিছু- সংখ্যক সফিস্ট সরাসরি প্রোটাগোরাস বা প্রডিকাস-এর নিকট শিক্ষালাভ করেছিলেন, অনেকে আবার নিজের চেষ্টায় সফিস্টবিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন। পরবর্তী যুগের সফিস্টরা ক্রমশ তাঁদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পরিধি বাড়াতে থাকেন এবং বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয়েও শিক্ষা দিতে শুরু করেন। কিন্তু এঁরা বিজ্ঞান এবং কারিগরি বিদ্যাকেও জনবোধ্য পদ্ধতিতে শেখাতেন ।
এ পর্যায়ের সফিস্টরা তাই বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়েও বিশেষজ্ঞের জগতে পদার্পণ করতে শুরু করেন। যেমন, এলিসনিবাসী সফিস্ট হিপ্পিয়াস শুধুমাত্র পূর্বোক্ত চারটি বিষয়ে (ব্যাকরণ, রচনাশৈলী, কবিতা, বাগ্মিতা) তাঁর শিক্ষাদানকে সীমিত রেখে পৌরাণিক কাহিনী, পারিবারিক ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, না (archaeology), হোমারবিদ্যা, তরুণদের শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়েও বক্তৃতা দান করতেন।
এতে বোঝা যায় যে, এ সময়ে সংস্কৃতি বিষয়ক সফিস্টবিদ্যার অবনতি ঘটেছিল । পরবর্তীকালের সফিস্টরা হিপ্পিয়াসের মতো জ্ঞানের সকল বিষয়ে শিক্ষা দান করতেন না। তাঁরা কেবল সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিতর্কবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষা দান করতেন। এভাবে সফিস্টবিদ্যা প্রোটাগোরাস এবং প্রডিকাস-এর সংস্কৃতিবিষয়ক সফিস্টবিদ্যা থেকে যাত্রা শুরু করে, হিপ্পিয়াস-এর সর্ববিদ্যা বিষয় শিক্ষাদানের পর্যায় পার হয়ে, পরবর্তীকালের বিতর্কবিদ্যামূলক সফিস্ট বিদ্যায় শেষ পরিণতি লাভ করে।
ইতিমধ্যে লিওনটিনি-নিবাসী গার্গিয়াস পশ্চিম গ্রীসের দর্শনকে প্রথমে অধ্যয়ন করেন এবং পরে বাতিল করেন। পরে তিনি বক্তৃতাবিদ্যা এবং আদালতের বক্তৃতাবিদ্যাকে সফিস্টবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করে সাফিস্টবিদ্যায় এক নতুন দিক সংযোজন করেন। অবশ্য, তাঁর চল্লিশ বছর আগেই সিসিলির কোরাক্স এবং টিসিয়াস এ বিষয়ে চর্চার শুরু করেছিলেন। লক্ষণীয় যে গর্গিয়াস নিজেকে কখনও সফিষ্ট বলে দাবি করেননি। তিনি নিজেকে শিক্ষক বলেই গণ্য করতেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে তিনি এথেন্সে যান এবং অবশিষ্ট জীবন সেখানেই যাপন করেন। এখানে তিনি বাগ্মিতা প্রদর্শন করে যথেষ্ট সম্মান ও অর্থলাভ করেন। গর্গিয়াস যে বক্তৃতাবিদ্যামূলক, বিশেষত আইন-আদালতে ব্যবহারযোগ্য বক্তৃতাবিদ্যামূলক সফিস্টতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষাদান করেন, তা থেকে অচিরেই রাজনৈতিক সফিস্টতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। অপরপক্ষে সংস্কৃতিবিষয়ক সফিস্টবিদ্যা ক্রমে বিতর্কবিষয়ক সফিস্টবিদ্যায় পরিণতি লাভ করে।
আগেই বলা হয়েছে, প্রোটাগোরাস এবং প্রডিকাস যে কয়টি বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন, ক্রমে তার বিস্তৃতি ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত হিপ্পিয়াস নিজেকে সর্ব বিষয়ের এবং জ্ঞানের সকল শাখার শিক্ষক বলে দাবি করেন। দক্ষ পেশাদার শিল্পী এবং পেশাদার কারিগররা যে বিদ্যা শিক্ষা দিতেন হিপ্পিয়াসের শিক্ষাক্রমের মধ্যে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে হিপ্পিয়াস ঐ সকল বিষয় শেখাতেন জনবোধ্য এবং অপেশাদার পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, হিপ্পিয়াস ঐ সব জটিল পেশাদার বিষয়ে জ্ঞানদানের দাবি করলেও, তার ছাত্ররা ঐ সকল বিষয়ে পেশাদারী দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হত না, কারণ তার পাঠক্রমটাই পেশাদারী দক্ষতা অর্জনের উপযুক্ত ছিল না।
