হিব্রু জাতির উৎপত্তি ও ইতিহাস

হিব্রু জাতির উৎপত্তি ইতিহাসের এক রহস্যময় অধ্যায়। ইতিহাসবিদ নৃতত্ত্ববিদরা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে একমত হতে পারেননি জাতির সুনির্দিষ্ট উৎপত্তি সম্পর্কে। নৃতাত্ত্বিক অর্থে হিব্রুরা কোনো একক বিশুদ্ধ জাতি নয়; বরং ভিন্ন ভিন্ন গোত্র জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতিগোষ্ঠী। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, “হিব্রুশব্দটি এসেছে প্রাচীন শব্দ হাবিরু বা আপিরু থেকে, যার অর্থপরদেশীবাভিনদেশে অবস্থানকারী প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের দলিলপত্রেহাবিরুশব্দের ব্যবহার দেখা যায় এমন জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, যারা স্থায়ী বসতবাড়ি না করে ভ্রমণ চারণপশু পালন করে জীবনযাপন করত।

হিব্রু জাতির উৎপত্তি ও ইতিহাস

 

হিব্রু জাতির উৎপত্তি ও ইতিহাস

 

 

আদি আবাসভূমি ও প্রথম আবির্ভাব

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের ধারণা অনুযায়ী, হিব্রুদের আদি আবাসভূমি ছিল আরবের মরুভূমি। তবে ইসরায়েল জাতির মূল প্রতিষ্ঠাতাদের প্রথম সুস্পষ্ট আবির্ভাব ঘটে উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ায়। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১৮০০ সালের দিকে, আব্রাহাম নামক এক নেতার নেতৃত্বে একদল হিব্রু ওই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে আব্রাহামের পৌত্র জেকব (যিনি ইসরায়েল নামেও পরিচিত) একদল অনুসারী নিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেন এবং ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করেন।

 

প্যালেস্টাইন অঞ্চলে প্রবেশ ও ইসরায়েল নামের উৎপত্তি

প্রাচীন প্যালেস্টাইন ছিল ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম উপকূল থেকে লেবানন পর্বতমালার দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত, যা পূর্ব দিকে আরব মরুভূমি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। জেকবের অপর নাম ইসরায়েল” থেকে এই জাতির নামকরণ হয় “ইসরায়েলী”।

খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালের দিকে দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য কিছু ইসরায়েলী গোষ্ঠী, অন্যান্য হিব্রুদের সঙ্গে মিলে মিশরে পাড়ি জমায়। ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সময়ের ফারাও তাদের দাসে পরিণত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০-১২০০ সালের দিকে মোসেস-এর নেতৃত্বে তারা মিশরের দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় এবং সিনাই উপদ্বীপে ফিরে আসে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

ইয়াওয়েহ উপাসনা ও গোত্র ঐক্য

সিনাই অঞ্চলের যাযাবর মেষপালকদের মধ্যে ইয়াওয়েহ্ (যিহোবা) দেবতার উপাসনা প্রচলিত ছিল। মোসেস এই উপাসনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হিব্রু গোত্রকে একত্রিত করেন। এই ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী পরবর্তীকালে কানানভূমি (বর্তমান প্যালেস্টাইন) বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তখন কানানভূমি কয়েক শতাব্দী ধরে সেমিটিক ভাষাভাষী কানানবাসীদের অধীনে ছিল, যারা ব্যাবিলনীয়, হিট্টাইট এবং মিশরীয় সভ্যতার সঙ্গে সংস্পর্শে এসে এক উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। তারা লোহার অস্ত্র তৈরি জানত, উন্নত লেখনপদ্ধতি ব্যবহার করত এবং হাম্মুরাবির আইন নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করেছিল।

 

কানান বিজয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

হিব্রুদের পক্ষে কানানভূমি জয় একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া ছিল। প্রথমদিকে তারা কিছু অনুর্বর উপত্যকা ছাড়া তেমন কোনো ভূখণ্ড দখল করতে পারেনি। তবে যুদ্ধের বিরতিতে তারা কানানবাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস আত্মস্থ করে নেয়।

ফিলিস্তিনদের আগমন ও হিব্রু রাজতন্ত্রের সূচনা

হিব্রুদের কানান বিজয় শেষ হওয়ার আগেই ফিলিস্তিন নামে এক শক্তিশালী জাতি এশিয়া মাইনর ও এজিয়ান সাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে এসে অঞ্চলটি অধিকাংশ দখল করে নেয়। এখান থেকেই প্যালেস্টাইন” নামটির উৎপত্তি।

ফিলিস্তিনদের আগমনে হিব্রুরা ভীত না হয়ে বরং আরও ঐক্যবদ্ধ হয়। এরই ফলে খ্রিস্টপূর্ব ১০২৫ সালের দিকে হিব্রু রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম রাজা ছিলেন সউল। তার আগে বিচারপতিরাই শাসন পরিচালনা করতেন।

 

ডেভিড ও সলোমনের যুগ

সউলকে অপসারিত করে ডেভিড রাজা হন এবং প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। তার রাজত্বকাল হিব্রু ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি ফিলিস্তিনদের শক্তি ভেঙে দেন, বারোটি হিব্রু গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে তোলেন এবং জেরুসালেমকে রাজধানী করেন।

ডেভিডের পুত্র সলোমন ছিলেন ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের শেষ রাজা। লোককাহিনীতে তিনি জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ ও শিক্ষিত শাসক হিসেবে পরিচিত। তার আমলে ব্যাপক দাসশ্রম ব্যবহার হতো—অনেক কানানবাসী দাসে পরিণত হয়েছিল এবং রাজকীয় ও মন্দির নির্মাণে তারা শ্রম দিত।

 

রাজ্যের বিভাজন ও পতন

সলোমনের মৃত্যুর পর বিদ্রোহের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের দশটি গোত্র ইসরায়েল রাজ্য গঠন করে, আর দক্ষিণাঞ্চলের দুটি গোত্র জুডা রাজ্য নামে পরিচিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ সালে আসিরীয়রা ইসরায়েল রাজ্য জয় করে এবং জনগণকে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়—এদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

জুডা রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল, যখন ক্যালডীয় সম্রাট নেবুচাদনেজার জেরুসালেম দখল করে অধিবাসীদের বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যান।

 

পারস্য, গ্রিক ও রোমান যুগ

পারস্যের সম্রাট কাইরাস ক্যালডীয় সাম্রাজ্য জয় করার পর ইহুদিদের মুক্তি দেন। এরপর ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের বিজয় পর্যন্ত প্যালেস্টাইন পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এটি মিশরের টলেমীয় রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান প্রটেক্টরেট হয়।

খ্রিস্টাব্দ ৭০ সালে ইহুদিদের বিদ্রোহ দমনে রোমানরা জেরুসালেম ধ্বংস করে এবং রাজ্যকে রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত করে। রাজনৈতিক সত্তা হারিয়ে ইহুদিরা ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment