হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আধুনিককালের সপ্তদশ শতাব্দীর আগে যে যুগটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রাচুর্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল, সেটি হল হেলেনিস্টিক সভ্যতার যুগ তথা আলেকজান্দ্রীয় যুগ। হেলেনিস্টিক যুগের তিনশ বছরের পরিসরে যতগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সাধিত হয়েছে, নতুন পাথরের যুগের অবসান ও ব্রোঞ্জ যুগের আবির্ভাবের পর থেকে মধ্যযুগের অবসান ও ধনতন্ত্রের উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আর কোনো যুগে তা হয়নি।

হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান

 

হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান

 

হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান

বস্তুত হেলেনিষ্টক যুগের প্রধান না হলে নগরীসমূহ, যথা. আলেকজান্দ্রিয়া, সায়রাকিউস, পার্গামাম প্রভৃতি স্থানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সাধিত হয়েছিল সেগুলি ছাড়া আধুনিককালের অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সাধন সম্ভব হত না। হেলেনিস্টক তথা আলেকজান্দ্রীয় যুগে বিজ্ঞানের এহেন অভূতপূর্ব অগ্রগতির বিশেষ কারণ আছে। আলেকজান্দ্রীয় যুগে সমর্থ গ্রীক সাম্রাজে কৃষি ও বাণিজ্যের বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল, আমরা আগেই দেখেছি। এর ফলে শিল্প উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির মানসে শ্রমবিভাগও এ যুগে বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেমন, যারা পাথর কাটত তারা হাতিয়ারে শান দিত না। এ যুগে শিল্পে দাসশ্রম নিয়োগের প্রথাও সাময়িকভাবে কমে গিয়েছিল, শ্রমিকরা ছিল স্বাধীন মানুষ। এ রকম সামাজিক পরিবেশ কারিগরি আবিষ্কারের অনুকূল। হচ্ছে, গ্রীক জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে ক্যালডীয় ও মিশরীয় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা এ যুগে বিশেষ উদ্দীপনা লাভ করে।

আলেকজান্দ্রীয় যুগে যে সকল বিজ্ঞানের বিশেষ চর্চা হয়েছিল, সেগুলি হল জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোল, চিকিৎসাবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা। ধাতুবিদ্যার কথা বাদ দিলে, রসায়নবিদ্যা প্রায় অজ্ঞাতই ছিল। জীববিদ্যারও বিশেষ চর্চা হয়নি। তবে এ যুগের একজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন যে, উদ্ভিদেরও যৌন বিভাগ অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষে ভেদ আছে। এটি নিঃসন্দেহে জীববিদ্যার একটি বড় আবিষ্কার। উল্লেখ করা যেতে পারে, এ্যারিস্টটল মনে করতেন যে, উদ্ভিদের মধ্যে যৌন বিভাগ নেই।

সে যুগের শিল্প ও বাণিজ্যের সাথে রসায়ন ও জীববিদ্যার বিশেষ সম্পর্ক ছিল না বলে এ দুই শাস্ত্রের কোনো বাস্তব উপযোগিতা আছে বলে মনে করা হত না। সম্ভবত এ কারণেই এ দুই বিজ্ঞানের বিশেষ কোনো চর্চা আলেকজান্দ্রীয় যুগে হয়নি। আলেকজান্দ্রীয় যুগের প্রথম দিকের একজন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ হলেন সামোসের এ্যারিস্টার্কাস (৩১০-২৩০ খ্রিঃপূঃ)। তাঁকে প্রায়শ হেলেনিস্টিক যুগের কোপার্নিকাস নামে অভিহিত করা হয়।

এর কারণ হচ্ছে, তিনি সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে আবর্তন করে। দুঃখের বিষয় যে, তাঁর পরবর্তী জ্যোতির্বিদরা এ সঠিক মতকে গ্রহণ করেননি। কারণ এ মত ছিল এ্যারিস্টটলের শিক্ষার বিরোধী এবং গ্রীকদের মানবকেন্দ্রিক চিন্তারও বিরোধী। তা ছাড়া ইহুদী ও প্রাচ্যবাসীদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গেও সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এ কারণে এ্যারিস্টার্কাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রচলিত হতে পারেনি।

হেলেনিস্টিক যুগের অপর গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিদ হলেন হিপার্কাস (১৯০-১২০ খ্রিঃপূঃ)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করেন। তিনি জ্যোতিষীয় পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত এ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, চন্দ্রের ব্যাসের প্রায় সঠিক মান নির্ণয় করেন, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেন এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন।

অবশ্য পরবর্তীকালে আলেকজান্দ্রিয়ায় শেষ বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ টলেমীর খ্যাতির কাছে হিপার্কাসের খ্যাতি ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ক্লডিয়াস টলেমী দ্বিতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ায় জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। টলেমীর নিজের মৌলিক আবিষ্কারের সংখ্যা বেশি নয়, কিন্তু তিনি অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে সূত্রবদ্ধভাবে উপস্থাপিত করেন। টলেমীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদা বিষয়ক গ্রন্থের নাম ‘আল মাজেস্ট’।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এ গ্রন্থটি ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বের ভিত্তিতে রচিত। টলেমীর এ গ্রন্থখানি মধ্যযুগের ইউরোপে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার সারসঙ্কলন হিসাবে সমাদৃত হয়েছিল। হেলেনিস্টিক যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত গণিতবিদ ছিলেন ইউক্লিড (আনুমানিক ৩২৩-২৮৫ খ্রিঃপুঃ) তাঁর রচিত ‘এলিমেন্টস’ নামক জ্যামিতি গ্রন্থখানি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ পর্যন্ত জ্যামিতিবিষয়ক মূল গ্রন্থরূপে সমাদৃত হয়েছে। ইউক্লিডকে ভুলক্রমে গ্রীক জ্যামিতির প্রতিষ্ঠাতারূপে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

আসলে তাঁর গ্রন্থে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের আবিষ্কৃত উপপাদ্য প্রণালীবদ্ধভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে মাত্র। ইউক্লিডের জ্যামিতির অধিকাংশ উপপাদ্যই থালেস, পিথাগোরাস প্রমুখ গণিতবিদদের আবিষ্কৃত, কিন্তু সে সমস্ত উপাপাদ্যকে সূত্রবদ্ধভাবে উপস্থাপন করার বিশেষ প্রণালীটি ইউক্লিডের নিজস্ব অবদান । হেলেনিস্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক গণিতবিদ ছিলেন হিপার্কাস। তিনি সমতলীয় ও বৃত্তীয় ত্রিকোণমিতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

আলেকজান্দ্রীয় যুগের একজন শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ছিলেন আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২ খ্রিঃ পূঃ)। তিনি জ্যামিতি ও ঘন জ্যামিতির অনেক প্রতিজ্ঞার প্রমাণ আবিষ্কার করেছিলেন। সংখ্যাতত্ত্বের গবেষণার সূত্রে তিনি সূচক৷ নিয়মের আবিষ্কার করেছিলেন। আর্কিমিডিস হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের অন্যতম। তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পরে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। এ যুগের অপর একজন বিখ্যাত গণিতবিদ হলেন এপোলোনিয়াস (আনুমানিক ২৬২-২০০ খ্রিঃ পূঃ)।

জ্যামিতিতে তাঁর অনেক মৌলিক অবদান আছে। হেলেনিস্টিক যুগে ভূগোলবিদ্যায় বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল ইরাটোস্থেনিস-এর দরুণ। ইরাটোস্থেনিস (আনুমানিক ২৭৬-১৯৫ খ্রিঃ পূঃ) ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ও একাধারে জ্যোতির্বিদ, কবি ও ভাষাতাত্ত্বিক। কয়েকশ’ মাইল তফাতে দুটো সূর্যঘড়ি স্থাপন করে তার থেকে হিসাব করে তিনি পৃথিবীর পরিধির দৈর্ঘ্য নিরূপণ করেছিলেন।

ভূপৃষ্ঠকে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে বিভক্ত করে তিনি ভূপৃষ্ঠের নিখুঁত মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। তিনি এ তত্ত্বের উদ্‌গাতা ছিলেন যে, পশ্চিম দিকে যাত্রা করে ভারতবর্ষে পৌঁছান সম্ভব। আলেকজান্দ্রীয় যুগে চিকিৎসাবিদ্যায় বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে হিরোফিলাস-এর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের শুরুতে আলেকজান্দ্রিয়ায় গবেষণায় রত ছিলেন। শারীরস্থান বা এ্যানাটমি বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।

তিনি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের নিখুঁত বিবরণ প্রদান করেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে, ধমনীর মধ্যে দিয়ে হৃৎপিণ্ড থেকে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। হিরোফিলাসের সুযোগ্য সহকর্মী ছিলেন ইরাসিটেটাস। তিনিও খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেরই মধ্যভাগে আলেকজান্দ্রিয়াতে গবেষণা পরিচালনা করেন। ইরাসিটেটাসকে শারীরবৃত্ত বা ফিজিওলজির প্রতিষ্ঠাতারূপে গণ্য করা হয়।

তিনি শুধু মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদই করেননি, জীবন্ত প্রাণীদেহ ব্যবচ্ছেদ করে তিনি দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন । তিনি হৃৎপিণ্ডের কপাটিকা আবিষ্কার করেছিলেন, চালক স্নায়ু এবং অনুভূতিবাহী স্নায়ুর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছিলেন এবং ধমনী ও শিরার শাখা-প্রশাখাগুলি যে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সাথে যুক্ত হয় এ সত্য আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি রক্তমোক্ষণ দ্বারা চিকিৎসা করার অসারতা প্রতিপন্ন করেছিলেন।

 

হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান

 

বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস (আনুমানিক ২৮৭-২১২ খ্রিঃ পূঃ) পদার্থবিদ্যাকে দর্শন থেকে পৃথক একটি বিদ্যা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আর্কিমিডিস ভাসমান পদার্থের নিয়ম এবং স্থিতিবিদ্যার অনেকগুলি নিয়ম আবিষ্কার করেন। তিনি অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি আবিষ্কারও সাধন করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার হিরো নামক বিজ্ঞানী অনেকগুলি যান্ত্রিক আবিষ্কার সাধন করেছিলেন। হিরো ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর লোক।

তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে উন্নত ধরনের সাইফন, পানিচালিত অর্গান বাদ্যযন্ত্র, জেট ইঞ্জিন ইত্যাদি বহু কিছু। প্রতিকূল সামাজিক আবহাওয়ার জন্য হিরোর যান্ত্রিক আবিষ্কারসমূহ ঐ সময়ে কোনো কাজে লাগেনি। তথাপি সে যুগে এতগুলি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারসাধন সত্যই বিস্ময়কর।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment