আজকের আলোচনার বিষয় হিব্রু সভ্যতা—একটি প্রাচীন ও প্রভাবশালী সভ্যতা, যা বর্তমানের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিল। জাতিগতভাবে হিব্রুরা ছিল একটি মিশ্র জাতি, যারা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে পার্শ্ববর্তী সভ্যতা থেকে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব গ্রহণ করেছিল। প্যালেস্টাইনের জেরুজালেম নগরী ছিল এ সভ্যতার বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু।
হিব্রু মূলত একটি ভাষার নাম, যার অর্থ ‘নিচ বংশের লোক’ বা ‘যাযাবর’। এই নামটি শুধু ভাষাগত পরিচয়ই নয়, বরং তাদের যাযাবর জীবনধারা ও সামাজিক অবস্থানকেও নির্দেশ করে। বর্তমান ইসরায়েলের অধিবাসীরা মূলত এই হিব্রুদের বংশধর। হিব্রু সভ্যতার অবদান প্রধানত ধর্মীয় ক্ষেত্রে হলেও সাহিত্য, দর্শন ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তারা সামান্য কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তাদের ধর্মগ্রন্থ পুরাতন নিয়ম (Old Testament) কেবল একটি ধর্মীয় দলিল নয়, বরং ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবেও আধুনিককালে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। পুরাতন টেস্টামেন্টের বহু ঘটনা আধুনিক সাহিত্যে, চিত্রকলা, নাটক এবং সংগীতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ইসরায়েলের প্রাচীন নগর জেরিকো, যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন নগরী হিসেবে পরিচিত, এখানেই প্রথম নগরসভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
হিব্রু সভ্যতা
হিব্রু সভ্যতার ঐতিহাসিক প্রভাব
নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে হিব্রু সভ্যতা আধুনিক বিশ্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় হিব্রু জাতি পরবর্তীতে ইহুদি (Jewish) নামে পরিচিত হয়। খ্রিস্টধর্মের অনেক মৌলিক নৈতিকতা, আচার ও ধর্মীয় প্রথা হিব্রু ধর্ম থেকে এসেছে।
বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে, যেখানে ক্যালভিনপন্থীরা প্রভাবশালী ছিল, হিব্রুদের নৈতিক দর্শন আইন ও শাসনব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। তবে হিব্রু সভ্যতা শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়নি; তারা মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে বহু উপাদান গ্রহণ করেছিল। তাদের দর্শনে যেমন মিসরীয় প্রভাব ছিল, তেমনি গ্রিক দর্শনের ছোঁয়াও লক্ষণীয়। তবুও, হিব্রুরা নিজেদের ধর্মীয় দর্শন ও সামাজিক নীতিতে মৌলিক অবদান রেখেছিল, যা পরবর্তীকালে বিশ্বসভ্যতায় স্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
হিব্রুদের অবদান
১. প্রশাসনিক অবদান
প্রথমদিকে হিব্রুদের রাজনৈতিক কাঠামো খুব শক্তিশালী ছিল না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা একটি কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলে। রাজা ডেভিড রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক দক্ষতায় একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করেন। তাঁর পুত্র রাজা সলোমন প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করেন এবং সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১২টি প্রদেশে ভাগ করেন।
সলোমন একটি ইহুদি সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেন এবং করব্যবস্থা সংস্কার করেন—যাতে ধনী অঞ্চলগুলো বেশি কর দিত এবং দরিদ্র অঞ্চলগুলোর করভার হ্রাস পেত। এই ব্যবস্থা সাম্রাজ্যের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি সামাজিক ভারসাম্যও রক্ষা করেছিল।
২. ধর্মীয় অবদান
মানবসভ্যতার ইতিহাসে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠায় হিব্রুদের অবদান অসামান্য। তারা প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেছিল—সর্বশক্তিমান একজনই ঈশ্বর। হিব্রু ধর্মের বিকাশে হজরত মুসা (আ.), হজরত দাউদ (আ.) এবং হজরত সোলায়মান (আ.)-এর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত (Torah) বা ওল্ড টেস্টামেন্ট কেবল ধর্মীয় দলিল নয়, বরং এক ঐতিহাসিক সাহিত্যগ্রন্থ হিসেবেও সমান মূল্যবান। এতে ৩৯টি পুস্তকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮৫০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টাব্দ ১৫০ পর্যন্ত সময়ের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে।
হিব্রু ধর্ম পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছিল—
১. মুসাপূর্ব স্তর
২. নির্দিষ্ট দেবতার স্তর
৩. নবিদের আগমনের স্তর
৪. বিদেশি প্রভাবিত স্তর
৫. পারস্য প্রভাবিত স্তর
যদিও ইসলামের নিরাকার আল্লাহর ধারণার বিপরীতে হিব্রুরা জেহোভাকে (Jehovah) আকারবিশিষ্ট এক ঈশ্বর হিসেবে কল্পনা করত, তবুও তাদের একেশ্বরবাদী ধারণা বিশ্বধর্মের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।
৩. দার্শনিক অবদান
গ্রিকদের আগেই হিব্রুরা দর্শনচিন্তা শুরু করেছিল। তাদের দর্শন মূলত নৈতিকতা, মানবজীবনের উদ্দেশ্য ও ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল। Book of Proverbs এবং Apocryphal Book of Ecclesiasticus গ্রন্থ থেকে তাদের প্রাথমিক দর্শনের ধারণা পাওয়া যায়।
হিব্রু দর্শন মতে—
- বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি যন্ত্রবিশেষ, যা নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই আবর্তিত হয়।
- মানুষ অদৃষ্টের দ্বারা পরিচালিত।
- মৃত্যু-পরবর্তী আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই।
তাদের মতে, মানুষের খ্যাতি, ধন-সম্পদ, আনন্দ—সবই ক্ষণস্থায়ী, যা শেষমেশ বিভ্রান্তি ও শূন্যতায় পর্যবসিত হয়।
৪. সাহিত্যিক অবদান
প্রাচ্যের প্রাচীনতম সাহিত্যকর্মের মধ্যে হিব্রু সাহিত্য ছিল উন্নত ও গভীর। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ তাদের সাহিত্যকর্মের প্রধান নিদর্শন পাওয়া যায়। ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও হিব্রু সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল—
- বীরত্বগাথা
- যুদ্ধসংগীত
- ভবিষ্যদ্বাণী
হিব্রু সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন সলোমনের সংগীতমালা, যা প্রাচীন বিশ্বের বিখ্যাত প্রেমের উপাখ্যান হিসেবে পরিচিত। এছাড়া—
- জবের পুস্তক (The Book of Job)
- রাজা ডেভিডের সালমসের পুস্তক (The Book of Psalms)
এসব গ্রন্থে রাজতন্ত্রের রাজনৈতিক কাহিনি, নীতি-নৈতিকতা, নারীর অবস্থান, কুকর্মের প্রতি নিন্দা এবং ন্যায়বিচারের আহ্বান পাওয়া যায়।

নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যের যে সকল প্রাচীন-সভ্যতা আধুনিক বিশ্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে হিব্রু সভ্যতা তাদের অন্যতম (পরবর্তীকালে হিব্রুদের ইহুদি রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে)।
স্মরণ করা যেতে পারে খ্রিস্টধর্মের অনেকখানি পটভূমিই হিব্রুজাতির কাছ থেকে আহরিত হয়েছে। হিব্রুদের নৈতিকতার ধারণা আধুনিক পাশ্চাত্য জাতিসমূহকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, বিশেষত সে সব দেশে, যেখানে ক্যালভিনপন্থীরা শক্তিশালী ছিল।
আরও দেখুন :