সর্ববিদ্যাবিশারদ হিপ্পিয়াসের পরবর্তীকারের সফিস্টরা অবশ্য সর্ববিষয়ে জ্ঞানদানের দাবি করতেন না, তাঁরা এমন এক সর্বব্যাপী শিক্ষাদানের দাবি করতেন, যার দ্বারা, তাঁদের মতে, সর্ববিষয়ে সামগ্রিক একটা দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয়। এ সামগ্রিক দক্ষতা অর্জনের দরুন এ নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত সফিস্টদের পক্ষে যে কোনো বিষয়েই বিশেষ জ্ঞানলাভ অনাবশ্যক হয়ে পড়ে। সহজ কথায়, নতুন যুগের সফিস্টরা বিতর্কবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করে।
অবশ্য, বিতর্কবিদ্যায় উৎকর্ষলাভ একটি বিশিষ্ট গুণার্জন। বিশেষত, পরবর্তীকালের প্রখ্যাত দার্শনিক এ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা এ সকল বিতর্কবিদ সফিস্ট ও তাঁদের ছাত্রদের নিয়মানুগ বিতর্কের ভিত্তির ওপরেই গড়ে উঠেছিল। তাই খ্রিস্টপূর্ব চারের শতকের বিতর্কমূলক সফিস্টবিদ্যা আমাদের নিকট থেকে আরো বেশি মনোযোগ ও শ্রদ্ধা দাবি করতে পারে, যদিও গ্রীক দার্শনিক চিন্তার ইতিহাসে এ সফিস্টরা এখন পর্যন্ত বিশেষ কোনো সম্মানজনক স্থান অধিকার করতে সক্ষম হননি ।
অবশ্য এ বিতর্কমূলক সফিস্টবিদ্যার ত্রুটির দিকও ছিল। বিতর্কবিদ্যার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করলেও আলোচ্য বিষয়ের সত্যাসত্য নির্ণয়ের প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে দাঁড়ায় এবং বিতর্কে জয়লাভই একমাত্র কাম্য বিষয়ে পরিণত হয়। বস্তুত, বিতর্কবিদ সফিস্টরা বিতর্কে জয়লাভের জন্যে সঠিক যুক্তির পরিবর্তে স্ববিরোধী এবং কুযুক্তির আশ্রয় নিতে দ্বিধাবোধ করতেন না; তাঁরা জেনেশুনেই অযৌক্তিক কথাকে ছদ্ম যুক্তির আচ্ছাদনে আবৃত করে সুকৌশলে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতেন।
প্রকৃতপক্ষে সব সফিস্টদের পক্ষেই এ ধরনের ভুলের আশ্রয় গ্রহণ করার প্রবণতা ছিল, কারণ, একে তো প্রথমাবধিই সফিস্টরা সত্যের অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাকে বাতিল করেই সফিস্টবিদ্যার চর্চা শুরু করেছিলেন;
তা ছাড়াও সফল সফিস্ট শিক্ষকরা এক নগর থেকে অন্য নগরে ঘুরে বেড়াতেন বা ভিন্ন নগরে গিয়ে বাস স্থাপন করতেন বলে স্থানীয় জনজীবন সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুন স্থানীয় কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হতেন না এবং তার ফলে আলোচ্য বা বিতর্কিত বিষয়ের বাস্তবতার গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁরা সচেতন হতেন না। সফিস্টদের স্ববিরোধী এবং অবাস্তব যুক্তি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুযুক্তির ব্যবহার ক্রমশ জনসাধারণের নিকট অপ্রিয় হয়ে উঠল।
কালক্রমে তাই চিন্তাশীল ছাত্রেরা ঐ ধরনের বিতর্কে আগ্রহী হতে শুরু করলেন, যা সত্যের অনুসন্ধানকে বিতর্কের এবং সব ধরনের মননচর্চার লক্ষ্য বলে স্বীকার করে নিত। চিন্তাশীল ছাত্ররা এভাবে সফিস্ট তত্ত্বকে ত্যাগ করে কোনো না কোনো সত্যসন্ধানী দর্শনের শরাণাপন্ন হল। এভাবে দর্শনশাস্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ঘটল।
আরও দেখুন :