আজকে আমরা আলোচনা করবো সাম্প্রতিক কালের জ্ঞাতিত্ব- অধ্যয়ন নিয়ে। এই পাঠটি জ্ঞাতিত্ব -অধ্যয়নের শেষ ইউনিটের শেষ পাঠ। আমরা এখন জ্ঞাতিত্ব-অধ্যয়নের মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসব: জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা কি? যে সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমানের ভিত্তিতে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে জ্ঞাতিত্ব বিষয়ক গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়েছে, জ্ঞাতি তত্ত্ব দাঁড় করান হয়েছে, জ্ঞাতিত্ব- অধ্যয়ন একটি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, সেগুলো কি পর্যাপ্ত? সাম্প্রতিক কালের জ্ঞাতিত্ব -অধ্যয়নরত বেশ কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, এগুলো পর্যাপ্ত নয়।
সাম্প্রতিক কালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন
জ্ঞাতিত্ব- অধ্যয়ন ধাক্কা খেয়েছে নতুন প্রজনন প্রযুক্তির (new reproductive technology) কারণে। কিন্তু প্রযুক্তিগত আবিষ্কার, উদাহরণস্বরূপ – টেস্ট টিউবে সন্তান প্রসব, এবং আরও নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রসার, কেবলমাত্র একটি দিক। জ্ঞাতিত্ব- অধ্যয়নের ইতিহাস ঘেঁটে এই অধ্যয়ন সম্পর্কে মৌলিক কিছু জিজ্ঞাসা উত্থাপন করেছেন হাল আমলের নৃবিজ্ঞানীরা।

জিজ্ঞাসাগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে পাশ্চাত্য-অপাশ্চাত্যের অসম সম্পর্ক, পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য, পাশ্চাত্যীয় সমাজের ধ্যান-ধারণা বাকী বিশ্বের মানদন্ড হয়ে উঠা, এবং খোদ নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা। এ সকল কারণে, অনেকে মনে করেন জ্ঞাতিত্ব -অধ্যয়নে সংকট দেখা দিয়েছে এবং এই সংকট “জ্ঞাতিত্ব- অধ্যয়ন”র অস্তিত্বকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে তুলেছে।
ভবিষ্যতে নৃবিজ্ঞানের একটি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান হিসেবে এটি আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আবার অনেক নৃবিজ্ঞানী আছেন যাঁরা বিষয়টিকে একেবারে ভিন্ন চোখে দেখেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এই ধাক্কাগুলো জরুরী ছিল, এই জিজ্ঞাসাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে জ্ঞাতিত্বের বিষয়বস্তুকে পুনর্গঠিত করা উচিত। এর ফল, আগামীতে, অর্থবহ জ্ঞাতিত্ব -অধ্যয়ন এবং নৃবৈজ্ঞানিক অনুশীলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
সাম্প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় সাম্প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন অধ্যায়ের সারাংশ – যা সাম্প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন এর অর্ন্তভুক্ত। জ্ঞাতিত্ব রক্ত-সর্ম্পকের সামাজিক সত্তা। এটা প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মাধ্যমে। বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কও জ্ঞাতিত্বের আওতায় পড়ে। কোন ব্যক্তির কার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। আত্মীয়বর্গের মধ্যে সক্রিয় সদস্য হওয়ার জন্য একজনকে অবশ্যই জ্ঞাতিত্বের অবস্থানের অধিকার ও দায়িত্ব এবং জ্ঞাতিবর্গের সদস্যদের মধ্যে প্রথাগত আচরণ সম্পর্কে জানতে হয়। জ্ঞাতিসম্পর্ক, পরিবার ও অন্যান্য সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত দলের মাধ্যমেই লোকজন সাধারণত তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কার্যাদি পরিচালনা করে থাকে।
জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। এই কেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় নৃবিজ্ঞানের শুরু থেকে। সাম্প্রতিককালের নৃবিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, “আদিম” এবং “সভ্য” হিসেবে বিশ্বের সকল সমাজের দ্বিবিভাজন এই কেন্দ্রিকতার কারণ।
বিংশ শতকের শেষ ভাগে জ্ঞাতিত্বের কিছু কেন্দ্ৰীয় মূলনীতি যথা,
(ক) জ্ঞাতিত্ব আদিম সমাজের সামাজিক জীবনকে সংগঠিত করে
(খ) জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র পরিসর এবং
(গ) জ্ঞাতিত্বের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের প্রজনন।
প্রজনন হচ্ছে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। নতুন ধারণায়নের প্রেক্ষিতে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে খুব ভিন্ন ঢংয়ের গবেষণা কাজ ও লেখালেখি তৈরি হয়। আরও সাম্প্রতিককালে, ১৯৯০-এর দশকে, পাশ্চাত্য অপাশ্চাত্যের অসম সম্পর্ক এবং পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য এই দুইটি প্রসঙ্গ জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ক্ষেত্রকে আরও মৌলিকভাবে নাড়া দেয়।

এতে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভিত্তিপ্রস্তর ধাক্কা খায়। নতুন তাত্ত্বিক উদ্ভাবনের আলোকে নৃবিজ্ঞানীরা যুক্তি হাজির করেন যে, জ্ঞাতিত্বের সর্বজনীন সংজ্ঞা: জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে রক্তে অংশীদারিত্বের ব্যাপার, কারা একই রক্তের তা গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে প্রতিষ্ঠিত এই সত্যটি আসলে সর্বজনীন নয়, এটি পাশ্চাত্যীয়।
নৃবিজ্ঞানীরা তাঁদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই ধারণা অপাশ্চাত্য সমাজে আরোপ করে। এই সমালোচনা জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের পাটাতনে আঘাত হানে। আঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে নতুন প্রজনন প্রযুক্তি। অনেকে মনে করেন, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভবিষ্যত নেই। পক্ষান্তরে, কিছু নৃবিজ্ঞানীর ধারণা, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের জ্ঞানের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী ছিল এবং বর্তমানে যে ধরনের তাত্ত্বিক পুনর্মূল্যায়ন চলছে সেগুলো আগামীতে অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক কাজের জন্ম দেবে।
আরও দেখুনঃ