নৃবিজ্ঞান ইউনিট সূচিপত্র

আমাদের আজকের আর্টিকেল নৃবিজ্ঞান ইউনিট সূচিপত্র নিয়ে। নৃবিজ্ঞান ইউনিট নিয়ে আমাদের করা সকল আর্টিকেল এর লিংক নিম্নে পেয়ে যাবেন।

নৃবিজ্ঞান কি?

আক্ষরিক অর্থে নৃবিজ্ঞান (ইংরেজি ভাষায় Anthropology) মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। নৃবিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো অতীত ও বর্তমানের মানব সমাজ ও মানব আচরণকে অধ্যয়ণ করা । কিন্তু মানুষ বিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির চেয়ে এটির পরিধি ব্যাপকতর। বিশ্বের সকল অঞ্চলের, সংস্কৃতির মানুষকে নিয়ে এই বিজ্ঞানে গবেষণা করা হয়।

লক্ষ কোটি বছর ধরে মানুষের বিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের গবেষণাও নৃবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। নৃবিজ্ঞানে মানুষকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা করা হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ও তাদের সব রকমের অভিজ্ঞতা নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। নৃবিজ্ঞানীরা কোন একটি বিশেষ মানব সম্প্রদায়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে ও সেগুলি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা সামাজিক রীতিনীতি হতে পারে।

নৃবিজ্ঞান ইউনিট সূচিপত্র

 

 

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ফলিত গবেষণা এবং নৃবিজ্ঞান সূচিপত্র

আরও দেখুনঃ

ঐতিহাসিক গবেষণা

আজ ঐতিহাসিক গবেষণা নিয়ে আলোচনা হবে। এই পাঠটি “নৃবিজ্ঞান পরিচিতি” বিষয়ের “সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি” বিভাগের একটি পাঠ। সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। তাঁদের বেলায় গবেষণার অর্থ হতে পারে প্রথাগত মাঠকর্মের পরিবর্তে সরকারী মহাফেজখানাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাসঙ্গিক দলিলপত্রের সন্ধান করা এবং সেসব দলিলপত্র পর্যালোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করা।

ঐতিহাসিক গবেষণা

 

সংশ্লিষ্ট সময়কালের সরকারী নথিপত্র থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত দিনপঞ্জী, চিঠিপত্র সব ধরনের দলিলই ঐতিহাসিক গবেষণায় তথ্যের ‘উৎস’ হিসাবে গণ্য হতে পারে। তবে এসব উৎস খুঁজে বের করতে পারা গবেষণার প্রাথমিক ধাপ মাত্র, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল উৎসসমূহ ভাল করে পরীক্ষা করে প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা, এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খন্ডচিত্রসমূহ মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যতটা সম্ভব একটা পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো।

অতীতে যখন প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে তথাকথিত আদিম সমাজসমূহ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উপর নৃবিজ্ঞানে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত, তখন অনেক নৃবিজ্ঞানীরই লক্ষ্য ছিল আদি-অকৃত্রিম অবস্থায় রয়ে গেছে, এমন জনগোষ্ঠীর সন্ধান করা। আর ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে সূচিত কোন পরিবর্তন যদি নৃবিজ্ঞানীদের চোখেও পড়ত, সেগুলোর প্রতি তাঁরা যথেষ্ট আগ্রহ বা মনোযোগ দেখান নি।

সাম্প্রতিককালের ইতিহাস-মনস্ক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা তাই অনেকেই পরীক্ষা করে দেখছেন, তাঁদের পূর্বসূরীদের বর্ণিত তথাকথিত আদিম সমাজসমূহ আসলেই কতটা আদি ও অকৃত্রিম অবস্থায় ছিল। এ ধরনের গবেষণা থেকে সাধারণভাবে এই উপলব্ধি ব্যাপকতা

পেয়েছে যে, প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সনাতনী বাস্তবতা হিসেবে যেসব বিবরণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অনেকক্ষেত্রে আসলে ঔপনিবেশিক সময়কালের বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। এ ধরনের উপলব্ধি অনেক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীকে ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে।

 

 

গবেষণার রাজনৈতিক ও নৈতিক দিক:

‘গিনি পিগ’ কথাটার সাথে আপনি নিশ্চয় পরিচিত। গবেষণাগারে গিনি পিগের মত প্রাণীদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয় মানুষের প্রয়োজনে। এ ধরনের গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার লোক একেবারে বিরল নয়, যদিও সংখ্যায় তারা কম।

কিন্তু যদি এমন কথা শোনা যেত যে সামাজিক গবেষণার নামে জীবন্ত মানুষদেরই ‘গিনিপিগ’ বানানো হয়েছে, তাহলে সেটা নিশ্চয় কারো কাছে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হত না। সামাজিক বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় মানব সমাজের উপর এ ধরনের কোন পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালান না ঠিকই, তবে অনেকসময় পরোক্ষভাবে তাঁরা এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকেন। যেমন, আপনি নিশ্চয় জানেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু স্থানে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।

এসব প্রকল্প অনেকক্ষেত্রেই হয়ে থাকে পরীক্ষামূলক, যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। এমনটা অনেক সময়ই দেখা যায় যে, সমাজের কোন প্রভাবশালী গোষ্ঠী চায় বিশেষ কোন প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক, কারণ তারা এতে নিজেরা লাভবান হবে, অন্যদিকে সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন অন্যদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ধরা যাক, এ ধরনের কোন বিতর্কিত প্রকল্প মূল্যায়নের কাজে একজন সামাজিক বিজ্ঞানীকে সম্পৃক্ত করা হল। তিনি কাদের পক্ষ অবলম্বন করবেন? নীতিগতভাবে সামাজিক বিজ্ঞানী অবশ্যই নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন তুলে ধরবেন।

কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানীরাও যেহেতু সমাজেরই অংশ, তাঁদেরও বিশেষ কোন মূল্যবোধ, মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে যা গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ধরনের বিষয় বিবেচনা করে অনেক সামাজিক বিজ্ঞানীই মনে করেন যে, বস্তুনিষ্ঠ বা মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ সামাজিক গবেষণা বলে আসলে কিছু নেই, থাকতে পারে না।

এ ব্যাপারে ভিন্নমতের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, যে বৃহত্তর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হয়, তা পরীক্ষা করে দেখা সামাজিক বিজ্ঞানীদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা যেহেতু ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তিক ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠীদের মাঝে গবেষণা করেছেন, উপরের প্রশ্নগুলো তাঁদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। অনেক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীই মনে করেন যে তাঁরা একধরনের সাংস্কৃতিক অনুবাদকের ভূমিকা পালন করেন।

ঐতিহাসিকভাবে এই ভূমিকাটা হয়েছে একমুখী, অর্থাৎ পশ্চিমা নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অপশ্চিমা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বোধগম্য করে তুলেছে নিজেদের সমাজে, কিন্তু এর উল্টো ভূমিকা তাঁরা সাধারণভাবে পালন করেননি। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অনেক নৃবিজ্ঞানীই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার জন্য ফরমায়েশী গবেষণার কাজ করেছেন।

এ ধরনের গবেষণায় নৃবিজ্ঞানীরা সাধারণতঃ মনে করেন যে তাঁরা গবেষণা এলাকার জনগোষ্ঠীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন, অনেক সময় তাঁরা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের মুখপাত্র হিসাবেও নিজেদের গণ্য করেন। তবে ইদানীং নৃবিজ্ঞানীদের মাঝে এই উপলব্ধি বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, কোন জনগোষ্ঠী, সেটা আয়তনে যত ক্ষুদ্র বা সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যত সরলই হোক না কেন, আসলে সম্পূর্ণ সমরূপ না। কাজেই নৃবিজ্ঞানীরা যেটাকে স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গী হিসাবে তুলে ধরছেন, সেটা যে অনেক সময় স্থানীয় মানুষদের শুধু একটা অংশেরই দৃষ্টিভঙ্গী হতে পারে

(স্থানীয় প্রেক্ষিতে ক্ষমতাবানদের, পুরুষদের, ইত্যাদি), এই সম্ভাবনাও তলিয়ে দেখার তাগিদ স্বীকৃতি পেয়েছে। স্পষ্টতই, নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় এধরনের অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া পদ্ধতিগতভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরী, যাতে করে গবেষকের একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকে গবেষণার সার্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে।

 

 

গবেষণার সারাংশ:

প্রতিটা জ্ঞানকান্ডেই নির্দিষ্ট কিছু গবেষণা পদ্ধতি রয়েছে। এক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানেরও রয়েছে নিজস্ব কিছু গবেষণা পদ্ধতি, যেগুলোর মধ্যে এথনোগ্রাফিক মাঠকর্ম ও তুলনামূলক পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে ‘মাঠ’ বলতে বোঝায় এমন কোন স্থান বা এলাকা যেখানে গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেখানে বসবাসরত মানুষদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করার এবং তাদের সাথে মেশার, কথা বলার সুযোগ রয়েছে।

এভাবে পর্যবেক্ষণ ও কথোপকথন, সাক্ষাতকার প্রভৃতি কৌশল ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিকে মাঠকর্ম বা মাঠ গবেষণা বলা হয়। আন্তঃসাংস্কৃতিক তুলনা (cross-cultural comparison) সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একটি অন্যতম গবেষণা পদ্ধতি।

মানব জীবনের বিশেষ কোন দিক ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে কি রূপে বিরাজমান ও ক্রিয়াশীল থাকে, তা নৃবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত এথনোগ্রাফিক তথ্যের আলোকে। বৃহদায়তনের কোন সমাজে গবেষণা করতে গেলে সামাজিক বিজ্ঞানীরা প্রায়ই জরীপের সাহায্য নিয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। প্রথাগত মাঠকর্মের পরিবর্তে সরকারী মহাফেজখানাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাসঙ্গিক দলিলপত্রের সন্ধান করা এবং সেসব দলিলপত্র পর্যালোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করা। নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া পদ্ধতিগতভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরী, যাতে করে গবেষকের একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকে গবেষণার সার্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে।

আরও দেখুনঃ

 

সামাজিক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান

আজকের আলোচনার বিষয় সামাজিক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান। সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান দুটিই নৃবিজ্ঞানের শাখা। সামাজিক নৃবিজ্ঞান (Social Anthropology) নৃবিজ্ঞানের একটি শাখা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে এই বিষয়টির অধ্যয়নের সূত্রপাত হয়। এর জনক হলেন ব্রনিসলাউ মলিনস্কি। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের আলোচনা মূলত মানুষের মাঝে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপরে নিবদ্ধ। এটি সামাজিক নৃবিজ্ঞানের বিপরীত। এর আলোচনা মূলত নৃতত্ত্বকে ধ্রুবক ধরে এর একটি অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আলোচনা করা। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একটা সমৃদ্ধ প্রণালী রয়েছে গবেষণার।

সামাজিক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান

 

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

সামাজিক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান:

সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান হচ্ছে নৃবিজ্ঞান চর্চার যথাক্রমে ব্রিটিশ ও মার্কিন এতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত দুটি ঘনিষ্ঠ ধারা। নামকরণের পার্থক্য সত্ত্বেও শুরু থেকেই সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের মধ্যে সুস্পষ্ট কোন সীমারেখা ছিল না। (আপনারা যদি বাজারে প্রচলিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একাধিক পাঠ্যবই মিলিয়ে দেখেন, তাহলে লক্ষ্য করবেন যে, কোন পাঠ্য বইয়ের শিরোনামে হয়ত শুধু সামাজিক নৃবিজ্ঞান, এবং আরেকটাতে হয়ত শুধু সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান রয়েছে, কিন্তু সূচাপত্রে অন্তর্ভূক্ত বিষয়গুলোর তালিকা কমবেশী একইরকমই পাবেন।)

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, উভয় ধারার নৃবিজ্ঞানেরই সূচনা হয়েছিল সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপত্তি সম্পর্কে উনবিংশ শতান্দীতে প্রচলিত বিভিন্ন অনুমাননির্ভর তত্তের বিরোধিতা করে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহের উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে।সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে যথাক্রমে ‘সমাজ’ ও “সংস্কৃতি প্রত্যয়ের উপর প্রাধান্য দেওয়া হলেও উভয় ধারার নৃবিজ্ঞানীরাই এই বিষয়গুলি অধ্যয়নের জন্য তথাকথিত আদিম জনগোষ্ঠীদের উপরই বেশী নজর দিয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, “আদিম” বলে বিবেচিত বিভিন্ন সমাজ ও তাদের সংস্কৃতির তুলনামূলক অধ্যয়নই একটা সময় পর্যন্ত সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের মূল পরিচায়ক ছিল। উভয় ধারার নৃবিজ্ঞানেই বিভিন্ন আদিম সমাজের জ্ঞাতিব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংগঠন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়েছে।এসব কারণে, যেমনটা ইতোমধ্যে আপনারা জেনেছেন, মার্কিন ধারার সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞানকে একই বৃহত্তর ধারার অন্তর্পত হিসাবে গণ্য করা হয়, যাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান হিসাবে অনেকেই অভিহিত করে থাকেন।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সংস্কৃতির সংজ্ঞায়ন ও এই ধারণার উপর গুরুতারোপের ক্ষেত্রে মার্কিন নৃবিজ্ঞানীরা অনেকটা ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী টায়লরের এঁতিহ্য অনুসরণ করেছেন, (টায়লরের দেওয়া সংস্কৃতির সংজ্ঞা আগেই উদ্ধৃত করা হয়েছে পাঠ ১-এ)।অন্যদিকে জ্ঞাতিসম্পর্কের মত বিষয় অধ্যয়নের উপর নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা অনেকটা মার্কিন নৃবিজ্ঞানী মর্গানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন।

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটেনে যারা সামাজিক নৃবিজ্ঞানী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করেছিলেন, তারা মনে করতেন যে তাদের অধ্যয়নের মূল বিষয় ছিল “সমাজ’, বিশেষ করে “আদিম সমাজ’। উল্লেখ্য, সমাজ অধ্যয়নের জন্য সমাজবিজ্ঞান (sociology) নামে একটি জ্ঞানকান্ড ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ মাত্রই যে কোন না কোন সমাজের সদস্য, এই সত্যটা উপলব্ধি করার জন্য আমাদের সমাজ বিজ্ঞান পড়ার দরকার পড়ে না।

আপনার আমার প্রত্যেকেরই নিজ নিজ সমাজ সম্পর্কে এক ধরনের জ্ঞান আছে, যা আমরা সমাজের সদস্য হিসাবে অর্জন করি। তবে সচরাচর আমরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতার বাইরে “সমাজ’ ধারণা নিয়ে বিমূর্তভাবে ভাবি না, বা পুরো সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে সংগঠিত, এটির বিভিন্ন অংশ কি কি এবং সেগুলি কীভাবে কাজ করে, কখন বা কেন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে, এ ধরনের প্রশ্ন নিয়ে সচেতনভাবে ভাবি না। এ কাজটাই করার চেষ্টা করেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

জ্ঞানচর্চার একটি পৃথক শাখা হিসাবে সমাজবিজ্ঞানের অস্তিত সবসময় ছিল না। এটির জন্ম হয়েছিল ইউরোপে, যখন শিল্পায়নসহ বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ইউরোপীয় সমাজসমূহ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। পথিকৃৎ সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করতেন যে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে যেভাবে অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে বিশ্ব-্রব্রহ্মান্ড ও জীবজগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তেমনি সমাজকে বস্তুনিষ্ঠভাবে জানা সম্ভব।

সেজন্য চাই যথাযথভাবে নিরূপিত প্রত্যয়, তত্ব ও গবেষণা পদ্ধতির প্রয়োগ। এভাবে পরিবর্তনশীল ইউরোপীয় সমাজসমূহকে ভাল করে জানা ও বোঝার তাগিদ থেকে জন্ম হয়েছিল সমাজবিজ্ঞানের। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃৎদের অন্যতম ছিলেন ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী ডূর্খাইম, যার চিন্তাভাবনা সরাসরি প্রভাবিত করেছিল ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা র্যাডক্লিফ-ব্রাউনকে। ফলে অনেক দিক থেকে ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞান গড়ে উঠেছিল সমাজবিজ্ঞানের আদলেই।

দু”য়ের মধ্যে মূল পার্থক্য যা ছিল তা হল, যেখানে সমাজবিজ্ঞানীদের নজর ছিল শিল্পায়িত সমাজগুলোর প্রতি, সেখানে সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ইউরোপের উপনিবেশগুলোতে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত সরল বা আদিম বলে বিবেচিত সমাজগুলোকে। নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের সমাজে ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞন গড়ে উঠেছিল সংগঠনের প্রধান ভিত্তি। ফলে সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সমাজের সমাজবিজ্ঞানের আদলেই।

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

দুয়ের মধ্যে মূলের উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। তারা দেখার চেষ্টা করেছেন, বংশধারা নানা বেখনেহ ব্যবস্থা প্রভৃতি কিভাবে উৎপাদন, বণ্টন, ক্ষমতা, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ের সাথে গবেষণাক্ষেত্র হিসাবে বেছে রোগের উপনিবেশগুলোতো ্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের সূচনাকালেও গবেষকদের দৃষ্টি ছিল প্রযুক্তি বা সামাজিক কৃত সরল বা আদিম বলে[রে অপেক্ষাকৃত “আদিম” বলে বিবেচিত সেদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের প্রতি। বিবেচ্তি সমাজওলোকে।

তারা “সংস্কৃতির ধারণাকে কেন্দ্র করে তাদের গবেষণা ও লেখালেখি সংগঠিত বলে বিবেচিত সেদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের প্রতি। পার্থক্য ছিল এই যে, তাঁরা সংস্কৃতির ধারণাকে কেন্দ্র করে তাঁদের গবেষণা ও লেখালেখি সংগঠিত করেছিলেন।

করোছলেনা বলা বাহুল্য, প্রচলিত অর্থে সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, তার থেকে ভিন্ন বা ব্যাপকতর অর্থে নৃবিজ্ঞানীরা শব্দটিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, প্রচলিত ব্যবহারে সংস্কৃতি শব্দটি নৃত্য-গীত জাতীয় বিষয়কেই নির্দেশ করে। আমরা যখন কোন “সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’-এর কথা বলি, অথবা যখন কোন ব্যক্তি বা পরিবারকে “সংস্কৃতিমনা” হিসাবে চিহ্নিত করি, তখন শব্দটিকে এ ধরনের একটি বিশেষ অর্থেই ব্যবহার করি।

ইংরেজীসহ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায়ও সংস্কৃতির সমার্থক শন্দসমূহ শুরুতে মূলতঃ এরকম প্রচলিত অর্থেই ব্যবহৃত হত, ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশকে তথা বিভিন্নসমাজকে সাংস্কৃতিক মানদন্ডে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট হিসাবে দেখার প্রবণতা ছিল। বিশেষ করে ও্পনিবেশিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া ইউরোপীয় বংশোভভূত শ্বেতাঙ্গ মানুষদের চোখে উপনিবেশসমূহের আদিম অধিবাসীদের সংস্কৃতি ছিল খুবই নিয়মানের।

সাধারণভাবে প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজের সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি আচার-প্রথা ইত্যাদি-_অর্থাৎ এক কথায় তার নিজের সংস্কৃতি-স্বাভাবিক বলে মনে হয়, এবং ভিন্ন কোন সংস্কৃতির মুখোমুখি হলে সেটার অনেক কিছুকে অস্বাভাবিক বা অদ্ভূত বলে মনে হতে পারে। এই প্রবণতাকে নৃবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন স্বজাতিকেন্দ্রিকতা (ethnocentrism)। মানুষ হিসাবে একজন নৃবিজ্ঞানীর মধ্যেও স্বজাতিকেন্দ্রি প্রবণতা থাকতে পারে, যা ভিন্ন একটি সংস্কৃতিকে জানতে বুঝতে গেলে অন্তরায় হয়ে দীড়াতে পারে, বিশেষ করে তা যদি হয়

আদিম বলে বিবেচিত কোন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। এই প্রেক্ষিতে আধুনিক মার্কিন নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঞ্জ বোয়াস ও তার অনুসারীরা “সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ” (cultural relativism) নামে পরিচিত হয়ে ওঠা একটি দৃষ্টিভঙ্গীর উপর জোর দিয়েছিলেন, যেটার মোদ্দা কথা হল কোন ভিন্ন সংস্কৃতিকে অধ্যয়ন করতে হলে এঁ সংস্কৃতির ধারক বাহকদের দৃষ্টিকোণ থেকেই সেটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানার এবং ভাল করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও মার্কিন ধারার সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে “সমাজ ও “সংস্কৃতি” ধারণার আপেক্ষিক গুরুত নিরূপণের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য থেকে থাকতে পারে, কিন্তু কোন ধারাতেই একটি ধারণাকে বাদ দিয়ে শুধু অন্যটির উপর জোর দেওয়া হয় নি। (মানুষ সংস্কৃতি শেখে সমাজের সদস্য হিসাবে, কাজেই সমাজের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সংস্কৃতির কথা বলা অর্থহীন। আবার সংস্কৃতির ধারণা বাদ দিলে মানব সমাজের বৈশিষ্ট্য বোঝা সম্ভব না, কারণ মানুষ ছাড়াও সমাজবদ্ধ প্রাণী আরো রয়েছে, কিন্তু একমাত্র মানবসমাজের ক্ষেত্রেই সংস্কৃতির ধারণা প্রযোজ্য।)

উভয় ধারাতেই মূলতঃ আদিম বলে বিবেচিত জনগোষ্ঠীদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালন্ধ তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। একদিকে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের চাপের মুখে আদিবাসী আমেরিকানরা বিলুপ্ত বা আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আগেই সেসব জনগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে যতটা সম্ভব বিস্তারিত ও নিখুঁত দলিল তৈরী করার ব্যাপারে মার্কিন নৃবিজ্ঞানীরা বিশেষ তাগিদ বোধ করেছিলেন।

একইভাবে ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের নৃবিজ্ঞানীরাও মনোযোগী ছিলেন ও্পনিবেশিক সাম্রাজ্যসমূহের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত “আদিম” জনগোষ্ঠীদের সম্পর্কে বিশদ বিবরণ সংগ্রহ করার ব্যাপারে। এভাবে আটলান্টিকের উভয় পারের নৃবিজ্ঞান চর্চার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথাকথিত আদিম জনগোষ্ঠীদের সার্বিক জীবন যাত্রার ধরন, তাদের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনৈতিক সংগঠন, ধমীয়ি বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করার একটা এতিহ্য তৈরী হয়।

এভাবে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিন্তিতে বিভিন্ন সমাজ বা সংস্কৃতি সম্পর্কে আলাদা আলাদা বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে সামষ্টিকভাবে, বা এ প্রক্রিয়ায়  রচিত কোন গ্রন্থকে, নৃবিজ্ঞান  এথনোগ্রাফি বলা হয় (enthnography: এই শব্দের প্রথম উপাদান, ethno-, গ্রীক ভাষা থেকে উদ্ভূত, যার বাংলা অর্থ করা যেতে পারে ‘জাতি’ বা ‘জনগোষ্ঠী”; -graphy বলতে বোঝায় লিখার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি)। এখনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীদের কর্মকান্ডের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে এথনোগ্রাফি রচনা করা, যদিও সমকালীন এথনোগ্রাফিগুলো আগের মত শুধুই তথাকথিত আদিম সমাজগুলোকে ঘিরে তৈরী করা হয় না।

নৃবৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডের একটি গুরত্তপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে এথনোগ্রাফি-চর্চার প্রসারের পেছনে একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন সমাজের তুলনামূলক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্যের একটি ভান্ডার গড়ে তোলা। উনবিংশ শতাব্দীতেই এথনোলজি (ethonology) বা জাতিতত্ত্ব  নামে পরিচিত নৃবিজ্ঞানের একটি বিশেষায়িত শাখা গড়ে উঠেছিল এ ধরনের তুলনামূলক অধ্যয়নকে ঘিরেই।

তবে তখন যে ধরনের তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতিততুবিদরা তুলনামূলক বিশ্লেষণের কাজ করতেন – বণিক, উপনিবেশিক প্রশাসক, পরিব্রাজক, মিশনারী প্রভৃতি শ্রেণীর লোকদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য – সেগুলির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল। এই প্রেক্ষিতে নূতন প্রজন্মের প্রশিক্ষিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীদের রচিত এথনোগ্রাফিগুলি জাতিতাত্তিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তথ্যের অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য উৎস হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে।

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

সেই সূত্রে এথনোগ্রাফি ও এথনোলজিকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের দুইটি পরস্পরসম্পর্কিত ক্ষেত্র বা শাখা হিসাবে অনেকে চিহিতিত করেছেন, আবার অনেকে এথনোলজি কথাটা কমবেশী সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের সমার্থক হিসাবেই ব্যবহার করেছেন। তবে সময়ের সাথে সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের সমার্থক হিসাবে বা এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবে এথনোলজি নামের ব্যবহার প্রায় অপ্রচলিত হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে বিষয়-ভিত্তিক বিশেষায়নের মাধ্যমে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান, রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান, ধর্মের নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে।

বিংশ শতাদ্বীর দ্বিতীয়ার্ধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে ইউরোপীয় ওপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো গুটিয়ে নেওয়া হয়েছিল আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাগ্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসারের মুখে। এই প্রেক্ষিতে স্বাধীনতাকামী বা সদ্যস্বাধীন দেশগুলোতে নৃবিজ্ঞানীদের উপস্থিতি প্রশ্নের মুখে পড়তে শুরু করে । এমন অভিযোগ উঠতে থাকে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান আসলে উঁপনিবেশিক-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পক্ষেই কাজ করে।

অন্যদিকে, খোদ পশ্চিমা দেশগুলোতেও বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন দেখা দিয়েছিল, যেমন ষাট ও সত্তরের দশকে সংখ্যালঘু, নারী ও তরুণদের অধিকারের প্রশ্নে অনেকে সোচ্চার হতে শুরু করে। এই ধরনের পরিছিতিতে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানীদের মত নৃবিজ্ঞানীরাও অনেকে নিজেদের জ্ঞানচর্চার এরতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তলিয়ে দেখতে শুরু করেন।

এই আত্মসমীক্ষার প্রক্রিয়ায় সব নৃবিজ্ঞানী সমানভাবে শামিল না হলেও ক্রমশঃ এই উপলব্ধি ব্যাপকতা পেতে শুরু করে যে, “আদিম সমাজ’- কেন্দ্রিক  নৃবিজ্ঞান চর্চার দিন ফুরিয়ে গেছে। ফলে পূর্বের এতিহ্য থেকে সরে এসে অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীই গবেষণার নূতন ক্ষেত্র, নূতন বিষয়, নৃতন পদ্ধতি ও নৃতন তাত্তিক কাঠামোর অনুসন্ধান করেছেন। এই অনুসন্ধানের ফলাফল স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা যাবে না, তবে সংক্ষেপে কিছু প্রবণতার কথা উল্লেখ করা যায়।

সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করেন সম্ভাব্য সব ধরনের গবেষণাক্ষেত্রে – সেটা হতে পারে কৃষক অধ্যুষিত কোন গ্রাম, শহরের মধ্যবিত্ত-অধ্যুষিত কোন এলাকা, কোন বাণিজ্যিক কেন্দ্র বা শিল্পাঞ্চল। এগুলো হল বাহ্যিক পরিসরে নৃবিজ্ঞানীদের বিচরণের নৃতন ক্ষেত্র। গবেষণার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা তাত্বিক ও পদ্ধতিগতভাবেও সমকালীন নৃবিজ্ঞানীদের বিচরণের পরিধি অনেক বেশী উন্মুক্ত। পরিবারে লিঙ্গীয় অসমতা থেকে শুরু করে বিশ্বায়ন, সব ধরনের বিষয় নিয়ে তারা গবেষণা করেন।

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

তাত্তিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে কেউ নিজেকে চিহ্নিত করতে পারেন নারীবাদী হিসাবে, পরিবেশবাদী হিসাবে, বা উত্তর-আধুনিকতাবাদী হিসাবে। নৃবিজ্ঞানী পরিচয়ধারী এমন গবেষককেও আপনি খুঁজে পাবেন যিনি “মাঠে? নয়, পরতিহাসিক দলিলপত্রের সংগ্রহশালাতেই সময় কাটাচ্ছেন। মোট কথা, সমকালীন প্রেক্ষিতে একজন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী কোন্‌ কোন্‌ দিক থেকে একজন অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদের থেকে আলাদা, তা সবক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া যাবে না।

সারাংশ:

সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক হবিজ্ঞান হচ্ছে নৃবিজ্ঞান চচার্র যথাক্রমে বিটিশ ও মাকিন এতিহোর সাথে সম্পকিতি দুটি ঘনিষ্ঠ ধারা।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, উভয় ধারার নৃবিজ্ঞানেরই সূচনা হয়েছিল সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান বা সামাজিক এতিষ্ঠানসমূহের উৎপত্তি সম্পকে উনবিংশ শতাব্দীতে এচলিত বিভিন্ন অনুমাননিভর তত্ত্বের বিরোধিতা করে প্রত্যক্ষ পরর্বেক্ষণের মাধ্যমে উপাত সংগ্রহের উপর জোর দেওয়ার মাধামে। সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে যথাক্রমে ‘সমাজ’ ও ‘সংস্কৃতি’ প্রত্যয়ের উপর প্রাধান দেওয়া হলেও উভয় ধারার নৃবিজ্ঞােনীরাই এই বিষয়গুলি অধ্যয়নের জন্য তথাকথিত আদিম জনগো্ঠীদের উপরই বেশী নজর দিয়েছিলেন।

মাকিনি ধারার সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞানকে একই বৃহত্তর ধারার আন্তর্গত  হিসাবে গণ্য কর৷ হয়, যাকে সামাজিক-সাংক্কৃতিক নৃবিজ্ঞান হিসাবে অনেকেই অভিহিত করে থাকেন।

সামাজিক/সাংসকৃতিক নৃবিজ্ঞান

মাকিন যুক্রাে সাংস্কৃতিক হৃবিজ্ঞানের সূচনাকালেও গবেষকদের দৃষ্টি ছিল এয়ুক্তি বা সামাজিক সংগঠনের ধরন অনুসারে অপে্গকৃত ‘আদিম’ বলে বিবেচিত সেদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের এরতি।ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও মাকিন ধারার সাংস্কৃততিস নৃবিজ্ঞানে ‘সমাজ’ ও “সংস্কৃতি ধারণার আপেক্ষিক গুরণ্ত নিরূপণের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য থেকে থাকতে  পারে, কিত কোন ধারাতেই একটি ধারণাকে বাদ দিয়ে শুধু অন্যটির উপর জোর দেওয়। হয় নি। উভয় ধারাতেই মূলতঃ আদিম বলে বিবেচিত জনগোষ্ঠীদের সম্পকে ধ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব তথ্য সংগরহের উপর জোর দেওয়। হয়েছে।

সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক হৃবিজ্ঞানীর৷ কাজ করেন সম্ভাব্য সব ধরনের গবেষণাক্ষেত্রে – সেটা হতে পারে কৃষক অধ্যুষিত কোন এম, শহরের মধ্যবিত-অধ্যষিত কোন এলাকা, কোন বাণিজ্যিক কেন্দ্র বা শিল্পাঞ্চল। গবেষণার বিষয় নিধার্রণের ক্ষেত্রে বা তাতিক ও পদ্ধাতিগতভাবেও সমকালীন নৃবিজ্ঞানীদের বিচরণের পরিধি অনেক বেশী উন্মুক।

আরও দেখুনঃ

 

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

আজকের আলোচনার বিষয় দৈহিক নৃবিজ্ঞান। এই পাঠটি “নৃবিজ্ঞান পরিচিতি” বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। দৈহিক নৃবিজ্ঞান মূলত মানুষের মানুষের দৈহিক দিক বা ফিজিক্যাল ফিচার সম্পর্কে আলোচনা করে। মানুষের দৈহিক অর্থাৎ আকার-আকৃতি, বৈশিষ্ট্য, প্রাণী হিসেবে মানুষের পৃথিবীতে – উৎপত্তি, বিবর্তন। আলোচনা করে মানুষের আদিম ও আধুনিক রূপ নিয়ে।

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

 

দৈহিক নৃবিজ্ঞানের সারাংশ:

দৈহিক নৃবিজ্ঞানে যেসব বিষয় অধ্যয়ন করা হয় সেগুলির মধ্যে রয়েছে একটি এরজাতি হিসাবে মানুষের উৎপতি ও বিবতর্নের ইতিহাস, জৈবিক বে বিচারে মানুষের নিকটতম প্রানীদের সাথে মানুষের মিল ও আমিল, এবং দৈহিক ও অন্যান্য  জৈবিক বৈশিষ্ট্যের  প্রেক্ষিতে মানবজাতির মধ্যেকার বৈচিত্র্য।

দৈহিক-নৃবিজ্ঞানে সমকালীন বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যেকার দৈহিক পার্থক্য ও সম্পর্ক নিয়েও গবেষণা করা হয়। এ ধরনের গবেষণায় দীর্ঘকাল যাবত বাহি্যক উপরই নজর কেন্দ্রীভূত ছিল। গায়ের রং চুলের ধরন, চোখ-মুখের গড়ন প্রভৃতির ভিভিতে মানবজাতিকে বিভিন্ন race বা নরবর্ণে বিভক্ত করার রেওয়াজ ছিল।

 

 

প্রকৃতপক্ষে নরবণর্র সজ্ঞা ও শোণীকরণ নিয়ে দৈহিক  নৃবিজ্ঞান  কখনো কোন সবর্জনস্কীকৃত মতামত ছিল না। অধিকন্ত সাম্প্রাতিককালের দৈহিক  নৃবিজ্ঞানীদের  অধিকাংশই নরবর্ণে্র ধারণাকে বিজ্ঞান- সম্মত নয় বলে বাতিল করে দিয়েছেন।

 

 

সমকালীন দৈহিক  নৃবিজ্ঞানের নরবণর্র ধারণা কাযর্ত পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ হল, যেভাবেই নরবণর্র সংজ্ঞা ও শ্রেণীকরণ দাঁড় করানো হোক না কেন, বাস্তবে এক নরবণের্র সাথে আরেক নরবণর্র কোন সুস্পষ্ট সীমারেখা চিহি্ত করা যায় না।

 

বতর্মানে দৈহিক-নৃবিজ্ঞান বা বাহ্যিক দৈহিক বেশিষ্টের চাইতে মানবজাতির অন্তনির্হিত জেনেটিক (genetic অথাৎ জিন- সংক্রান্ত) বৈচিত্র্য অধ্যয়নের উপর অধিকতর জোর দেওয়া হয়। এ ধরনের পারিবতর্নের আলোকে ইদানীং দৈহিক হাবিজ্ঞানের হলে জৈবিক নৃবিজ্ঞান (biological anthropology) পরিচয়টাই অনেকের কাছে অধিকতর গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে ।

 

দৈহিক নৃবিজ্ঞান:

দৈহিক নৃবিজ্ঞানের সারাংশ: মানুষের দৈহিক দিক সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানের যে শাখা বিস্তারিত আলােচনা করে তাকে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান বলা হয়। এই শাখা মানুষের দৈহিক আকার-আকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং প্রাণী হিসেবে মানুষের পৃথিবীতে উৎপত্তি, বিবর্তন তথা আদিম ও আধুনিক মানুষের বিভিন্ন প্রকরণ সম্পর্কে আলােচনা করে। মানুষের ক্রমবিকাশের ধারা নির্ণয় করতে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান- অস্থি, কংকাল, মাথা, দেহের গঠন প্রণালি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে।

এছাড়া মানুষ পূর্বে কী ছিল, বিবর্তনের মাধ্যমে সে কীরূপ ধারণ করেছে- তা তুলনামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করে জীব জগতের মানুষের স্থান কোথায় তা নির্ণয় করে। এভাবে মানুষের বিবর্তনের হারানাে সূত্র (Missing link) খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।

দৈহিক নৃবিজ্ঞানে যেসব বিষয় অধ্যয়ন করা হয় সেগুলির মধ্যে রয়েছে একটি প্রজাতি হিসাবে মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাস, জৈবিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে মানুষের নিকটতম প্রাণীদের সাথে মানুষের মিল ও অমিল, এবং দৈহিক ও অন্যান্য জৈবিক বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে মানবজাতির মধ্যেকার বৈচিত্র্য। বিষয়বস্তুর কারণে জীববিজ্ঞানের মৌলিক অনেক বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয় দৈহিক নৃবিজ্ঞানীদের। সেসাথে মানব সন্তার জৈবিক ও সাংস্কৃতিক উভয় মাত্রার পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ত বিবেচনায় রাখার তাগিদে নৃবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিভিন্ন প্রত্যয় ও তত্ত সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান রাখতে হয় তাদের।

চার্লস ডারউইন যখন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই তত দেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রমরূপান্তরের মাধ্যমে পৃথিবীতে জীবজগতের বিভিন্ন প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে, তখন ধমীয়ি ব্যাখ্যার বাইরে মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিসার একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া গিয়েছিল।

ততদিনে ভূত্তকের বিভিন্ন গভীর স্তর থেকে বিলুপ্ত অনেক প্রাণী ও উভিদের জীবাশ্মের সন্ধান মিলতে শুরু করেছিল, যেগুলির মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ ও মানব-সদৃশ প্রাণীদের নমুনাও যুক্ত হচ্ছিল (জীবাশ্ন বা fossil হল লক্ষ-কোটি বছর আগেকার কোন প্রাণী বা উভিদের দেহাবশেষ, যা বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে শিলীভূত রূপে ভূত্তকের বিশেষ কোন স্তরে সংরক্ষিত থেকে গেছে)। একটা সময়ে এই ধারণা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতির মত মানুষও বিবর্তনের মাধ্যমেই আজকের রূপে এসে উপনীত হয়েছে।

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

দৈহিক নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে যারা মানব বা মানবসদৃশ প্রাণীদের জীবাশব নিয়ে কাজ করেন, তাদের লক্ষ্য হল প্রাপ্ত নমুনাসমূহের ভিত্তিতে মানব বিবর্তনের ইতিহাসের একটা চিত্র দাড় করানো। তাদের গবেষণার ভিত্তিতে বলা যায়, আজ থেকে আনুমানিক বিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে মানবসদৃশ কিছু প্রাণীর বিচরণ ছিল যেগুলোর মগজের গড় আয়তন মানুষের চাইতে শিম্পাজী-গরিলাদের মত প্রাণীর কাছাকাছি হলেও অন্যান্য দিক থেকে তারা মানুষের মতই ছিল: যেমন তারা দু’পায়ের উপর ভর করে খাড়া হয়ে চলাফেরা করত, এবং খুব সরল ধরনের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত।

এই প্রাণীদের নাম দেওয়া হয়েছে অস্ট্রালোপিথেকাস (australopithecus ল্যাটিন ভাষায় australo – বলতে দক্ষিণাঞ্চলীয় এবং pithecus বলতে ৪১০ শ্রেণীর বানর অর্থাৎ শিম্পাজি, গরিলা প্রভৃতি লাঙ্গুলবিহীন বানরদের বোঝায়। অস্ট্রালোপিথেকাসদের প্রথম নমুনা পাওয়া গিয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ ভাগে, তাই এই নাম করণ)। ধারণা করা হয়, অস্ট্রালোপিথেকাস বর্গের প্রাণীদেরই কোন শাখা থেকে আধুনিক মানুষের পূর্বসূরী প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি ঘটেছে। অস্ট্রালোপিথেকাসদের চাইতে বেশী আয়তনের মস্তিষ্কসম্পন্ন আদি-মানবদের উৎপত্তি ঘটে আনুমানিক দশ থেকে বিশ লক্ষ বছর আগে।

এদের মধ্যে হোমো ইরেকটাস নামে অভিহিত (homo sapiens গ্রীক শব্দ homo অর্থ মানুষ) প্রজাতির আদি-মানবদের জীবাশ্ব পাওয়া গেছে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায়। জাভা মানব, পিকিং মানব প্রভৃতি নামে খ্যাত জীবাশ্বুসমূহ হল এই বর্ণের আদি-মানবদের।

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

ক্রম-বিবর্তনের মাধ্যমে হোমো ইরেকটাস মানবদের থেকেই হোমো সেপিয়েন্স (homo sapiens) নামে অভিহিত আধুনিক মানব প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে আনুমানিক চল্লিশ হাজার থেকে সোয়া লক্ষ বছর আগে। নিয়ানডার্থাল নামে অভিহিত আধুনিক মানব প্রজাতির একটি শাখা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন, এবং তাদের থেকে আলাদা করার জন্য homo sapiens sapiens নামের একটি ভিন্ন শাখার অস্তিত ধরে নেওয়া হয়, যেটা বর্তমানে পৃথিবীর বুকে টিকে আছে।

তবে দৈহিক নৃবিজ্ঞানীদের কারো কারো মতে নিয়ানডার্থাল ধারার মানুষরা একেবারে বিনুপ্ত হয়ে যায় নি, বরং তারা মানব প্রজাতির অন্য শাখার সাথে মিশে বর্তমান যুগের মানুষদের উদ্ভবে ভূমিকা রেখেছে। যাই হোক, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বর্তমান যুগের সকল মানুষই একটি একক প্রজাতির অন্তর্গত, এবং সে হিসাবে সকল মানুষের রয়েছে কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য, যেগুলির উপর দৈহিক নৃবিজ্ঞান আলোকপাত করে।

একটি প্রজাতি হিসাবে মানুষের বিশিষ্টতা বুঝতে গিয়ে দৈহিক নৃবিজ্ঞানীদের অনেকে জীববৈজ্ঞানিক বিচারে মানুষের নিকটতম সমকালীন প্রজাতিদের নিয়েও গবেষণা করেন। প্রাণীবিজ্ঞানীদের শ্রেণীকরণ অনুসারে মানুষ ‘প্রাইমেট” বর্গভুক্ত একটি প্রাণী, যে বর্গের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রজাতির বানর, ৪ বা “বনমানুষ” অর্থাৎ লেজবিহীন বানর, যথা: শিম্পাজী, গরিলা, ওরাঙ উটান, ও গিবন বা উন্লুক, যেগুলো প্রাণীজগতে মানুষের নিকটতম আত্মীয়) এবং লেমুর, ট্রি শ্রু ইত্যাদি আরো কিছু প্রাণী।

অন্যান্য প্রাইমেটদের সাথে মানুষের দৈহিক ও শারীরবৃত্তীয় সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যসমূহের তুলনামূলক অধ্যয়ন করা হয় প্রাণী হিসাবে মানুষের বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের লক্ষ্যে। সেসাথে বানর ও “বনমানুষ’দের সামাজিক আচরণ অধ্যয়নের মাধ্যমেও বোঝার চেষ্টা করা হয় প্রাগৈতাসিক মানুষের সামাজিক সংগঠন কেমন হয়ে থাকতে পারে, এবং কোন্‌ কোন ক্ষেত্রে মানব আচরণ এই সব প্রাণীদের সাথে তুলনীয় বা তাদের থেকে পৃথক।

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

দৈহিক নৃবিজ্ঞানে সমকালীন বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যেকার দৈহিক পার্থক্য ও সম্পর্ক নিয়েও গবেষণা করা হয়। এ ধরনের গবেষণায় দীর্ঘকাল যাবত বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহের উপরই নজর কেন্দ্রীভূত ছিল। গায়ের রৎ চুলের ধরন, চোখ-মুখের গড়ন প্রভৃতির ভিত্তিতে মানবজাতিকে বিভিন্ন 18০6 বা নরবর্ণে বিভক্ত করার রেওয়াজ ছিল (18০6-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে “মহাজাতি’ শব্দটিও বাংলায় প্রচলিত রয়েছে, বিশেষ করে রুশ ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত মিখাইল নেস্তুর্বের এজাতি, জাতি ও প্রগতি শীর্ষক একটি গ্রন্থে, যা বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজলভ্য ছিল)।

আপনারা মঙ্গোলীয়, ককেশীয়, নিগ্রোয়েড প্রভৃতি শব্দের সাথে নিশ্চয় পরিচিত আছেন, এবং কোন্‌ নরবর্ণভূক্ত মানুষের চেহারা বা অন্যান্য দৈহিক বৈশিষ্ট্য কেমন, এ সম্পর্কে আপনাদের কিছু ধারণা হয়তবা আছে। এগুলি হল একটি বহুল-প্রচলিত শ্রেণীকরণ অনুসারে প্রধান কয়েকটি নরবর্ণর নাম। এই শ্রেণীকরণে অনেকসময় অস্ট্রালয়েড নামে আরেকটি প্রধান নরবর্ণকে শনাক্ত করা হয়, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা যেটার অন্তর্গত। তবে প্রকৃতপক্ষে নরবর্ণর সংজ্ঞা ও শ্রেণীকরণ নিয়ে দৈহিক নৃবিজ্ঞানে কখনো কোন সর্বজনম্বীকৃত মতামত ছিল না।

অধিকন্তু সাম্প্রতিককালে দৈহিক নৃবিজ্ঞানীদের অধিকাংশই নরবর্ণর ধারণাকে বিজ্ঞান-সম্মত নয় বলে বাতিল করে দিয়েছেন। সমকালীন দৈহিক নৃবিজ্ঞানে নরবর্ণর ধারণা কার্যত পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ হল, যেভাবেই নরবর্ণর সংজ্ঞা ও শ্রেণীকরণ দীড় করানো হোক না কেন, বাস্তবে এক নরবর্ণর সাথে আরেক নরবর্ণর কোন সুস্পষ্ট সীমারেখা চিহ্নিত করা যায় না।

এমন কোন মানবগোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া মুশকিল যার প্রত্যেক সদস্যের মধ্যেই সকল ক্ষেত্রে অভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। বরং, যেভাবেই নরবর্ণর সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিন্যাস নির্ধারণ করা হোক না কেন, অনেক জনগোষ্ঠীর দেখা মিলবে যাদের মধ্যে একাধিক নরবর্ণর বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে আছে। এসব জনগোষ্ঠীকে মিশ্র” বলে চিহ্নিত করা হলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কারণ মানব ইতিহাসে কখনো পৃথক পৃথক বিশুদ্ধ নরবর্ণ ছিল, এমন কোন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

দৈহিক নৃবিজ্ঞান

নরবর্ণর ধারণা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতিগত সমস্যার পাশাপাশি আরেকটি বিপজ্জনক প্রবণতাও দেখা গেছে, সেটা হল, বিগত শতান্দীগুলোতে পশ্চিমা অনেক দেশেই নরবর্ণর ধারণার সাথে বর্ণবাদী চিন্তাচেতনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল, যেখানে বিভিন্ন বাহ্যিক দৈহিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের ভিক্তিতে জাতিগত শেষ্ঠতু বা নিকৃষ্টতার ধারণা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হত। এ ধরনের চিন্তাধারার পরিণতি কত মারাত্বক হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল হিটলারের নাৎসী বাহিনী যখন জার্মান জাতিকে “শুদ্ধ’ করার নামে লক্ষ লক্ষ ইহুদী ও জিপসীকে হত্যা করে।

বর্তমানে দৈহিক নৃবিজ্ঞানে বাহ্যিক দৈহিক বৈশিষ্ট্যের চাইতে মানবজাতির অন্তর্নিহিত জেনেটিক (genetic অর্থাৎ জিন-সংক্রান্ত) বৈচিত্র্য অধ্যয়নের উপর অধিকতর জোর দেওয়া হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিভিন্ন জেনেটিক বৈশিষ্ট্য কিভাবে বন্টিত, এবং জেনেটিক পার্থক্যগুলো কি কারণে বা কি প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে, এসব প্রশ্নের উত্তর খোজার কাজে অনেক দৈহিক নৃবিজ্ঞানীও শামিল রয়েছেন। আর এ ধরনের পরিবর্তনের আলোকে ইদানীং দৈহিক নৃবিজ্ঞানের স্থলে জৈবিক নৃবিজ্ঞান (biological anthropology) পরিচয়টাই অনেকের কাছে অধিকতর গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে।

যাই হোক, মানব বৈচিত্র্যের জৈবিক উপাদানসমূহ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে দৈহিক/জৈবিক নৃবিজ্ঞানীদের নজর বাহ্যিক বা অবাহ্যিক যে ধরনের পার্থক্যের উপরই কেন্দ্রীভূত হোক না কেন, এসব পার্থক্যের মধ্য দিয়েও একই প্রজাতির সদস্য হিসাবে পৃথিবীর সকল মানুষ যেসব অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সেগুলির উপর আলোকপাত করাও তাদের অন্যতম লক্ষ্য থাকে। এভাবে তারা মানব অস্তিতকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবনে সহায়তা করেন।

 

আরও দেখুনঃ

বাঙলায় মধ্যযুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

মধ্যযুগের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- আর্থিক ঋদ্ধির জন্য বাঙলাকে ‘সোনার বাঙলা’ বলা হত। মধ্যযুগের বৈদেশিক পর্যটকরা বাঙলাদেশকে ভূস্বর্গ বলে অভিহিত করে গেছেন। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য থেকেও আমরা বাঙলার বিপুল ঐশ্বর্যের কথা জানতে পারি। বাঙলার আর্থিক সম্পদ প্রতিষ্ঠিত ছিল তার ক্বষি ও শিল্পের ওপর। নদীমাতৃক বঙ্গভূমি উৎপন্ন করত প্রচুর পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য। এই সকল কৃষিজাত পণ্য বাঙলার নিজস্ব চাহিদা মিটিয়েও বিক্রীত হত দেশদেশান্তরের হাটে। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল চাউল।

সেন রাজবংশ

অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে ছিল তুলা, ইক্ষু, তৈল বীজ, সুপারি, আদা, লঙ্কা ও নানাবিধ ফল। পরে পাট ও নীলের চাষও প্রভূত পরিমাণে হত। উৎপন্ন পণ্যের পাঁচ শতাংশ রাজস্ব হিসাবে রাজকোষে জমা দিতে হত। শতকরা ৯০ জন লোক কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকত। কৃষিকে হীনকর্ম বলে কেউ মনে করত না। এমনকি ব্রাহ্মণরাও কৃষিকর্ম করতে লজ্জাবোধ করত না। চণ্ডীমঙ্গলের রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম লিখে গিয়েছেন যে, তাঁর সাত . পুরুষ কৃষিকর্মে নিযুক্ত ছিলেন।

[ মধ্যযুগের অর্থনৈতিক অবস্থা ]

শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল কার্পাস ও রেশমজাত বন্ধ। শূক্ষ্ম ৰস্তু প্রস্তুতের জন্য বাঙলার প্রসিদ্ধি ছিল যুগ যুগ ধরে। দেশ-বিদেশে বাঙলার ‘মসলিনে’র চাহিদা ছিল। এই জাতীয় বস্তু এত সূক্ষ্ম হত যে একটি ছোট ন্যাধারের মধ্যে বিশ গজ কাপড় ভরতি করা যেত। বাঙলার শর্করার প্রসিদ্ধি ও সর্বত্র ছিল। এ ছাড়া বাঙলায় প্রস্তুত হত শঙ্খজাত নানারূপ পদার্থ, লৌহ, কাগজ, লাক্ষা, বারুদ ও বরফ। বীরভূমের নানা স্থানে ছিল লৌহপিণ্ডের আকর। তা থেকে লৌহ ও ইস্পাত তৈরি হত।

বীরভূমের যে সকল স্থানে লৌহ ও ইস্পাতের কারখানা ছিল, সেগুলি হচ্ছে দামরা, ময়সারা, দেওচা ও মহম্মদনগর। এই সকল লোহা দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ পর্যন্ত কলকাতা ও কাশিম বাজারে কামান তৈরি হত। বলা বাহুল্য, এই লোহা ও ইস্পাত প্রস্তুতের জন্য বীরভূমের কারিকরগণ নিজস্ব প্রণালী অবলম্বন করত। বরফ তৈরির জন্য ও বাঙলার নিজস্ব প্রণালী ছিল। শীতকালে মাটিতে গর্ত করে, তার মধ্যে গরম জল ভরতি করে সমস্ত রাত্রি রাখা হত। প্রভাতে তা বরফে পরিণত হত।

এ ছাড়া চিনি তৈরির জন্যও বাঙলার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যে চিনি তৈরি হত তা ধবধবে সাদা হত। এই চিনি দেশের চাহিদ। মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হত। ( এই পদ্ধতি সম্বন্ধে যারা সম্যক অবগত হতে চান, তাঁরা বর্তমান লেখকের ‘ফোক এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি লাইফ’ পুস্তক দেখুন)।

বখতিয়ারের মূল বাহিনীর আক্রমণে রাজা লক্ষণ সেনের বাহিনীর চূড়ান্ত পতন ঘটে

বাঙলার লোকদের বিশেষরূপে পারদর্শিতা ছিল নৌকা নির্মাণে। বাঙলার নানাস্থানে নৌকা-নির্মাণের কেন্দ্র ছিল, বিশেষ করে ঢাকায়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ রাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে বলেছেন যে কখনও কখনও নৌকাগুলি ৩০০ গজ লম্বা ও ২০০ গজ চওড়া হত। দ্বিজ বংশীদাস তাঁর মনসামঙ্গলে ১০০০ গজ লম্বা নৌকার কথাও বলেছেন, তবে সেটা অতিরঞ্জন বলেই মনে হয়। বাঙলার নিজস্ব তৈরি এরূপ বৃহদাকার নৌকা করেই মনসা ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যদ্বয়ের নায়করা, যথা— চাঁদ সদাগর, ধনপতি সদাগর ও শ্রীমন্ত সদাগর দূরদূরান্তরে বাণিজ্য করতে যেতেন। মনে রাখতে হবে যে, সে যুগের নাবিকদের দিগ্বদর্শন যন্ত্র ছিল না।

বংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, সে যুগের নাবিকরা মাত্র সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের অবস্থান লক্ষ্য করেই সাতসমুদ্র তের নদী পাড়ি দিত। তাদের দক্ষতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। তবে তাদের যে অনেক ঝুঁকি নিতে হত, সেটা বলা বাহুল্য মাত্র। তারা প্রায়ই দস্থ্য দ্বারা আক্রান্ত হত। বিশেষ করে আরবদস্যু দ্বারা আক্রমণের ফলেই তারা পশ্চিমের দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য বর্জন করে সিংহল, যবদ্বীপ, মালয় প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু এই পটভূমিকা ও ষোড়শ শতাব্দী থেকে পরিবর্তিত হয় পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদের আক্রমণের ফলে।

বস্তুত ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে বাঙালী বণিকরা আর বাণিজ্য করতে বিদেশ যেতেন না। মোট কথা, বৈদেশিক বাণিজ্যক্ষেত্র থেকে তাঁরা ক্রমশ হটে গিয়েছিলেন। হটে যাবার প্রধান কারণ ছিল মগ ও পর্তুগীজ দস্যু দ্বারা বন্দুক ও কামানের ব্যবহার। বাঙালী বণিকদের তা ছিল না। সুতরাং বাঙালীরা আর এই সকল বৈদেশিক দস্যুদের সঙ্গে পেরে উঠলেন না। তাঁরা বিদেশ যাত্রার ঝুকি পরিহার করে বাণিজ্যক্ষেত্রে মধ্যগের কাজ করা শুরু করে দিলেন। নবাগত বিদেশী বণিকদেরই তাঁরা মাল বেচতেন। এর ফলে দেশের মধ্যে গড়ে উঠল কতকগুলি নতুন অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকেন্দ্র। সেসব কথা বিশদভাবে আমরা পরে বলব।

মধ্যযুগের পরিব্রাজক ইবন বতুতা [ Ibn Battuta, Scholar and Explorer ]
বস্তুত কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য— এই তিনটির ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল বাঙালীর সমৃদ্ধি। বিশেষ করে লক্ষণীয় ছিল বণিকসমাজের ধনাঢ্যতা। তাদের ধনাঢ্যতার পরিচয় আমরা পাই মনসা ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যসমূহে। তাদের স্থান ছিল সমাজের শীর্ষদেশে। তাদের আবাস-কেন্দ্র ছিল সপ্তগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। পরে আমরা দেখব যে এই বণিকসমাজই উত্তরকালে কলকাতা নগরীর পত্তন করেছিল। সপ্তগ্রাম ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে আরও অনেক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। তাদের অন্যতম হচ্ছে গৌড়, সোনারগাঁ, হুগলী ও চট্টগ্রাম। এ সকল বাণিজ্যিক কেন্দ্রের নাম আমরা সমসাময়িক বৈদেশিক পর্যটকদের লেখনী মারফত জানতে পারি।

ষোড়শ শতাব্দীর পর্যটক বারথেমা, ‘বেঙ্গল’ নামে এক নগরী ও বন্দরের উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর আর একজন পর্যটক যোয়াও দ্য ব্যারোস গৌড়কে প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখে গিয়েছেন। যে গৌড় নগর নয় মাইল লম্বা ও বিশ লক্ষ লোক দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। তিনি আরও বলেছেন যে, গৌড়ের পণ্যসমৃদ্ধির জন্য সেখানে এত লোকের সমাগম হত যে ভিড় ঠেলে নগরের রাস্তা দিয়ে হাঁটা দুষ্কর ছিল। এ ছাড়া তিনি সোনারগাঁ, হুগলী, চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম, প্রভৃতি বাণিজ্যকেন্দ্রেরও উল্লেখ করেছেন।

ষোড় শতাব্দীর শেষভাগের পর্যটক সীজার ফ্রেডরিক সপ্তগ্রামকেই সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধিশালী বন্দর বলে বর্ণনা করেছেন। এর বিশ বছর পরে র্যালফ, ফীচ সপ্ত গ্রাম এবং চট্টগ্রাম উভয়কেই বাঙলাদেশের বড় বন্দর (Porte Grande) বলে অভিহিত করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর পর্যটক হ্যামিলটন হুগলী ও চট্টগ্রামকেই প্রধান বন্দর বলে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সপ্তগ্রামের কোনও উল্লেখ করেননি। অধিকন্তু তিনি তাণ্ডার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে তাত্তা হুতা ও স্মৃতিবস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।

ইবনে বতুতার চোখে বাংলাদেশ

এককালে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঙলার যে অসাধারণ প্রতাপ ছিল, তা হারাবার পর বাঙলা অভ্যন্তরীণ হাটে পরিণত হয়েছিল। কেবল নবাগত বিদেশীরাই যে বাঙলার হাটে মাল কিনত, তা নয়। ভারতের নানাস্থান থেকে ব্যবসায়ীরা বাঙলার হাটে মাল কিনতে আসত। যারা বাঙলার হাটে কেনাবেচা করতে আসত, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাশ্মীরী, মূলতানী, আফগান, পাঠান, শেখ, পগেয়া (যাদের নাম থেকে বড়বাজারের পগেয়াপটির নাম হয়েছে ), ভুটিয়া ও সন্ন্যাসী।

সন্ন্যাসীরা যে কারা, তা আমরা সঠিক জানি না। মনে হয় তারা হিমালয়ের সাহুদেশ থেকে চন্দনকাঠ, মালার গুটি (beads) ও ভেষজ গাছগাছড়া বাঙলায় বেচতে আসত। তার বিনিময়ে তারা বাঙলা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যেত। হলওয়েলের এক বিবরণী থেকে আমরা জানতে পারি যে, দিল্লী ও আগরা থেকে পগেয়ারা বর্ধমানে এসে প্রচুর পরিমাণ বস্ত্র, সীসা, তামা, টিন ও লঙ্কা কিনে নিয়ে যেত। আর তার পরিবর্তে তারা বাঙলাদেশে বেচে যেত আফিম, ঘোড়া ও সোরা। অনুরূপভাবে কাশ্মীরের লোকরা বাঙলা থেকে কিনে নিয়ে যেত লবণ, চামড়া, নীল, তামাক, চিনি, মালদার সাটিন কাপড় ও বহুমূল্য রত্নসমূহ। এগুলি তারা বেচত নেপাল ও তিব্বতের লোকদের কাছে।

বাঙলার বাহিরের ব্যবসায়ীরা যেমন বাউলায় আসত, বাঙলার ব্যবসায়ীরাও তেমনই বাঙগার বাহিরে যেত। ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দে জয়নারায়ণ কর্তৃক রচিত “হরিলীলা’ নামক এক বাংলা বই থেকে আমরা জানতে পারি যে বাঙলার একজন বণিক ব্যবসা উপলক্ষে হস্তিনাপুর, কর্ণাট, কলিঙ্গ, গুজর, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর, ভোজ, পঞ্চাল, কম্বোজ, মগধ, জয়ন্তী, দ্রাবিড়, নেপাল, কাঞ্চী, অযোধ্যা, অবস্তী, মথুরা, কাম্পিলা, মায়াপুরী, দ্বারাবতী, চীন, মহাচীন ও কামরূপ প্রভৃতি দেশে গিয়েছিলেন।

নালন্দা বিহার

যারা বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত, তারা বেশ দুপয়সা রোজগার করে বড়লোক হত। বস্তুত তাদের ধনদৌলত প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। তার পরিচয় আমরা পাই বাংলা সাহিত্যে ও বৈদেশিক পর্যটকদের বিবরণীতে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে একদল চৈনিক দ্রুত বাঙলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের বিবরণী থেকে আমরা তৎকালীন বাঙলাদেশের ধনাঢ্যতার এক বিশেষ পরিচয় পাই। খুব জাঁকজমক করে তাদের এক বিশেষ চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আহার্যের ভোজে আপ্যায়িত করা হয়েছিল।

ভোচ্ছান্তে তাঁদের প্রত্যেককে উপহার দেওয়া হয়েছিল এক একটি স্বর্ণনির্মিত বাটি, পিকদানী, সুরাপাত্র ও কটিবদ্ধ। তাদের সহচরদের দেওয়া হয়েছিল রৌপ্যনির্মিত উক্ত সামগ্রীসমূহ এবং ওঁদের সঙ্গে যে সকল সৈন্যসামন্ত এসেছিল, তাদের দেওয়া হয়েছিল বহু রৌপ্যমুদ্রা। তাঁরা লিখে গেছেন যে বাঙলা কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ। আর্থিক সম্পদের এই তিন উৎস থেকে বাঙলা প্রচুর অর্থ অর্জন করত।

লোকদের পোশাক-আশাক ও অলঙ্কার দেখে তাঁরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিলেন। গৌড় ও পূর্ব বাঙলার ধনীসমাজের ঐশ্বর্যের কথা ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’ ও ‘রিয়াজ-উস সালাতিন’-এও উল্লেখিত হয়েছে। এই দুই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে গৌড় ও পূর্ব বাঙলার ধনী লোকরা সোনার থালা বাটিতে আহার করে। ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড় যখন লুণ্ঠিত হয়েছিল, তখন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ লুণ্ঠনকারীদের কাছ থেকে ১৩০০ সোনার থালা ও প্রচুর অর্থ ও অলঙ্কার উদ্ধার করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফিরিস্তাও মন্তব্য করেছেন যে কোনও বড়লোকের ঘরে কত সংখ্যক সোনার থালা-বাসন আছে সেটাই ছিল তার ধনাঢ্যতার মাপকাঠি। সমাজে তার মর্যাদা নির্ভর করত তার ওপর।

বিশ্বের সেরা পরিব্রাজক হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে আছে বতুতার নাম

মধ্যযুগে বাঙলাদেশের লোকদের জীবনযাত্রা-প্রণালী যে সচ্ছল ছিল, তা সে যুগের জিনিষপত্রের দাম লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যাবে। চতুর্দশ শতাব্দীতে আফ্রিকা-দেশ থেকে ইবন বতুতা নামে একজন পর্যটক বাঙলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তখনকার পণ্যমূল্যের যে তালিকা দিয়ে গিয়েছেন। হচ্ছে ( বর্তমানের নয়াপয়সায় দাম ) – চাউল এক মণ ১২ পয়সা, ঘি এক মণ ১৪৫ পয়সা, চিনি এক মণ ১৪৫ পয়সা, তিল তৈল এক মণ ৭৩ পয়সা, সূক্ষ্ম কাপড় ১৫ গঙ্গ ২০০ পয়সা, দুগ্ধবতী গাভী একটি ৩০০ পয়সা, হৃষ্টপুষ্ট মুরগী ১২টি ২০ পয়সা, ও ভেড়া একটি ২৫ পয়সা।

ইবন বতুতা একজন বাঙালী মুসলমানের কাছ থেকে শুনেছিলেন যে, তার সংসারের (নিজের, স্ত্রীর ও একজন ভৃত্যের ) বাৎসরিক থাই-খরচ ছিল মাত্র সাত টাকা ।

ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতেও জিনিসপত্রের অনুরূপ স্থলভতার কথা উল্লেখিত হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে বার্নিয়ারও বলেছেন যে বাঙলাদেশের চাউল, ঘি, তরিতরকারি ইত্যাদির দাম নামমাত্র। ১৭২৯ খ্রীস্টাব্দের এক মূল্যতালিকায় আমরা মুর্শিদাবাদে প্রচলিত যে দাম পাই, তা থেকে জানতে পারি যে প্রতি টাকায় মুর্শিদাবাদে পাওয়া যেত সরু চাউল ১ মণ ১০ সের থেকে ১ মণ ৩৫ সের পর্যন্ত, দেশী চাউল ৪ মণ পঁচিশ সের থেকে ৭ মণ ২০ সের, গম ৩ মণ থেকে ৩ মণ ৩০ সের, তেল ২১ সের থেকে ২৪ সের, ঘি ১০ সের ৮ ঘটাক থেকে ১১ সের ৪ ছটাক ও তুলা ২ মণ থেকে ২ মণ ৩০ সের।

১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে সাহেবদের খাদ্যসামগ্রীর দাম ছিল একটা গোটা ভেড়া দু’টাকা, একটা বাচ্চা ভেড়া এক টাকা, ছয়টা ভাল মুরগী বা হাঁস এক টাকা, এক পাউণ্ড মাথন আট আনা, ১২ পাউও রুটি এক টাকা, ১২ বোতল ক্লারেট মদ ৬০ টাকা ইত্যাদি।

কিন্তু এই প্রতুলতার মধ্যেও ছিল নিম্নকোটির লোকদের দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণ ছিল সরকারী কর্মচারীদের অত্যাচার ও জুলুম। কবিকঙ্কণ-চণ্ডীর রচয়িতা মুকুন্দরাম বলেছেন যে যদিও ছয়-সাত পুরুষ ধরে তাঁরা দামু্যা গ্রামে বাস করে এসেছিলেন, তথাপি ডিহিদার মাহমুদের অত্যাচারে তাঁরা ভিটাচ্যুত হয়ে ভিক্ষা বৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনুরূপ দুর্দশার বর্ণনা ক্ষেমানন্দ কেতকা দাসও দিয়ে গিয়েছেন। একজন সমসাময়িক বৈদেশিক পর্যটক (মানরিক) লিখে গিয়েছেন যে, রাজস্ব দিতে না পারলে, যে কোনও হিন্দুর স্ত্রী ও ছেলেপুলেদের নীলাম করে বেচা হত।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি

এ ছাড়া, সরকারী কর্মচারীরা যখন-তখন কৃষক রমণীদের ধর্ষণ করত। এর কোনও প্রতিকার ছিল না। তার ওপর ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সৈন্যগণের অত্যাচার ও বাঙলার দক্ষিণ অংশের উপকূলভাগে মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের উপদ্রব। তারা যে মাত্র লুটপাট করত ও গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দিত তা নয়, মেয়েদের ধর্ষণ করত ও অসংখ্য নরনারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশের দাসদাসীর হাটে বেচে দিত। এ ছাড়া, দুঃসময়ে ও দুর্ভিক্ষের সময় তারা তাদের স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা হাটে বেচে দিত।

দাসদাসী-কেনাবেচা মধ্যযুগে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। সোনার থালা-বাসনের মতো দাসদাসীর সংখ্যাও ছিল সামাজিক মর্যাদার একটা মাপকাঠি। এসব দাসদাসীর ওপর গৃহপতিরই মালিকানা স্বত্ত্ব থাকত। গৃহপত্তির অধীনে থেকে তারা গৃহপতির ভূমিকর্ষণ ও গৃহস্থালির কাজকর্ম করত। কখনও কখনও মালিকরা তাদের দাসীগণকে উপপত্নী হিসাবেও ব্যবহার করত। নবাব, সুলতান ও বাদশাহদের হারেমে এরকম হাজার হাজার দাসী থাকত। সাধারণত এ সকল দাসীদের হাট থেকে কেনা হত। অনেক সময় দামদস্বর করে মুখের কথাতেই তাদের কেনা হত, তবে ক্ষেত্রবিশেষে দলিলপত্রও তৈরি করে নেওয়া হত। এরূপ দলিলপত্রকে গৌড়ীয়-শাতিকা-পত্র, বহীখাতা অকরার পত্র ইত্যাদি বলা হত।

দাসদাসী রাখা ঋগ্বেদের আমল থেকেই ভারতে প্রচলিত ছিল। তবে মধ্য যুগে এই প্রথা বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। হিন্দুসমাজে দাসদাসী কেনা ও রাখা যে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল, তা নয়। চাষাভূষার ঘরেও দাসদাসী থাকত। সাধারণত লোক দাসীদের সঙ্গে মেয়ের মতো আচরণ করত। অনেকে আবার নিজের ছেলের সঙ্গেও কোন দাসীর বিয়ে দিয়ে তাকে পুত্রবধূ করে নিত। তখন সে দাসত্ব থেকে মুক্ত হত। অনেকে আবার যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করবার জন্য দাসীদের ব্যবহার করত। এরূপ দাসীদের গর্ভজাত সন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্মৃতিতেও নির্দেশ আছে।

সেন রাজবংশ

সমসাময়িক দলিলপত্র থেকে আমরা দাসদাসীর মূল্য সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারি। বিদ্যাপতির সময় ৪৪ বৎসর বয়স্ক এক কৈবর্ত পুরুষ দাদের দাম ছিল ৬ টাকা, গৌরবর্ণ ৩০ বৎসর বয়স্কা দাসীর দাম ছিল ৪ টাকা, ১৬ বৎসর বয়স্ক বালকের দাম ছিল ৩ টাকা এবং ৫ বৎসর বয়স্ক। খামাঙ্গী মেয়ের দাম ছিল মাত্র এক টাকা। পরবর্তী কালে দামের কিছু হেরফের দেখা যায়। চতুর্দশ শতাব্দীর আফ্রিকাদেশের পর্যটক ইবন বঁটুটা বলেছেন যে, তিনি মাত্র ১৫ টাকায় এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণীকে কিনেছিলেন ও তাকে বাঙলাদেশ থেকে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। দাসদাসীর ব্যবসাটা বিশেষভাবে চলত দুর্ভিক্ষের সময় ।

ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে পর্তুগীজ দহারা দক্ষিণ বাঙলা থেকে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে চুরি করে নিয়ে গিয়ে তাদের বিদেশের হাটে বিক্রী করত। আবার মেয়ে চুরি করে এদেশের লোকরাও অপর অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে তাদের বিয়ের পাত্রী হিসাবে বিক্রী করত। এরূপ মেয়েদের ‘ভরার মেয়ে’ বলা হত। অনেক সময় অজানা মুসলমানী ‘ভরার মেয়ের সঙ্গে হিন্দুর ছেলের বিয়েও দেওয়া হত।

ইংরেজরা যখন এদেশে আসে, তখন তারাও দাসদাসী কিনত ও খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বেচত।

 

আরও পড়ুন:

বাঙলায় ছাপাখানা ও সামাজিক বিস্ফোরণ

ছাপাখান৷ ও সামাজিক বিস্ফোরণ নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে এদেশে ছাপাখানার প্রবর্তন সমাজের ওপর এক গভীর প্রতিঘাত হেনেছিল। যদিও ছাপাখানা শিক্ষার বিস্তারে সহায়ক হয়ে দাড়িয়েছিল, তথাপি একথা বললে ভুল হবে যে, ছাপাখানা প্রবর্তনের পূর্বে এদেশের লোক অশিক্ষিত ছিল। সমাজের অনেকেই পাঠশালার মারফত সাক্ষরতা অর্জন করত। এটা যে উচ্চকোটির লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। নিম্নকোটির লোকরাও সাক্ষরতা অর্জন করত। সামান্য মুদির দোকানে স্থর করে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়া হত। বিদ্যার দৌড়ে অনেক মুর্দি আবার তার চেয়েও বেশি এগিয়ে যেত। দৃষ্টান্তস্বরূপ কান্ত মুদির উল্লেখ করা যেতে পারে— যিনি বাংলা, ফারসী ও যৎসামান্য ইংরেজি জানতেন এবং হিসাবপত্রে পারদর্শী ছিলেন।

 

মুদির দোকানে রামায়ণ পড়াই বলুন, আর চতুষ্পাঠীসমূহে সংস্কৃত ব্যাকরণ কাব্য-সাহিত্য-দর্শন অধ্যয়নই বলুন, সবই হাতে লেখা পুঁথির সাহায্যে করা হত। এর জন্য সমাজে এক শ্রেণীর লোক পুঁথিলেখকের কাজ করত। যখন ছাপাখানা আবির্ভূত হল, এবং মুদ্রিত বই বেরুতে লাগল, তখন তার প্রথম প্রতিঘাত গিয়ে পড়ল এইসব পুঁথিলেথকদের ওপর। অবশ্য তারা রাতারাতি সব বেকার হয়ে পড়েনি। কেননা, প্রথম প্রথম মুদ্রিত পুস্তকের প্রতি নিষ্ঠাবান সমাজের একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল।

[ ছাপাখানা ও সামাজিক বিস্ফোরণ]

এ বিদ্বেষের কারণ ছিল, ছাপাখানা বিলাতী যন্ত্র বলে। তখন এদেশে যা কিছু বিলাতী জিনিসের সংস্পর্শে আসত, তা নিষ্ঠাবান সমাজের বিচারে ছিল হিন্দুর ধর্মনাশ করবার একটা কৌশল মাত্র। কিন্তু নিষ্ঠাবান সমাজের এ বিদ্বেষ খুব বেশি দিন টেকেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নের পূর্বেই ছাপা বইয়ের প্রাবন এনে দিয়েছিল শিক্ষাজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তখন থেকেই উপজীবিকার উপায় হিসাবে পু*থিলেখা তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

ছাপাথানার সূত্রপাত হয়েছিল ১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজিতে রচিত ও হুগলীতে মুদ্রিত ন্যাথানিয়াল ব্রাসী হ্যালহেড কৃত বাংলা ভাষার একখানা ব্যাকরণ প্রকাশ থেকে। বইথানার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই বইখানাতেই প্রথম বিচ্ছিন্ন নড়নশীল (movable types) বাংলা হরফের চেহারা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এই হরফ তৈরি করেছিলেন চার্লস উইলকিনস নামে কোম্পানির এক সিভি লিয়ান। তিনি পঞ্চানন কর্মকার নামে এদেশের একজন দক্ষ ও প্রতিভাশালী শিল্পীকে হরফ তৈরির প্রণালীটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলা হরফের সাট বিবর্তনের ইতিহাসে পঞ্চানন ও তার পরিজনদের প্রয়াস তথা দান অনন্যসাধারণ।

ছাপাখানার প্রবর্তনের ফলে, এক শ্রেণীর লোক যেমন তাদের কর্মসংস্থানের স্বত্র হারিয়ে ফেলল, অপর দিকে ছাপাখানা নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করল। ছাপাখানার বহুমুখী কাজে সমাজের বহুলোক নিযুক্ত হয়ে পড়ল। কেউবা অক্ষর খোদাই ও অক্ষর-ঢালাইয়ের কাজে নিযুক্ত হল, আবার কেউবা অক্ষর-সংযোজন ( composing ) ও মুদ্রাযন্ত্র চালানোর কাজে ব্যাপৃত হল। তারপর ছাপাখানার সঙ্গে সঙ্গে আসে ছবি ছাপবার জন্য নানা রকমের কাজ। ছবি ছাপবার জন্য আবির্ভূত হল শিল্পী ও শিল্পীর সঙ্গে আবির্ভূত হল ব্লকমিস্ত্রি, যারা কাঠে বা ধাতুর পাতে খোদাই করে ব্লক তৈরি করত ছাপবার জন্য।

তারপর লিথোগ্রাফি প্রক্রিয়াতেও ছবি ছাপা শুরু হতে লাগল। (১৮২২ খ্রীস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখের ‘ক্যালকাটা জর্নাল’ অনুযায়ী দুজন ফরাসী শিল্পী, নাম বেলনস ও সার্ভিঞাক কর্তৃক এই প্রথা কলকাতায় প্রবর্তিত হয়েছিল)। এসব কাজের জন্য সমাজের মধ্যে বিশিষ্ট বৃত্তিধারী নানাশ্রেণীর লোকের আবির্ভাব হল। পুথি লেখকরা তাদের কর্ম হারাল বটে, কিন্তু তাদের তুলনায় সমাজের এক গরিষ্ঠ জনসংখ্যা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেল।

এদিকে ছাপাখানার সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগল। ছাপাখানার সংখ্যা যত বাড়ল সমাজের বেশিসংখ্যক লোক তত ছাপাখানার কাজে নিযুক্ত হল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১৮৮৫-৮৬ খ্রীস্টাব্দে ) এদেশে ১,০৯৪টি ছাপাখানা ছিল। গড়ে যদি প্রতি ছাপাখানায় পাঁচজন লোক নিযুক্ত থেকে থাকে তা হলে বলতে হবে যে মালিক সমেত ৬,৫৬৪ সংখ্যক লোক ছাপাখানা থেকে তাদের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করত। আর প্রত্যেক লোকের পরিবারে যদি পাঁচজন করে লোক থাকে, তা হলে ছাপাখানা থেকে প্রায় ৩২,৮২০ লোকের ভরণ পোষণ চলত। মাত্র কর্মসংস্থান ও ভরণপোষণ নয়, সমাজতাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে সবচেয়ে যে বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটল, সেটা হচ্ছে সমাজের বহুজন এক নতুন টেকনোলজিতে দক্ষ হয়ে দাড়াল।

তারপর নতুন নতুন দিকে ছাপাখানার বিকাশ ঘটল। লাইনোটাইপ, মনোটাইপ প্রভৃতি যন্ত্রের আবিষ্কার হল। মুদ্রণযন্ত্র ও প্ল্যাটেন প্রেস থেকে রোটারী প্রেসে পরিণত হল। সচিত্র বই ছাপবার জন্য হাফটোন ব্লক তৈরি হতে লাগল। অফসেট প্রিন্টিং-এরও প্রবর্তন হল। এসব কাজ সমাধার জন্য দক্ষতাপূর্ণ নান। বৃত্তিধারী মানুষের আবির্ভাব ঘটল। ফলে, অন্যান্য শিল্পের ন্যায়, ছাপাখানা ও এক বিরাট শিল্পে পরিণত হল। সমাজের লোকরা নতুন নতুন টেকনোলজি শিখল এবং এর দ্বারা সমাজের বহুলোক উপকৃত হল।

১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে ছাপাথানার ধর্মঘটের সময় প্রকাশ পেয়েছিল যে, মাত্র বলকাতার ৬,০০০ ছাপাখানায় প্রায় এক লক্ষ লোক নিযুক্ত ছিল। এছাড়া, কাগজ ও ছাপার কালি শিল্পেও বহু লোক নিযুক্ত আছে। কর্মনিযুক্তি বর্তমান সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এবং সেদিক দিয়ে বিচার করলে মুদ্রাযন্ত্র এদেশের সমাজের ওপর এক অতি দুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। কেননা, ছাপাথানার ফলস হচ্ছে বই ও সংবাদপত্র। বই ও সংবাদপত্র বিক্রির কাজে বহুলোক নিযুক্ত আছে। বস্তুত, ছাপাখানার কর্মযজ্ঞ ভারতের কর্মনিযুক্তির ক্ষেত্রে যে এক প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছে, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এবার অন্যদিক দিয়ে সমাজের ওপর ছাপাখানার প্রভাব সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করব। ছাপাখানার সাহায্যেই সামাজিক অপপ্রথাসমূহ ও নিপীড়ন বন্ধ হয়েছিল। মুদ্রিত পুস্তকই এদেশে সমাজ-সংস্কারের প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাড়িয়েছিল। বস্তুত ছাপাখানাই এদেশে ‘আন্দোলন’-এর যুগ আনে। ‘আন্দোলন’ চালাবার জন্য হাতে লেখা মাধ্যমের একটা সীমা আছে—সংখ্যা এবং ব্যয়, এই উভয় দিক থেকেই। অপরপক্ষে মুদ্রিত মাধ্যম মারফত প্রয়োজনীয় সংখ্যা

ছাপানো যায়, এবং তার ব্যয় ও অল্প। মুদ্রিত পুস্তকের সাহায্যে সামাজিক অপপ্রথার বিরুদ্ধে অভিযান প্রথম চালান রাজা রামমোহন রায়। সতীদাহ প্রথার বিলোপসাধনের জন্য তিনি কয়েকখানি পুস্তিকা রচনা করে তাঁর স্বপক্ষে দেশের জনমত গঠনের ও সরকারী দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তাঁর সে আন্দোলন যে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল, তা আজ সকলেরই জানা আছে।

রাজা রামমোহন রায় [ Raja Ram Mohan Roy ]
মুদ্রিত পুস্তকের সাহায্যে অনুরূপ আন্দোলন চালিয়েছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য। তাঁর সে চেষ্টাও সার্থক হয়েছিল। রাজা রামমোহনের সমসাময়িক কালে ( ১৮২২ খ্রীস্টাব্দে ) স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক এক পুস্তিকা প্রচার করে, এদেশের মেয়েরা যাতে বিদ্যাভ্যাস করে, তার জন্য আন্দোলন করা হয়। এর ফলে এদেশে মেয়েদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যাভাসের হুচনা হয়। ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দে নাটুকে রামনারায়ণ কুলীনপ্রথা সম্পর্কে ‘কুলীনকুলসর্বন্ধ’ নাটক রচনা করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [ Ishwarchandra Vidyasagar ]
১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র ‘কচিৎ পথিক্য’ ছদ্মনামে তৎকালীন নীলকরদের বীভৎস অত্যাচার, চাষীদের লাঞ্ছনা ও দুরবস্থা অবলম্বনে তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করেন, এই নাটকের ফলেই জাতীয় চেতনা জেগে ওঠে ও নীলকরদের অত্যাচার বন্ধ হয়ে যায়। তখন আন্দোলনমূলক রচনা সাহিত্যের রূপ ধারণ করেছে। জাতীয় অপগ্রথা, কুসংস্কার ও কু-অভ্যাস সমূহ দূরীকরণের জন্য সেযুগে আরও যেসব হষ্টিধর্মী সাহিত্য রচিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল হানা ক্যাথেরীন ম্যালেন্স রচিত ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’, প্যারীচাঁদ মিত্র কর্তৃক রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও কালীপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক রচিত ‘ছতোম প্যাঁচার নকসা’।

কিছু পরেই বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয় চেতনা জাগরণের জন্য লেখেন তাঁর আনন্দমঠ, সীতারাম, চন্দ্রশেখর ও দেবী চৌধুরাণী। আনন্দমঠ-এর ‘বন্দেমাতরম্’ গানই পরবর্তীকালের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। বিংশ শতাব্দীতে শরৎচন্দ্র তাঁর পল্লীসমাজ, চরিত্রহীন, বামুনের মেয়ে, পথের দাবী প্রভৃতি উপন্যাস লিখে সামাজিক অত্যাচার দূরীকরণ, স্ত্রীজাতির মর্যাদা স্থাপন ও জাতীয় চেতনা জাগরণের চেষ্টা করেন। মাত্র পুস্তক রচনা দ্বারাই এসব আন্দোলন সার্থকতা লাভ করেনি। সংবাদপত্র ও এর সহায়ক ছিল। বলা বাহুল্য, সংবাদপত্র ছাপা খানারই আর এক ফসল।

সংবাদপত্র মারফৎ এসব আন্দোলনের খবর ও ওই সম্বন্ধীয় সম্পাদকীয় মন্তব্য জনসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল; এবং তাতে সমাজের মধ্যে একটা জনমত গঠিত হচ্ছিল। বিশেষ করে জাতীয় চেতনা জাগবার পর সংবাদপত্রই জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বস্তুত, দেশের মধ্যে জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়। এ ছাড়া সংবাদ পত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনসমূহ আঞ্জ সমাজকে সাহায্য করছে শিল্পসমূহের মাল বিক্রি করা থেকে আরম্ভ করে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত ব্যাপারে।

ছাপা বই সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিল শিক্ষার প্রসারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে কলকাতা শহর মুদ্রণের পীঠস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুদ্রা যন্ত্র স্থাপনের পূর্বে লোকের বিদ্যাবুদ্ধি যা কিছু হাতে লেখা পুঁথির মধ্যে ও বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে নিবন্ধ ছিল। এরূপ ক্ষেত্রে বিদ্যার প্রসার যে এক অতি সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সমাজের ওপর ছাপাখানার প্রভাব পড়েছিল এখানেই। ছাপাখানা মুদ্রিত বইয়ের সাহায্যে জ্ঞান ও বিদ্যাশিক্ষাকে সর্বজনীন বা democratized করে তুলেছিল।

শিক্ষা বিস্তারের ফলে লোকে যখন ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করল, তখন তারা পাশ্চাত্ত্য দেশের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হল। এই পরিচিতিই তাদের সমাজ, সাহিত্য ও রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিগন্তের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। এই নতুন নতুন দিগন্তের ওপরই ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতি প্রতিষ্ঠিত হল । মানুষের মন নতুন আলোকের সন্ধান পেল। মানুষ যুক্তিনিষ্ঠ হল। সেই যুক্তিনিষ্ঠতাই সমাজসংস্কারকদের অনুপ্রাণিত করল সামাজিক অপপ্রথাসমূহ দূর করতে।

সেজন্যই সনাতনীদের ছাপাথানার ওপর এক প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। কিন্তু ছাপাখানা থেকে যখন হুড়হুড় করে বই ও সংবাদপত্র বেরুতে লাগল ও দেশের জনসাধারণ তা কিনে পড়তে লাগল, তখন তার স্রোতে ছাপা-বই-বিরোধী সনাতনীরাই ভেসে গেল। বস্তুত ছাপা বই না থাকলে, এদেশে শিক্ষার প্রসার সুগম হত না, ও নবজাগৃতিরও আগমন ঘটত না।

এদিকে গণশিক্ষার প্রসার সাধনে সহায়তা করেছিল বটতলার প্রকাশন সংস্থাসমূহ। বটতলার অবদান অনেক। প্রথম সস্তাদামে বই বিক্রি। দ্বিতীয়, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সাধন। তৃতীয়, সংসাহিত্য (যেমন, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত, কবিকঙ্কণ চণ্ডী, মনসার ভাসান, লক্ষ্মীচরি প্রভৃতি) ও শিশু পাঠ্য বই ( যথা শিশুবোধক, বর্ণপরিচয়, ধারাপাত ইত্যাদি ) প্রচার। চতুর্থ, গ্রাম-গঞ্জে বই পৌঁছে দেবার জন্য ফিরিওয়ালার প্রবর্তন। (বটতলা সম্বন্ধে লেখকের ‘বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর’ দ্রঃ)।

আরও পড়ুন:

বাঙলার অলিখিত সাহিত্য

বাঙলার অলিখিত সাহিত্য নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- বাঙলার অলিখিত বা মৌখিক সাহিত্যের অন্যতম হচ্ছে ‘ধনার বচন। বাঙলার ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি সকলেই এখনও ‘খনার বচন’ আবৃত্তি করে। যেমন তারা বৃষ্টিপাত সম্বন্ধে বলে— ‘শনির সাত মঙ্গলের তিন। আর সব দিনের দিন। আবার যাত্রা প্রসঙ্গে বলে—’মঙ্গলের ঊষা বুধে পা। যথা ইচ্ছা তথ্য যা। আবার মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি পড়লে বলে- ‘ধন্য রাজার পুণ্য দেশ। যদি বর্ষে মাঘের শেষ। এগুলি সবই খনার বচন। ভাষা দেখলে মনে হবে এগুলি সবই আজকের। কিন্তু আসলে তা নয়।

যুগে যুগে লোকমুখে আগে কার ভাষা রূপান্তরিত হয়েছে পরবর্তী কালের চলিত ভাষায়। কেননা খনার বচনের মধ্যে এমন অনেক বচন আছে, যা প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত এবং আজকের লোকের কাছে দুর্বোধ্য। বস্তুতঃ খনা ছিলেন আমাদের দেশের এক জন প্রাচীন বিদুষী জ্যোতিষী। খনার বচনের মাধ্যমেই আমরা তার পরিচয় পাই। যথা, একটা বচনে তিনি বলেছেন—

কিসের তিথি কিসের বার।

জন্ম মৃত্যু কর সার।

কি কর শ্বশুর মতিহীন।

পলকে জীবন কর দিন।

নরা গজা বিশে শয়।

তার অর্ধেক বাঁচে নর।

বাইশ বলদা তের ছাগল।

তার অর্ধেক বরা পাগলা“।

আর একটা বচনে তিনি বলেছেন—

ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী শুনহে পতির পিতা।

ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা“।

এই সকল বচন থেকে আমরা জানতে পারি যে থনার শ্বশুর ছিলেন বরাহ ও স্বামী ছিলেন মিহির। ইতিহাস পাঠে আমরা জানতে পারি যে বরাহ গুপ্তবংশীয় বিক্রমাদিত্য নামধেয় নৃপতি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভা অলংকৃত করতেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল ছিল খ্রীস্টীয় ৩৭৬ থেকে ৪১৫ অব্দ পর্যন্ত। তা থেকে আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে খন। খ্রীস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর এক বিদুষী বাঙালী মহিলা জ্যোতিষী ছিলেন। বস্তুতঃ খনাই সবচেয়ে প্রাচীন বাঙালী বিদুষী যার সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানা আছে।

দুই

আগেই বলেছি যে মুসলমান শাসনের প্রতিঘাতে মধ্যযুগে বহু মেয়েগী দেবতার আবির্ভাব ঘটেছিল। এসব অধিকাংশ দেবতাকেই মেয়েরা ‘ব্রত’-এর মাধ্যমে আরাধনা করত। এই সকল ব্রত সম্পাদন সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না ওই ব্রত বা পূজা-সম্পর্কিত কোন ছড়া বা কাহিনী বলা হয়। ছড়া বা কাহিনীগুলো সবই অলিখিত। যদিও আজকাল ছাপাখানার দৌলতে এগুলোর কিছু কিছু ছাপা হয়েছে, তা হলেও মূলগতভাবে এগুলো অলিখিত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই অলিখিত সাহিত্য পুরুষ-পরম্পরায় চলে এসেছে। আজও চলছে। শেষ কাহিনী সস্তোষীমায়ের, যার ব্রত শুরু হয়েছে মাত্র এই সত্তরের দশকে।

[ বাঙলার অলিখিত সাহিত্য ]

যত দেবতা তত কাহিনী। সব দেবতার কাহিনী এখানে বিবৃত করা সম্ভবপর নয়। মাত্র প্রধান প্রধান কয়েকটা দেবতার ‘কথা’ই এখানে বিবৃত করছি।

প্রথমেই ধরুন লক্ষ্মীর ‘কথা’। একদিন নারায়ণের ইচ্ছা হল পৃথিবীর লোকেরা কিভাবে আছে, তা নিজের চোখে দেখতে যাবেন। লক্ষ্মীঠাকরুণ তাঁকে ধরে বসলেন যে তিনিও সঙ্গে যাবেন। তাকে সঙ্গে নিতে নারায়ণ এক শর্তে রাজী হলেন। শর্তটা হচ্ছে এই যে, ধরাধামে অবতরণের পর লক্ষ্মীঠাকরুণ উত্তর দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না।

কিন্তু পৃথিবীতে আসবার পর লক্ষ্মীঠাকরুণের কৌতূহল হল, নারায়ণ তাঁকে উত্তরদিকে তাকাতে মানা করলেন কেন, ওদিকে কি আছে তা তিনি দেখবেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উত্তরদিকে তাকালেন, এবং তাঁর চোখে পড়ল এক তিল-ক্ষেত। তিলের ফুল তাঁর মনকে হরণ করল, এবং তিনি বুথ থেকে নেমে গিয়ে কয়েকটা ফুল তুলে আনলেন। নারায়ণ যখন ফিরে এসে লক্ষ্মীর এই কাণ্ড দেখলেন, তখন তিনি লক্ষ্মীকে বললেন—

এজন্যই আমি তোমাকে উত্তরদিকে তাকাতে মানা করেছিলাম; তুমি কি জান না যে, ক্ষেত্র স্বামীর বিনা অম্লমতিতে তাঁর ক্ষেত্র থেকে ফুল তোলা পাপ ? এখন তোমাকে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, তিন বছর ওর গৃহে থেকে দাসীবৃত্তি করে।

তারপর নারায়ণ ও লক্ষ্মী ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর বেশ ধারণ করে, ক্ষেত্রপতির গৃহে এসে বললেন—

দেখ, এই স্ত্রীলোক তোমার বিনা অনুমতিতে তোমার ক্ষেত থেকে তিল ফুল তুলেছে, এজন্য ওকে তিন বছর তোমার গৃহে দাসীবৃত্তি করতে হবে, তবে ওকে কখনও উচ্ছিষ্ট খাদ্য দেবে না, ঘর ঝাঁট দিতে দেবে না এবং অপরের পরা ময়লা কাপড় কাচতে দেবে না।

এই কথা বলে নারায়ণ চলে গেলেন। ক্ষেত্রস্বামী নিজেও ব্রাহ্মণ ছিলেন, তবে অত্যন্ত দরিদ্র। স্ত্রী ছাড়া, তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে ও এক পুত্রবধূ ছিল। তাঁদের নিজেদেরই খাওয়া জোটে না, তারপর আর একজনকে খাওয়াতে হবে এই ভেবে ব্রাহ্মণগৃহিণী খুব চিন্তিত হলেন। তিনি লক্ষ্মীকে বললেন—

‘মা, আমরা খুবই গরীব, আমাদের ঘরে চাল, ডাল কিছুই নেই, তিন ছেলে ভিক্ষায় বেরিয়েছে, যদি কিছু জোগাড় করে আনতে পারে, তবেই আজ আমাদের খাওয়া হবে।’

লক্ষ্মী দেখলেন ব্রাহ্মণগৃহিণী শতচ্ছিন্ন এক মলিন কাপড় পরে আছেন। তাই দেখে লক্ষ্মীঠাকরুণের দয়া হল। তিনি ব্রাহ্মণীকে বললেন-

‘চল তো মা, গিয়ে দেখি কেমন তোমার ঘরে কিছু নেই।’

যখন ব্রাহ্মণগৃহিণী লক্ষ্মীঠাকরুণকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলেন, তখন তিনি দেখে আশ্চর্য হলেন যে ঘর ভরতি রয়েছে চাল-ডাল, হন, তেল, ঘি ইত্যাদি, এবং আলনায় ঝুলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়। এই দেখে বাড়ির সকলেই খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল এবং ভাবল এই স্ত্রীলোক নিশ্চয়ই কোন দেবী হবে। লক্ষ্মীকে কিছু না বলে, তারা মনে মনে তাঁকে প্রণাম করল। সেদিন থেকেই ব্রাহ্মণ পরিবারের ঐশ্বর্য বাড়তে লাগল, এবং তারা লক্ষ্মীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হল।

তিন বছরের শেষে একদিন গঙ্গায় পুণ্যস্নানের দিন এল। ব্রাহ্মণ পরিবার গঙ্গাস্নানে যাবেন। তাঁরা লক্ষ্মীকে তাঁদের সঙ্গে যেতে বললেন। লক্ষ্মী বললেন

‘আমি যাব না, তবে আমি এই কড়ি পাঁচটা দিচ্ছি, তোমরা আমার নাম করে এই কড়ি পাঁচটা গঙ্গার জলে ফেলে দেবে’।

গঙ্গাস্নান দারবার পর ব্রাহ্মণগৃহিণীর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, লক্ষ্মী তাঁকে পাঁচটা কড়ি দিয়েছিলেন গঙ্গার জলে ফেলে দেবার জন্য। তিনি কড়ি পাঁচটা আঁচল থেকে খুলে যেমনি গঙ্গায় ফেলে দিলেন, দেখলেন যে, মা গঙ্গা নিজে মকরে চেপে এসে কড়ি পাঁচটা নিয়ে গেলেন। এই দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

বাড়িতে ফিরে এসে দেখলেন যে, দুয়ারে একখানা রথ দাড়িয়ে আছে। রথের ভিতর একজন ব্রাহ্মণ রয়েছেন, আর লক্ষ্মী এক পা রথে ও এক পা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই দেখে ব্রাহ্মণী লক্ষ্মীর পা জড়িয়ে ধরে বললেন –

‘মা, তোমাকে আমরা চিনতে পারিনি, আমাদের যা কিছু দোষত্রুটি হয়েছে আমাদের মাপ কর, আমাদের ছেড়ে তুমি যেও না।’

লক্ষ্মী বললেন,

‘মা, আমার তো আর থাকবার উপায় নেই, তোমাদের বাড়ির দাসী হিসাবে থাকবার আমার তিন বছরের মেয়াদ ছিল, আজ তিন বছর উত্তীর্ণ হয়েছে, নারায়ণ এসেছেন আমাকে গোলোকে নিয়ে যাবার জন্য।’

তিনি আরও বললেন –

‘তোমরা মনে ব্যথা পেও না, বাড়ির পিছনে বেলগাছের তলায় গিয়ে খনন কর, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যাবে ; আর ভাদ্র, কার্তিক, পৌষ ও চৈত্র মাসে লক্ষ্মীর পূজা করবে; এর ফলে তোমরা সুখী ও ঐশ্বর্যশালী হবে।’

বেলগাছের তলা খুঁড়ে তারা যে ধনরত্ন পেল, তা দিয়ে তারা বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করল ও দাসদাসী পরিবৃত হয়ে ছেলেমেয়ে, জামাই ও পুত্রবধূ নিয়ে সুখে দিন কাটালো। এভাবে ধরাধামে লক্ষ্মীপূজার প্রবর্তন হল।

এবার জয়মঙ্গলচণ্ডীর পূজা প্রবর্তনের কাহিনীটি বলি।

কোন এক দেশে দুই বণিক ছিল। একজনের সাতটি মেয়ে; আর অপরজনের সাতটি ছেলে। এক বাবু মঙ্গলচণ্ডী ভিখারিণী ব্রাহ্মণীর বেশে প্রথম বণিকের বাড়ি ভিক্ষার জন্য আসেন। বণিক-বনিতা ভিক্ষা দিতে এলে, মঙ্গলচণ্ডী বললেন –

‘মা, তুমি অপুত্রক, তোমার হাতে ভিক্ষা নেব না। ভিখারিণী ভিক্ষা না নিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে বণিকপত্নী তার দুটো পা জড়িয়ে ধরে। মঙ্গলচণ্ডী তাকে একটা শুকনো ফুল দিয়ে বললেন, এই ফুল জলে গুলে প্রত্যহ তুমি খাবে, তা হলে তোমার ছেলে হবে এবং ছেলের নাম রাখবে জয়দেব’।

তারপর মঙ্গলচণ্ডী দ্বিতীয় বণিকের বাড়ি গেলেন এবং বণিকপত্নীর মেয়ে সন্তান নেই বলে তার হাত থেকে ভিক্ষা নিলেন না। বণিকপত্নী তাঁর পা জড়িয়ে ধরলে, তাকেও মঙ্গলচণ্ডী একটা শুকনো ফুল দিলেন এবং বললেন,

‘মেয়ে হলে তার নাম রাখবে জয়াবতী।”

এর ফলে দুই বণিকপত্নীরই যথাক্রমে ছেলে ও মেয়ে হল।

জয়দেব একটা পায়রা নিয়ে খেলা করত, আর জয়াবতী ফুল তুলে মঙ্গল চণ্ডীর পূজা করত। একদিন জয়দেবের পায়রাটা উড়ে গিয়ে জয়াবতীর কোলে বসল। জয়দেব পিছনে পিছনে এসে জয়াবতীর কাছ থেকে পায়রাটা ফেরত চাইল। জয়াবতী দিতে অস্বীকার করল। জয়দেব বলল,

‘আমি তোমার পূজার সমস্ত সামগ্রী ভেঙে দেব।’

জয়াবতী বলল,

‘আজ আমি মঙ্গলচণ্ডীর পূজা করছি, আর তুমি আমার পূজার উপকরণ নষ্ট করতে চাও?’

জয়দেব জিজ্ঞাসা করল—

‘মঙ্গলচণ্ডীর পূজা করলে কি হয়?’

জয়াবতী বলল —

‘মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করলে আগুনে কিছু পোড়ে না, জলে কিছু ডোবে না, নষ্ট জিনিস উদ্ধার হয়, কেউ তাকে তরোয়াল দিয়ে কাটতে পারে না, মরে গেলে সে আবার জীবন ফিরে পায়’।

কিছুকাল পরে স্বপ্নে মঙ্গলচণ্ডীর আদেশে জয়দেবের সঙ্গে জয়াবতীর বিয়ে হল। জয়দেব যখন জয়ারতীকে বিয়ে করে নৌকা করে ফিরছিল, জয়াবতীর হঠাৎ মনে পড়ল যে সেটা জয়মঙ্গলবার। জয়াবতী তাড়াতাড়ি মঙ্গলচণ্ডীর একটা শুকনো ফুল গিলে ফেলল এবং দেবীর কাছে প্রার্থনা করল তার ত্রুটি যেন তিনি মার্জনা করেন। জয়দেবের পুরানো দিনের কথা মনে পড়ল, মঙ্গলচণ্ডীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে জন্মাবতী তাকে যা বলেছিল। পরীক্ষা করবার জন্য জয়দেব জয়াবতীকে বলল,

‘এখানে বড় দস্যুর ভয়, তুমি তোমার অলঙ্কারগুলো খুলে ফেলে, একটা পোটলা করে আমাকে দাও।’

জয়াবতী এরূপ করলে, জয়দেব পোঁটলাটা জলে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বোয়াল মাছ এসে সেটা গিলে ফেলল।

বরকনে বাড়ি এলে, অত বড় ধনীর মেয়েকে নিরাভরণা দেখে সকলেই নানারকম মন্তব্য করতে লাগল। জয়াবতী চুপ করে রইল। বউভাতের দিন একটা বড় বোয়াল মাছ আনা হল। জেলে মাছটা কাটতে পারল না। পরীক্ষা করবার জন্য জয়দেব জয়াবতীকে মাছটা কাটতে বলল।

জয়াবতী রাজী হল, তবে বলল, যে সে পরদার আড়ালে বসে মাছটা কাটবে। পরদার আড়ালে গিয়ে জয়াবতী মঙ্গলচণ্ডীকে স্মরণ করল। মঙ্গলচণ্ডী আবির্ভূতা হয়ে মাছটা কেটে ফেললেন, এবং মাছটার পেট থেকে তার অলঙ্কারের পোঁটলাটা বের করে তার হাতে দিলেন। জয়াবতী যখন অলঙ্কার পরে পরদার ভিতর থেকে বেরুল, তখন সকলে তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তারপর অত মাছ কেউ রাঁধিতে পারল না। তাও জয়াবতী মঙ্গলচণ্ডীর সাহায্যে বাধল।

তারপর জয়াবতীর এক সন্তান হল। জয়দেব আবার পরীক্ষা করবার জন্য ছেলেটাকে কুমোরদের ভাটির মধ্যে রেখে এল। কিন্তু মঙ্গলচণ্ডী এসে জয়াবতীর কোলে তার সন্তানকে দিয়ে গেলেন। তারপর একদিন জয়দেব ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে পুকুরে ডুবিয়ে দিল। আবার মঙ্গলচণ্ডী ছেলেটাকে এনে জয়াবতীর কোলে দিয়ে গেলেন এবং বললেন ভবিষ্যতে যেন সে ছেলের সম্বন্ধে সাবধান হয়। একদিন জয়দেব ছেলেটাকে কেটে ফেলতে যাচ্ছে, এমন সময় জয়াবতী দেখতে পেয়ে, জয়দেবকে বলল—

‘তুমি এখনও মঙ্গলচণ্ডীর দয়ায় বিশ্বাস করছ না?”

জয়দেব বলল—

‘হ্যাঁ, এখন আমি বিশ্বাস করি।’

এইভাবে জয়মঙ্গলবারে মঙ্গল চণ্ডীর পূজার প্রবর্তন হল।

অরণাষষ্ঠীর পূজার প্রবর্তন সম্বন্ধে যে কাহিনীটা আছে, তা হচ্ছে—এক ব্রাহ্মণের তিন পুত্র ও তিন পুত্রবধূ ছিল। ছোট বোঁটা খুব পেটুক ছিল, এবং খাদ্যসামগ্রী লুকিয়ে থেয়ে বিড়ালের নামে দোষ দিত। বিড়াল হচ্ছে মা ষষ্ঠীর বাহন। মিছামিছি তার নামে দোষ দেয় বলে সে মা ষষ্ঠীর কাছে গিয়ে ছোট বৌয়ের নামে নালিশ করল।

কালক্রমে ছোটবৌ অস্তঃসত্ত্বা হল, এবং যথাসময়ে এক পুত্রসন্তান প্রসব করল। কিন্তু পরের দিন সকালবেলা কেউ আর ছেলেটাকে তার কাছে দেখতে পেল না। এইভাবে তার সাতটা সন্তান হল, কিন্তু রাত্রিকালে ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কেউ আর ছেলের সন্ধান পেল না ।

অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠী

মনের দুঃখে ছোটবৌ বনে গিয়ে কাঁদতে লাগল। সেখানে বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশে ষষ্ঠীঠাকরুণ আবির্ভূতা হয়ে ছোটবৌকে জিজ্ঞাসা করলেন—

‘তুমি বনে এসে কাঁদছ কেন মা?”

ছোটবৌ তাঁকে তার সব দুঃখের কথা বলল। তখন ষষ্ঠীঠাকরুণ বোষকণ্ঠে তাকে বললেন—

‘তুই জানিস না, চুরি করে খাস, আর ষড়ীর বাহন বিড়ালের নামে দোষ দিস্?’

তখন ছোটবৌ বুঝতে পারল ওই ব্রাহ্মণী কে, এবং তাঁর দুটো পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ষটী দেবীর দয়া হল। তিনি বললেন-

‘দ্যাথ, ওখানে একটা মরা বিড়াল পড়ে আছে, এক ভাঁড় দই এনে ওর গায়ে ঢেলে দে, এবং চেঁটে তা ভাঁড়ে তোল”।

ছোটবৌ ষষ্ঠীর আদেশমতো ওইরূপ করলে, ষড়ীঠাকরুণ তাকে তার সাত ছেলে ফিরিয়ে দিলেন ও তাদের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিতে বললেন। তিনি আরও বললেন, ‘কখনও চুরি করে কিছু খাস না। আর বিড়ালকে কখনও লাখি মারবি না, এবং বা হাত দিয়ে কখনও ছেলেকে মারবি না, বা ‘মরে যা’ বলে কখনও ছেলেকে গাল দিবি না।’

অরণ্যষষ্ঠীর দিন কিভাবে ষীপুজা করতে হয়, সে সম্বন্ধেও তিনি উপদেশ দিলেন। আরও বললেন—

‘অরণ্যষষ্ঠীর দিন ফলার করবি, কখনও ভাত খাবি না।’

তারপর ষষ্ঠীদেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ছোটবৌ সাত ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল, এবং সব কথা নিজের জায়েদের বলল। সকলেই সেই থেকে অরণ্যষীর পূজা আরম্ভ করল।

পাঁচ

অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার মেয়েরা ইতুপূজা করে। ইতুপূজার কথা তারা যা বলে তা হচ্ছে—কোন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের দুই মেয়ে ছিল, নাম উমনো ও ঝুমনো। ব্রাহ্মণ একদিন ভিক্ষা করে কিছু চাল এনে ব্রাহ্মণীকে বললেন তাকে পিঠে তৈরি করে দিতে। এক-একটা পিঠে তৈরি হচ্ছে আর ব্রাহ্মণ দাওয়ায় বসে একগাছা দড়িতে একটা করে গেরো দিচ্ছেন। ব্রাহ্মণকে যখন পিঠে দেওয়া হল, তখন তিনি দুখানা পিঠে কম দেখলেন।

গৃহিণী বললেন, দুখানা পিঠে দুই মেয়েকে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে, দুই মেয়েকে পরদিন মাসির বাড়ি নিয়ে যাবার ছল করে তাদের বনবাস দিয়ে এলেন। বনে ঘুরতে ঘুরতে তারা কতকগুলি মেয়েকে ইতুপূজা করতে দেখল। তাদের কাছ থেকে তারা জানল যে ইতুপূজা করলে বাপ-মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়। এই কথা শুনে তারা বাড়ি গিয়ে ইতুপূজা করতে লাগল। ব্রাহ্মণ তাদের দেখে প্রথমে খুব চটে গেল, কিন্তু যখন ইতুপূজার মাহাত্ম্যের কথা শুনল, তখন কিছু নরম হল।

এর কিছুদিন পরে ওই দেশের রাজা মৃগয়ায় বেরিয়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে তাদের বাড়ি এসে জল চাইল। উমনো-ঝুমনো জল এনে দিল। তাদের দেখে রাজা ও মন্ত্রী তাদের বিয়ে করতে চাইলেন।

বিয়ের পর স্বামিগৃহে যাবার দিন উমনো ভাত-তরকারি খেল। সেদিন ইতুপূজা, সেজন্য ঝুমনো শুধু ইতুর প্রসাদ খেল। উমনো রাজপ্রাসাদে আসা মাত্র নানারকম অঘটন ঘটতে লাগল। রাজা তাকে বোনের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। ঝুমনো উমনোকে বলল—’বোন, তুই ইতুপূজার দিন ভাত খেয়েছিলি, সেজন্য ইতুর কোপে পড়েছিস্, তুই ইতুপূজা করে ইতুকে প্রসন্ন কর।’ উমনো তাই করল। রাজার আবার সমৃদ্ধি ফিরে এল। রাজা উমনোকে নিয়ে গেলেন। উমনো রাজাকে সব কথা বলল। সেই থেকে ইতুপূজার প্রচলন হল।

একদিন পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তুমি কিসে সবচেয়ে বেশি তুষ্ট হও।’ শিব বললেন, ‘শিবরাত্রির দিন যদি কেউ উপবাস করে আমার মাথায় জল দেয় তো আমি খুব তুষ্ট হই।’ তখন মহাদেব পার্বতীকে একটা কাহিনী বললেন: বারাণসীতে এক ব্যাধ ছিল। একদিন সে অনেক পশু শিকার করে এবং তার ফিরতে রাত্রি হয়ে যায়।

বাঘ ভাল্লুকের ভয়ে সে এক গাছের উপর আশ্রয় নেয়। ওই গাছের তলাতেই এক শিবলিঙ্গ ছিল। রাত্রিতে ব্যাধ যখন ঘুমোচ্ছিল তখন তার এক ফোঁটা ঘাম (মতান্তরে নীহারকণা) মহাদেবের মাথায় পড়ে। সেদিন শিবরাত্রির দিন ছিল এবং ব্যাধ ও সারাদিন উপবাসী ছিল। মহাদেব তার ওই এক ফোঁটা ঘামেই তুষ্ট হন। যথাসময়ে যখন ব্যাধের মৃত্যু হয়, যমদূত এসে তাকে নরকে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু শিবদূত বাধা দিয়ে তাকে শিবলোকে নিয়ে গেল। এইভাবে শিবরাত্রি ব্রতের প্রচলন হল।

শীতলা পূজা প্রচলিত হয়েছিল এইভাবে : রাজা নহষ একবার পুত্রেটি যন্ত্র করে ছিলেন। যজ্ঞাগ্নি নির্বাপিত হয়ে শীতল হলে, তা থেকে এক পরমা সুন্দরী রমণী আবির্ভূতা হন। ব্রহ্মা তার নাম দেন শীতলা, এবং বলেন যে, ‘তুমি পৃথিবীতে গিয়ে বসন্তের কলাই ছড়াও, এরূপ করলে লোকে তোমার পূজা করবে।’ শীতলা বললেন,

‘আমি একা পৃথিবীতে গেলে, লোকে আমার পূজা করবে না, আপনি আমার একজন সঙ্গী দিন’।

ব্রহ্মা তাঁকে কৈলাসে শিবের কাছে যেতে বললেন। শীতলা কৈলাসে গিয়ে শিবের কাছে তাঁর প্রয়োজনের কথা বললেন। মহাদের চিন্তিত হয়ে ঘামতে লাগলেন। তাঁর ঘাম থেকে জরাস্থর নামে এক ভীষণকায় অসুর সৃষ্টি হল। জরাস্থর শীতলার সঙ্গী হলেন। শীতলা বললেন,

‘দেবতারা যদি আমার পূজা না করেন, তা হলে পৃথিবীর লোক করবে কেন?”

তখন শিব তাঁকে বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশে ইন্দ্রপুরীতে যেতে বললেন। ইন্দ্রপুরীর রাস্তা দিয়ে যাবার সময় জরাসুরের মাথা থেকে বসস্তের কলাইয়ের ধামাটা রাস্তায় পড়ে গেল। সে-সময় ইন্দ্রের ছেলে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। শীতলা তাকে ধামাটা জরাস্থরের মাথায় তুলে দিতে বললেন। ইন্দ্রের ছেলে এটা তার পক্ষে মর্যাদা হানিকর মনে করে, ব্রাহ্মণীকে ঠেলে ফেলে দিল।

শীতলা দেবী

শীতলার আদেশে জরায়ুর ইন্দ্রের ছেলেকে আক্রমণ করল। এর ফলে ইন্দ্রের ছেলে বসন্তরোগে আক্রান্ত হল। তারপর শীতলা দেবসভায় গিয়ে ইন্দ্রকে আশীর্বাদ করলেন। ইন্দ্ৰ তো চটে লাল। ভাবলেন সমস্ত জগতের লোক তাঁকে পূজা করে, আর এ কোথাকার এক বুড়ি এসে তাঁকে আশীর্বাদ করছে। এর আস্পর্ধা তো কম নয়! ইন্দ্র তাকে মেরে তাড়িয়ে দিলেন।

তারপর ইন্দ্র নিজেও বসন্তরোগে আক্রান্ত হলেন। অন্যান্য দেবতারাও হলেন। মহামায়ার দয়া হল। তিনি গিয়ে শিবের শরণাপন্ন হলেন। শিব বললেন, ‘দেবতারা সকলে শীতলার পূজা করুক, তা হলে রোগ মুক্ত হবে।’ তখন দেবতারা ঘটা করে শীতলার পূজা করলেন। এইভাবে শীতলা দেবলোকে স্বীকৃতি পেলেন।

তারপর শীতলা জরাস্থরকে নিয়ে পৃথিবীতে এলেন। প্রথমে তিনি বিরাট রাজার রাজ্যে এলেন। স্বপ্নে তিনি বিরাটকে শীতলার পূজা করতে বললেন। বিরাট বলল,

‘আমার বংশে কেউ কখনও নারীদেবতার পূজা করেনি, আমি নারীদেবতার পূজা করব না।’

বিরাটরাজ্যে মহামারীরূপে বসন্ত দেখা দিল। প্রজারা সব মরতে লাগল। বিরাটের তিন ছেলে মারা গেল। তবুও বিরাট অনড়, অটল। নারীদেবতার সে পূজা করবে না। বিরাটের এক পুত্রবধূ তখন পিত্রালয়ে ছিল।

শীতলা সেখানে গিয়ে তাকে বললেন, ‘তুমি যদি শীতলার পূজা কর, তা হলে তোমার স্বামী ও তার ভাইয়েরা বেঁচে উঠবে।’ পুত্রবধূ দ্রুত বিরাটরাজ্যে ফিরে এসে শীতলার পূজা করলেন। তার স্বামী ও তার ভাইয়েরা সব বেঁচে উঠল। শীতলা যে বসন্তের দেবতা তা বিরাটরাজার প্রত্যয় হল। সেই থেকে পৃথিবীতে শীতলা পূজার প্রচলন হল।

আট

অঞ্চলভেদে এসব কাহিনীর পার্থক্য আছে। তা ছাড়া, পরবর্তীকালে রচিত নূতন কাহিনী আদিম কাহিনীকে চাপা দিয়েছে। যেমন, ওপরে লক্ষ্মীর যে কাহিনী দেওয়া হয়েছে, সেটাই হচ্ছে আদি কাহিনী। এখন প্রতি বৃহস্পতিবার মেয়েরা লক্ষ্মীর পূজা করে, ছাপা বই দেখে পাঁচালী পাঠ করে, তার কাহিনী অন্যরূপ।

আবার অরণ্যষষ্ঠীর যে কাহিনী দেওয়া হয়েছে, তাছাড়া আর একটা কাহিনী আছে। সে কাহিনীতে ছোট বউয়ের কথা নেই। তার পরিবর্তে আছে অভিশপ্ত এক বিদ্যাধর বিদ্যাধরীর কাহিনী। সকল অলিখিত সাহিত্যের উপাথ্যানসমূহের রূপভেদ বিশেষভাবে লক্ষ্য করি গন্ধেশ্বরী পূজার কাহিনী সমুহে। গন্ধেশ্বরী হচ্ছে গন্ধবণিক জাতির দেবতা। গন্ধেশ্বরী তাদের শত্রু গন্ধাসুরকে বধ করেছিল বলেই গন্ধবণিক সমাজ তার পূজা করে। কিন্তু গন্ধেশ্বরী পূজার উদ্ভব সম্বন্ধে অন্য কাহিনীও প্রচলিত আছে।

অলিখিত এইসব উপাখ্যানের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উপাখ্যানের মধ্যে অলৌকিক ঘটনার সন্নিবেশ। হিন্দু এসব কাহিনীর অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করত। সেই কারণেই হিন্দুর নৈতিক মান খুব উচ্চস্তরে ছিল। আজ হিন্দু সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মন থেকে পাপপুণ্যের বিশ্বাস ও লোপ পেয়েছে। সেজন্যই হিন্দুর নৈতিক মান আজ নিম্নস্তরে গিয়ে পৌঁছেছে।

আরও করুন:

 

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- আগেই বলেছি ( বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা অধ্যায় স্ৰষ্টবা) যে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে চর্যাগানসমূহ। তারপর মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হবার পূর্বে বাঙলায় নাথধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে। নাথধর্মকে অবলম্বন করে বাঙলায় এক সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, যাকে আমরা ‘নাথসাহিত্য’ বলি। এই সাহিত্যের উপজীব্য হচ্ছে দুটি কাহিনী। একটি গুরু মীননাথ ও তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথকে নিয়ে। অপরটি রাজা মানিকচন্দ্র, তাঁর স্ত্রী ময়নামতী ও পুত্র গোপীচাঁদকে নিয়ে।

নাথসম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতা হচ্ছেন মহাদেব। যোগের সাহায্যে জীবন্মুক্তি, অসাধ্য সাধন ও মৃত্যুর ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করা ইত্যাদি ও’দের লক্ষ্য বলে নাথ সম্প্রদায় শৈব-যোগী সম্প্রদায়রূপে আখ্যাত। এই ধর্মটি একসময় অধিল ভারতীয় ধর্মে পরিণত হয়েছিল এবং কেবল বাংলা ভাষাতে নয়, নাথধর্মের উপাখ্যানগুলি নিয়ে হিন্দী, মারাঠী, গুজরাতী, পাঞ্জাবী, সিংহলী প্রভৃতি নানা ভাষায় নানা সাহিত্য গড়ে উঠেছিল। চর্যাগীতের মতো এঁদের সাহিত্যেও গূঢ় সাধনতত্ত্ব হেঁয়ালি ভাষায় রচিত। যথা, গোপীচন্দ্ৰ সন্দিগ্ধ মনা হয়ে মাতা ময়নামতীকে জিজ্ঞাসা করছেন—’কোন্ বিরিথির বোঁটা আমি মা কোন্ বিরিখের ফল।

[ বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ]

মা, উত্তর দিতেছেন—‘মন বিরিথের বোটা তুই তন্ বিরিখের ফল। গাছের নাম মহুহর, ফলের নাম রদিয়া। গাছের ফল গাছে থাকে, বোঁটা পড়ে খসিয়া কাটিলে বাঁচে গাছ, না কাটিলে মরে। দুই বিরিখের একটি ফল জাননি সে ধরে। এটা ‘ময়নামতীর গান’ থেকে উদ্ধৃত। দ্বিতীয় কাহিনীটি ‘ময়নামতীর গান’ ছাড়া, ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’, ‘গোপীচন্দ্র রাজার গান’, ‘গোবিন্দচন্দ্রের সন্ন্যাস’ ইত্যাদি নানা নামে মৌখিক ও লিখিতরূপে পাওয়া গিয়েছে।

কাহিনীটি প্রথম একখানি প্রাচীন পুঁথি থেকে সংকলন করে নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় ‘মীনচেতন’ নামে প্রকাশ করেন। তারপর একাধিক পৃথি তুলনা করে মুন্সী আবদুল করিম ‘গোরক্ষবিজয়’ নামে প্রকাশ করেন। আরও অধিকসংখ্যক পুঁথির সাহায্যে বিশ্বভারতী থেকে পঞ্চানন মণ্ডল ‘গোর্খবিজয়’ নামে প্রকাশ করেন। পুথিগুলিতে নানারকম ভণিতা আছে, যথা, ভীমদাস বা ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন, ভবানীদাস, ফয়জুন্না ও শুকুর মামুদ।

দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বা তার কাছাকাছি কোন সময় নাথধর্মের উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তবে কাহিনীগুলি প্রথমে যৌথিক আকারে ছিল, পরে লিখিতরূপ ধারণ করেছিল, কেননা যে সকল পুঁথি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি সবই তিনশো বছরের অধিক পুরানো নয়। এখানে উল্লেখনীয় যে বাংলা ভাষার প্রাচীন রূপের এক নিদর্শন রয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘শেখ শুভোদয়া গ্রন্থের এক প্রেমগীতিতে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এই প্রেমগীতিটি দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। শেখ শুভোদয়া’য় বিবৃত হয়েছে রামপালের মৃত্যু ও বিজয়সেনের রাজাপ্রাপ্তি।

বাঙলার আদি কবি চণ্ডীদাস (১৪১৭-৭৭)। পদাবলী সাহিত্যের তিনিই প্রবর্তক। রাধা ও কৃষ্ণের মিলনের মাধ্যমে ‘সহজ’ সাধনার উদ্বোধন করাই পদাবলী সাহিত্যের উদ্দেশ্য ছিল। ‘পদাবলী’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে (১৩) যদিও পদাবলী বলতে সাধারণত শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্যের লীলাবিষয়ক গীত বুঝায় ৷ দাক্ষিণাত্যে ও মিথিলায় শিবকে নিয়ে ও বাঙলায় উমাকে নিয়েও কিছু পদ রচিত হয়েছিল। এ সাহিত্যের ভাষা অতি সরল। যেমন, চণ্ডীদাসের এক পদগীত আরম্ভ হচ্ছে— ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম। কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ। আর একজন পদকর্তার রচনায় পাই—‘ওপার হতে বাজাও বাঁশী এপার হতে শুনি। অভাগিয়া নারী আমি সাঁতার নাহি জানি।

নিজের মন-মন্দিরে চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের যে শাশ্বত প্রেমলীলা অনুভব করেছিলেন, তাই গভীর ভাবানুভূতির সঙ্গে অভিব্যক্ত করেছেন তাঁর রচিত পদসমূহে। চণ্ডীদাসের এই গভীর অনুভূতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন

—’ঠাকুর ঠাকুর কর তুমি, ঠাকুর কোথা পাবে।

দিলদরিয়ার কপাট খোল ঠাকুর দেখতে পাবে।

বস্তুত চণ্ডীদাসের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী রাধার হৃদয় আর্তির সকরুণ কাহিনী। আগেই বলেছি যে চণ্ডীদাস ছিলেন সহজ-সাধনার কবি। কথিত আছে তিনি রামী নামে এক রজকিনীর সঙ্গে এই সহজ-সাধনায় লিপ্ত ছিলেন।

‘বুজকিনী’ শব্দটা ‘ধোবানী’ অর্থেই সকলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় এর অর্থ অন্য। সহজ-সাধনা যে তান্ত্রিক সাধনারই একটা বিশেষরূপ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাধা ছিল ‘যোগিনীপারা’। সেজন্য আমার মনে হয় যে ‘রজকিনী’ শব্দটা তান্ত্রিক সাধকদের অর্থে গ্রহণ করা অন্যায় হবে না। রেবতীতন্ত্রে ‘চণ্ডালী’, ‘যবনী’, ‘বৌদ্ধা’, ‘রজকী’ প্রভৃতি চৌষট্টি প্রকার কুলস্ত্রীর বিবরণ আছে। নিরুত্তরতন্ত্রকার বলেন, ওই সকল চণ্ডালী, জেকী প্রভৃতি শব্দ বর্ণ বা বর্ণসঙ্করবোধক নয়, কার্য বা গুণের বিজ্ঞাপক।

বিশেষ বিশেষ কার্যের অনুষ্ঠান করলে সকল বর্ণোদ্ভবা কন্যাই ওই সমস্ত আখ্যা প্রাপ্ত হয়। যেমন, ‘পূজাদ্রব্যং সমালোকা রজোহবস্থাং প্রকাশয়েত। সর্ববর্ণোদ্ভবা রম্যা রজকী সা প্রকীর্তিতা।’ মানে পূজাভ্রব্য দেখে যে-কোন বর্ণোদ্ভবা কন্যা রজোহবস্থা প্রকাশ করে, তাকে রজকী বলে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে চণ্ডীদাস বাশুলীদেবীর সেবক ছিলেন। বাগুলী বা বিশালাক্ষী চৌষটি যোগিনীর অন্যতমা। রামী সম্বন্ধে আমি যে প্রশ্ন এখানে তুলেছি, আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্য নিয়ে ধারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁদের এটা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।

বস্তুত চণ্ডীদাস সম্বন্ধে আমাদের কাছে অনেক কিছু অজ্ঞাত থেকে গিয়েছে। তার কারণ, চণ্ডীদাসকে আমরা বিশেষভাবে জেনেছি মাত্র একশো বছরের কিছু আগে। চণ্ডীদাসের কথা আমাদের প্রথম শোনান রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এ একটি প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় সম্পর্কে । তারপর জগদ্বন্ধু ভদ্র বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশ করে চণ্ডীদাস ও অন্যান্য বৈষ্ণব কবিদের রচিত পদাবলীগুলি আমাদের নজরে আনেন। এর কিছু পরে অক্ষয়চন্দ্র সরকার চণ্ডীদাসের সঙ্গে বাঙালী পাঠককে পরিচিত করিয়ে দেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নীলরতন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত ‘চণ্ডীদাস পদাবলী’র একটা সংস্করণ বের করে। বটতলার প্রকাশন সংস্থাসমূহ থেকেও ‘চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি পদাবলী’র এক সংস্করণ বেরোয়।

চণ্ডীদাসের নামে যে সকল পদাবলী পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে নানা রকম ভণিতা দেখতে পাওয়া যায়। যথা ‘চণ্ডীদাস’, ‘বড়ু চণ্ডীদাস’, ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’, ‘দীন চণ্ডীদাস’ প্রভৃতি। সুতরাং স্বভাবতই মনে হয় যে একাধিক চণ্ডীদাস ছিলেন। তার মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাস ( চতুর্দশ শতাব্দী) রচিত একখানা গ্রন্থের পুঁথি বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় বাঁকুড়া থেকে আবিষ্কার করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাম দিয়ে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশ করেন। এর প্রকাশক হচ্ছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। কিন্তু এই বডু চণ্ডীদাস কে? এ সমস্যা আজও মীমাংসিত হয়নি। কেননা, এর পুঁথিতে ‘বডু চণ্ডীদাস’ ভণিতা ছাড়া, বার পাঁচেক ‘অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস ভণিতাও আছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন [ Sri Krishna Kirtan ]
তবে পদাবলী রচয়িতা চণ্ডীদাসের ভাষার সঙ্গে বড়ু চণ্ডী দাসের ভাষার প্রভেদ আছে। বড়ু চণ্ডীদাদের ভাষার নমূনা—’মুছিআঁ) পেলায়িবে। বড়াই শিষের সিঁদুর। বাহুর বলায় মো করিবে। শঙ্খচুর। কাহু বিন। সবখন পোড়এ পরানী। বিষাইল কাণ্ডের ঘাত্র যেহেন হরিণী। বিদ্যাপতি ১৩৬০-১৪৮০ মূলতঃ মৈথিলী কবি ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলি মৈথিলী ভাষাতেই রচিত। তবে দু-একটি পদ বাংলা থেকে তফাত নয়। যেমন, ‘বালা রমণী রমণে নাহি সুখ। মদন দ্বিগুণ দেয় দুখ

চৈতন্য-পূর্বযুগের পদাবলীর মধ্যে আমরা সাধারণত দুটি ধারা দেখতে পাই একটি বিদ্যাপতির, অপরটি চণ্ডীদাসের। বিদ্যাপতির পদ অলংকারসমৃদ্ধ, আর চণ্ডীদাসের সহজ ও সরল এবং অলংকারবর্জিত। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের বৃহত্তম সংকলন হচ্ছে গোকুলানন্দ সেনের ‘পদকল্পতরু’। চৈতন্ত্রের সমসাময়িক পদকর্তা হিসাবে নাম করে ছিলেন নরহরি সরকার, গোবিন্দ আচার্য, মুরারি গুপ্ত বলরাম দাস, বংশীবদন, গোবিন্দমাধব, বাসুদেব ঘোষ ও রামানন্দ বসু। চৈতন্য উত্তর যুগে পদকর্তা হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন জ্ঞানদাস, রায়শেম্বর, লোচন দাস, গোবিন্দ দাস কবিরাজ, নরোত্তম ঠাকুর ও বলরাম দাস। অনেক মুসলমান কবিও পদাবলী রচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর পরিবর্তে শাক্ত পদাবলীরই প্রাধান্য দেখি।

বৈষ্ণব সাহিত্য বিশেষভাবে পুষ্ট হয় চৈতন্যোত্তর যুগে। শ্রচৈতন্য (১৪৮৬ ১৫৩৩) নিজে কোন সাহিত্য রচনা করেননি। কিন্তু তাঁর তিরোভাবের পর তাঁর মহিমাময় জীবন অবলম্বনে এক জীবনী-সাহিতা রচিত হয়। মহাপ্রভুর দৈবী মহিমাই এই সকল জীবনী-কাব্যে বিবৃত হয়েছে। এই জীবনী-কাব্যের মধ্যে প্রাধান্য হচ্ছে বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ বা ‘চৈতন্যভাগবত ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের ( ১৫৩০-১৬১৫ ) ‘চৈতন্যচরিতামৃত’। এ দুটি রচিত হয়েছিল খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে। এ ছাড়া, আর একখানা সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে গোবিন্দদাদের ‘কড়চা’। আরও যারা বৈষ্ণব সাহিত্য রচনায় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুরারি গুপ্ত, পরমানন্দ সেন, লোচনদাস, জয়ানন্দ মিশ্র, হরিচরণ দাস, ঈশান নাগর প্রমুখ। এ ছাড়া বৈষ্ণর মহাজন পদাবলী রচনায় যারা খ্যাতিলাভ করেছিলেন, তাঁদের নাম আগেই দিয়েছি।

সপ্তদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রাচুর্য থাকলেও ( এ সময় অনেক মুসলমান পদকর্তারও প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল) মনে হয় চৈতন্যের ভাবপ্রেরণা কিছু হ্রাস পেয়েছিল, কেননা, সূফী ধর্মের সহিত সহজিয়া ধর্মের কিছু মিল থাকায় গৌকিক স্তরে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম-সাধনার কতকটা সমন্বয় হয়েছিল ও তা সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছিল বাউল সম্প্রদায়ের গানে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন [ Sri Krishna Kirtan ]
তিন

মুসলমানগণ কর্তৃক বাঙলা বিজিত হবার পর, বাঙলাদেশে সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চা বিপর্যস্ত হয়। অন্তত উচ্চকোটি সমাজে আমরা এ সম্বন্ধে এক শুন্যময় পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এর কোন ছেদ পড়েনি। গ্রামে যে সকল লৌকিক দেবদেবীর প্রভাব ছিল, তাঁদের মহাত্মা সম্বন্ধে পালাগান গাইবার জন্য মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত হয়েছিল। এই পালাগান সমূহকে ‘পাচালী’ বা পাঞ্চালিকা বলা হত, এবং সেগুলি রাতের পর রাত নাচ ও বাজনার সঙ্গে গাওয়া হত।

মঙ্গলকাব্যসমূহ বিশেষভাবে রচিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে, যখন বাঙলাদেশে স্বাধীন সুলতানদের আমলে দেশে আবার শাস্তিসমৃদ্ধি ফিরে আসে। তখন হিন্দু জায়গিরদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলাদেশে আবার কাব্য চর্চার সূত্রপাত হয় ও মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত হতে থাকে, যথা— মনসামঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি। মনসামঙ্গলের উদ্দেশ ছিল মনসা বা সর্পদেবীর পূজা মাহাত্মা প্রচার করা।

কাহিনীর নায়ক-নায়িকা ছিল চাঁদ সদাগর ও তাঁর পুত্র লখীন্দর ও পুত্রবধূ বেহুলা। শতাধিক কবি মনসামঙ্গল রচনা করে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন প্রাক্-চৈতন্যযুগে হরিদত্ত, বিজয়গুপ্ত (১৪০৬ ৪৮), বিপ্রদাস (১৪১৭-৯৫) ও নারায়ণদেব এবং চৈতন্যোত্তর যুগে কেতকাদাস, ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ বংশীদাস, জীবন মৈত্র প্রভৃতি। মনসামঙ্গলের ভাষা খুব সরল, যথা—’জাগ ওহে বেহুলা সায় বেনের ঝি। তোরে পাইল কালনিদ্র। মোরে খাইল কি।’

মনসামঙ্গলে যেমন একটি কাহিনী আছে, চণ্ডীমঙ্গলে আছে দুটি কাহিনী। একটি ব্যাধ কালকেতু-লহনা-খুলনা ও আর একটি ধনপতি সদাগর-শ্রমস্ত সদাগর সম্পর্কিত।

চণ্ডীমঙ্গলের কবিদের যধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মানিক দত্ত, দ্বিজ মাধব ও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দরামের ভাষার নমুনা সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙা পিতল। ঘদিয়া মাজিয়া বাপা করেছ উজ্জ্বল।

মুকুন্দরামকেই অনুসরণ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় রচনা করেছিলেন তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। শ্রুতিমধুর শব্দের জন্য এখানা ছিল শব্দের ‘তাজমহল’। ওই অষ্টাদশ শতাব্দীতেই মেদিনীপুর কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্ত সিংহের সভাকবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন তাঁর ‘শিবায়ন’ কাব্য। শিবায়ন কাব্যে শিবকে সাধারণ কৃষক ও শিবজায়াকে কৃষকপত্নী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের প্রতিবেশীর নিকট ঋণ করে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু ঋণের কি মর্মান্তিক বেদনা, তা কবি বর্ণনা করে বলেছেন- ‘গতে ঋণে বিষয়ে কুক্কুর-রতিবশে প্রবেশে পরম সুখ প্রাণ যায় শেষে।

মঙ্গলকাব্যসমূহের একটা বড় শাখা হচ্ছে ধর্মমঙ্গল। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য অবলম্বন করে এগুলি রচিত। কিন্তু এর কাহিনীর একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। ধর্মমঙ্গল কারাসমূহে ডোম জাতীয় নরনারীর বীরত্ব কীর্তিত হয়েছে। ময়ূরভট্টকেই ধর্মমঙ্গলের আদিকবি বলা হয়। অবশ্য তাঁর পূর্বে রামাই পণ্ডিত ‘শূন্যপূরাণ’ রচনা করেছিলেন। ময়ূরভট্টের ভাষার নমুনা — ‘স্বামী মৈল সংগ্রামে সংসার ভাবি বৃথা। চিতানলে ছয় বধূ হৈল অনুমৃতা। পুত্রশোকে মৈল রাণী ভথিয়া গরল। সর্বশোকে কর্ণসেন হইল পাগল। আর যারা ধর্মমঙ্গল কাবা রচনা করেছিলে তাঁদের মধ্যে ছিলেন সহদেব চক্রবর্তী, রূপরাম চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তী।

লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য আরও যেসব মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর কাবা, শীতলামঙ্গল, মঙ্গল, সারদামঙ্গল, রায়মঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, কপিলামঙ্গল প্রভৃতি। কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী অবলম্বন করেই ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। অন্নদা ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের গৃহদেবতা।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন [ Sri Krishna Kirtan ]
মঙ্গলকাবা ছাড়া, মধ্যযুগে পুরাণ ও মহাকাব্যসমূহকে অবলম্বন করেও কাবা রচনা করা হয়েছিল। এই যুগেই রচিত হয়েছিল অনন্ত ও কৃত্তিবাদের রামায়ণ ও মালাধর বস্তুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। সুলতান হুসেন শাহের অধীনে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল যার আদেশে পরমেশ্বর দাস কর্তৃক রচিত হয়েছিল। ‘পাওববিজয়’ নামে মহাভারতের একটি কাব্যাহবাদ। পরাগলের পুত্র ছুটি খার আদেশে ঐকর নন্দী অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’।

বস্তুতঃ এ যুগের অনেক মুসলমান শাসনকর্তাই উৎসাহিত করেছিলেন অনুবাদ করে, রচনায়, বহু বাঙালী কবিকে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থ ও ভূমিদান ও রাজকীয় উপাধি দিয়ে। বলা বাহুল্য এই সকল অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দুসমাজের সংস্কৃতি ও আদর্শ আবার সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। সেটা প্রকাশ পায় রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদপ্রাচুর্য থেকে। অনস্তই প্রথম রামায়ণ অনুবাদ করেন। তারপর করেন কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস ছাড়া ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামায়ণ রচনা করেছিলেন মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। ইনি, ‘মনসার ভাসান’ রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা।

তাঁর বংশ-পরিচয়ে তিনি বলেছেন— ‘বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়। পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়। সুলোচনা মাতা বন্দি দ্বিজবংশী পিতা। যার কাছে শুনিয়াছি পুরাণের কথা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কাব্যের গানগুলি আজও মৈমনসিংহ জেলার মেয়েরা বিবাহ, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি সামাজিক উৎসবে গেয়ে থাকে। পরবর্তী রামায়ণকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-রঘুনন্দন গোস্বামী, কৈলাস বসু, রামশঙ্কর দত্ত, ভবানী দাস, দ্বিজ লক্ষ্মণ, শঙ্কর চক্রবর্তী, দ্বিজ ভবানীনাথ, রামানন্দ ঘোষ, রামপ্রসাদ রায় প্রভৃতি কবিগণ।

কাশীরামের সুবিখ্যাত ‘মহাভারত’ রচিত হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। কথিত আছে যে কাশীরাম কাব্যখানিকে সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি এবং এটাকে সম্পূর্ণ করেছিলেন তাঁর সম্পর্কিত ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম ঘোষ। আরও যারা এ সময় মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, ষষ্ঠীধর সেন, নিত্যানন্দ ঘোষ, গঙ্গাদাস ও রামেন্দ্রদাস। এছাড়া, শ্রীমদ্ভাগবত, ব্রহ্ম বৈবর্তপুরাণ, কাশীখণ্ড, হরিবংশ প্রভৃতি অনেক গ্রন্থেরই বাংলায় অনুবাদ হয়েছিল।

পাঁচ

বাংলা সাহিত্যের একটা বিশিষ্ট শাখা হচ্ছে শাক্ত পদাবলী। এর উদ্ভব ও বিকাশ অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয়েছিল। শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি হচ্ছে রাম প্রসাদ সেন। তাঁর সঙ্গীতের অনেক জায়গায় তিনি পরিবেশক রূপক ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘মাগো তারা ও শংকরী, কোন বিচারে আমার পরে করলে দুঃখের ডিক্রীজারী। এক আসামী ছয়টা প্যাদা বল্ মা কিসে সামাই করি, আমার ইচ্ছে করে ওই ছয়টাকে বিষ খাইয়ে প্রাণে মারি।

পলাইতে স্থান নাই মাগো বল মা কিসে উপায় করি। ছিল স্থানের মধ্যে অভয়চূরণ তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি।’ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি যে-সকল হামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন, তা আজও অমর হয়ে আছে। আর যেসব শাক্ত কবির উদ্ভব ঘটেছিল তাঁরা হচ্ছেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, পাঁচালীকার দাশু রায় ও কবিওয়ালা রাম বসু, মিরজা হুসেন, এন্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা প্রমুখ। এন্টনি ফিরিঙ্গির এক বিখ্যাত গান—’আমি ভজন-সাধন জানিনে মা, নিজে তো ফিরিঙ্গি। যদি দয়া করে রূপা কর হে শিবে মাতঙ্গী।’

বাঙালীর স্বভাবের কমনীয়তা, রস ও সৌন্দর্যবোধ ও মাধুর্য বাঙালীকে কাব্যের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সেজন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত বাঙালী গদ্য সাহিত্য রচনা করেনি। গদ্যের ব্যবহার মাত্র চিঠিপত্র ও দলিলাদি সম্পাদনের মধ্যেই নিবন্ধ ছিল। গদ্যসাহিত্যের অভ্যুত্থান ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে, যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীর দু-একখানা গ্যগ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে। তখন থেকেই গ্য বাংলা সাহিত্যে এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে।

আগেই বলেছি যে মধ্যযুগের বাংলা গণ-সাহিত্যের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গলকাব্যসমূহ। মঙ্গলকাব্যসমূহ এক একটা কাহিনী অবলম্বনে রচিত—কেবল চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দুটি আখ্যান ছিল। মঙ্গলকাব্যের কাহিনীগুলির নায়ক নায়িকারা হচ্ছে ইছাই ঘোষ ও লাউসেন, রানী ময়নামতী ও তাঁর ছেলে রাজা গোবিন্দচন্দ্র, ব্যাধ কালকেতু ও তাঁর স্ত্রী খুল্লনা, চাঁদ সদাগর ও তার পুত্র নদীবন্দয় ও পুত্রবধূ বেহুলা, ধনপতি সদাগর ও তার পুত্র শ্রীমস্ত সদাগর। এ কাহিনীগুলি হয়তো অনেকেরই জানা নেই। সেজন্য, সংক্ষেপে এ কাহিনীগুলি এখানে বিবৃত করছি।

প্রথমেই ইছাই ঘোষ ও লাউসেনের কথা বলব। এই কাহিনী নিয়েই ধর্ম মঙ্গল সাহিত্য রচিত। ইছাই ঘোষ ছিলেন অজয় নদ তীরবর্তী ত্রিবন্ধীগড়ের সামন্তরাজ সোম ঘোষের পুত্র। তাঁর আরাধ্যা দেবী ছিলেন শ্যামরূপা। আরাধ্যা দেবীকে সন্তুষ্ট করে ইছাই ঘোষ প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। অজয়ের দক্ষিণ তীরে বন কেটে তিনি ঢেকুর নামে এক নূতন গড় নির্মাণ করেন। এই গড়ের মধ্যে তিনি এক দেউল নির্মাণ করে, নিজ আরাধ্যা দেবী শ্যামরূপার এক কনক মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়েশ্বর পালরাজ কিছুকাল দোম ঘোষকে বন্দী করে রেখেছিলেন। ইছাই পিতার এই লাঞ্ছনার কথা ভুলতে পারেননি।

পালরাজের অনুচর ঢেকুরে কর আদায় করতে এলে, ইছাইয়ের হাতে লাঞ্ছিত হয়। ইছাইকে দমন করবার জন্য গৌড়েশ্বর নিজ শ্যালক মহামদকে পাঠিয়ে দেন। যুদ্ধে ঢেকুরে অবস্থিত কর্ণসেন নামে এক সামন্তরাজের ছয় পুত্র নিহত হয়। কর্ণসেনের রানী শোকে প্রাণত্যাগ করেন। কর্ণসেন গৌড়ের রাজার শরণাপন্ন হন। মহামদের অনুপস্থিতিতে গৌড়েশ্বর, মহামদের অপর এক ভগিনী রঞ্জাবতীর সঙ্গে কর্ণদেনের বিবাহ দেন। মহামদ এতে চটে যান। রঞ্জাবতীর কোনদিন সন্তান হয়নি। তার পর ধর্মঠাকুরকে তপস্থায় তুষ্ট করে, তিনি লাউসেন নামে এক শক্তিশালী পুত্র পান।

মহামদ গোড়া থেকেই ভাগিনেয় লাউদ্দেনকে মারবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিফল হয়ে অবশেষে তাকে কামরূপ রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য পাঠিয়ে দেন। মহামদ ভাবেন যে লাউসেন নিশ্চয়ই যুদ্ধে নিহত হবে। কিন্তু ধর্মঠাকুরের বরে লাউসেন কালু ডোম নামে এক শক্তিশালী অনুচর পায়। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে, ফেরবার পথে লাউসেন মঙ্গলকোটে বর্ধমানের রাজকন্যা অমলা ও বিমলাকে বিবাহ করে। তার আগে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে কামরূপ রাজার মেয়ে কলিঙ্গাকে বিবাহ করেছিল। তিন রানী নিয়ে লাউসেন ফিরে আদে। মহামদ তখন তাকে ঢেকুরে ইছাই ঘোষের সঙ্গে লড়াই করতে পাঠিয়ে দেয়। অনেক যুদ্ধ ও হল চাতুরীর পর লাউসেন ইছাইয়ের শিরশ্ছেদন করে।

এবার ময়নামতীর কাহিনী গুহন। ময়নামতী ছিল অতি ধার্মিক রাজা মানিকচন্দ্রের রানী। তাঁর দেওয়ানের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ প্রজারা রাজার মৃত্যু কামনা করে ধর্মনিরঞ্জনের পুজা দেয়। রাজার মৃত্যু ঘটে। যমদূতেরা তাঁর প্রাণ নিয়ে যমপুরী রওনা হলে, রানী ময়নামতী তার পশ্চাদ্ধাবন করে যত্নপুরীতে প্রবেশ করে সকলকে ত্রস্ত করে তোলে। অবশেষে শুরু গোরখনাথের মধ্যস্থতায় স্থির হয় মৃত রাজার প্রাণ আর ফিরিয়ে দেওয়া হবে না; তবে ময়নামতী একটি পুত্র লাভ করবেন। মানিকচন্দ্রকে দাহ করবার সময়, রানী ময়নামতী সহমরণে যান। কিন্তু আগুনে তাঁর দেহ দগ্ধ হল না।

রানী গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচাঁদ নামে এক পুত্র লাভ করেন। গোপীচাঁদ বড় হয়ে হরিশ্চন্দ্র রাজার মেয়ে অর্জুনাকে বিয়ে করে তার অনুজা পছনাক্ষে যৌতুকস্বরূপ পান। ময়নামতী দিব্যজ্ঞানে জানলেন যে হাড়ি-সিদ্ধার শিষ্য হয়ে, সন্ন্যাস গ্রহণ না করলে ১৮ বছর বয়সে গোপীচাদের মৃত্যু হবে। রাজা সন্ন্যাস গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন ; যুবতী রানীরাও বাধা দিল। পরে গোপীচাঁদ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ১২ বছর পরে দেশে ফিরে এসে তিনি সুখে জীবনযাপন করতে থাকেন।

মনসামঙ্গলের কাহিনী হচ্ছে চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরের কনিষ্ঠ পুত্র লখীন্দর ও তার পত্নী বেহুলাকে নিয়ে রচিত। মনসার কোপে বিয়ের রাত্রে সর্পদংশনে লখীন্দরের মৃত্যু হয়। পতিপ্রাণা বেহুলা একটি কলার ভেলায় করে লখীন্দরের মৃতদেহ নিয়ে দেবপুরের উদ্দেশ্যে অপরিচিত পথে যাত্রা করেন। অনেক বাধাবিঘ্ন বিপদ-আপদ অতিক্রম করে দেবপুরের ধোবানী নেতার সহায়তায় গন্তব্যস্থানে পৌঁছান।

সেখানে নৃত্যগীতে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে, তিনি লখীন্দরের পুনর্জীবন লাভ করেন। কৌশলে বেহুলা মনসার কোপে নিহত চাঁদ সদাগরের আরও ছয় মৃত পুত্রের জীবন ও নৌকাডুবিতে সমুদ্রতলশায়ী ধনরত্ন সব উদ্ধার করে চাঁদ সদাগরের কাছে ফিরে আসেন। শিবভক্ত চাঁদ মনসার পূজা করতে অস্বীকার করেন, কিন্তু অনেক অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটি করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বেহুলা চাঁদকে দিয়ে মনসার পূজা করান।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যসমূহে দুটি আখ্যান বিবৃত হয়েছে। একটি বণিক ধনপতি সম্পর্কে ও অপরটি কালকেতু সম্পর্কে। এই দুটি কাহিনীই আমরা আগের এক অধ্যায়ে দিয়েছি। সুতরাং এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করব না।

বোষিগণ কর্তৃক পূজিতা এই সকল নারীদেবতা-সম্পর্কিত কাহিনী বাঙলার অলিখিত জাতীয় সাহিত্যমানসে সজীব ছিল। এগুলিকেই অবলম্বন করে মধ্য যুগের বাঙলায় এক বিরাট গণ-সাহিত্য গড়ে উঠেছিল।

মধ্যযুগে অনেক মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সকল মুসলমান কবিরা হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম্য, রাধাকৃষ্ণের পদাবলী, নরনারীর প্রণয়কাহিনী ও নীতিমূলক অনেক বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের কাব্যসমূহ রচনা করেছিলেন। তাদের মধ্যে আরাকান রাজসভার কবি দৌলত কাজীই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে ‘সতী ময়নামতী’ বা ‘লোরচন্দ্রাণী’।

এই কাব্যে তিনি দেব দেবীর মাহাত্ম্যের পরিবর্তে বাস্তব জগতের নরনারীর প্রণয়কথা ও সুখদুঃখের চিত্র অঙ্কিত করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভগ্ন করেছিলেন। মিয়া সাধন নামক হিন্দী কবি রচিত ‘ময়নাকো সত’ নামক কাব্যের কাহিনী অনুসরণে রচিত হলেও দৌলত কাজী তাঁর কাব্যে অসাধারণ কবিত্বপ্রতিভা ও মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

আরাকান রাজ্যের অপর কবি সৈয়দ আলাওল’ও একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যসমূহের মধ্যে ‘দয়ফুলমূলক বদিউ জমাল’, ‘হপ্তপয়কর’, ‘তোহফা’ ইসলামধর্মী গ্রন্থ। কিন্তু যে কাব্যটির জন্য তিনি বাঙালী হিন্দুসমাজে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন, সেটি হচ্ছে ‘পদ্মাবতী’। এটি ইতিহাস আশ্রিত এক রোমান্টিক প্রেমকাহিনী। মধ্যযুগের সাহিত্যে কাব্যটি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘সতী ময়নামতী’ ও ‘পদ্মাবতী’—এই দুই কাব্যে মানুষের প্রেম, ভালবাসা ও আত্মত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়েছে অপূর্ব ছন্দ ও ভাষায়। দৌলত কাজী কোন কোন জায়গায় ব্রজবুলিরও সার্থক ব্যবহার করেছেন।

যথা ‘শাঙন গগন সঘন ঝরে নীর।।

তবু মোর না জুরয়ে এ তাপ শরীর।।

মদন অধিক জিনি বিজুরীর রেহা।

থরকএ যামিনী কম্পায় মোর দেহা।

দৌলত কাজী ও আলাওল দুজনেই ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর লোক। আগেই বলেছি যে পদাবলী সাহিত্য রচনাতেও মুসলমান কবিরা অসাধারণ অনুভুতি ও নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। ন্যূনপক্ষে ১২১ জন মুসলমান পদকর্তার নাম আমরা জানি।

 

আরও পড়ুন:

বাঙলার স্মার্ত পণ্ডিতগণ

বাঙলার স্মার্ত পণ্ডিতগণ নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- মধ্যযুগের কয়েকজন প্রখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিতের কথা এখানে বলব। তাঁদের মধ্যে ভবদেব ভট্ট ছিলেন দশম-একাদশ শতাব্দীর লোক। হলায়ুধ ও জীমূত বাহন সেন রাজাদের আমলের লোক। বৃহস্পতি মিশ্র ও রঘুনন্দন ভট্টাচার্য মুসলমানদের শাসনকালে প্রাদুর্ভূত হন। হলায়ুধ প্রাদুভুত হয়েছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। তিনি ছিলেন তৃতীয় সেনরাজা লক্ষ্মণসেনের মহাধর্মাধ্যক্ষ। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও ব্রাহ্মণসমাজের জন্য তিনি অনেকগুলি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করে ছিলেন যথা ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’, ‘মীমাংসাসবন্ধ’, বৈষ্ণবসবঙ্গ’, ‘শৈবসবঙ্গ’, ও ‘পণ্ডিতসবম্ব’।

সে যুগের স্মৃতি, ব্যবহার ও ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাদের মধ্যে তিনিই অগ্রগণ্য। তাঁর আর দুই ভাই ঈশান ও পশুপতিও ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ঈশান রচনা করেছিলেন ‘আহ্নিকপদ্ধতি সম্বন্ধে, ও পশুপতি ‘শ্রাদ্ধপদ্ধতি সম্বন্ধে। এখানে উল্লেখনীয় যে হলায়ুধ নামে আর একজন পত্তিতের খ্রষ্টীয় দশম শতাব্দীতে আবিভাব ঘটেছিল। তিনি ‘অভিধান রত্ন মালা’, ‘কাব্যৱহস্ত’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। শেষের খানা ব্যাকরণের বই ।

জীমূতবাহন ঐষ্টায় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর লোক। তিনি তিনখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থ তিনখানির নাম ‘কালবিবেক’, ‘ব্যবহারমাতৃকা ও ‘দায়ভাগ। শেষোক্ত বিধানগ্রন্থটির জন্যই তিনি বিখ্যাত। ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে তিনি হিন্দুর পূজানুষ্ঠান, শুভকর্ম, আচার ও ধর্মোৎসব প্রভৃতির কাল নির্দেশ করেছিলেন। তার এই গ্রন্থে ‘হোলাকা’ বা হোলি উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘ব্যবহারমাতৃকা’ গ্রন্থে হিন্দু বিচারপদ্ধতির আলোচনা আছে।

[ বাঙলার স্মার্ত পণ্ডিতগণ]

তৃতীয় গ্রন্থটি উত্তরাধিকার সম্পকে উত্তরভারতে প্রচলিত ‘মিতাক্ষরা’ বিধানের বিপক্ষে লেখা। এতে উত্তরাধিকার, সম্পত্তিবিভাগ, স্ত্রীধন প্রভৃতি বিষয় আলোচিত। বইখা প্রাচীন শাস্ত্রকারদের যুক্তি ও মতামতের ভিত্তিতে লেখা ও বিশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ। জীমুতবাহন পিওদানের সহিত উত্তরাধিকার যুক্ত করেন ও সম্পাদিত কম নিয়মমত না হলেও তাহা সিদ্ধ বলে গ্রহণ করার রীতির বিধান দেন। ‘দায়ভাগ’ বাঙলাদেশে উত্তরাধিকার বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্নের সমাধানের নিয়ামক। বাঙলায় ‘দায়ভাগ’-এর বিধানই প্রচলিত।

ভবদেব ভট্ট, হলায়ুধ ও জীমূতবাহনের কিছু আগেকার লোক। তিনি খ্রীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীতে প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। রাঢ় দেশের সিঙ্গল গ্রামবাসী এক ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা গোবর্ধন পণ্ডিতলোক ছিলেন। পিতামহ আদিদেব বর্মণবংশীয় রাজার মন্ত্রী বলেন। ভবদেব নিজেও বর্মণবংশীয় রাজা হরিবর্মদেব ও তাঁর এক অজ্ঞাতনামা পুত্রের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরই মন্ত্রণাপ্রভাবে বর্মণর। বহুদিন রাজত্ব করতে সক্ষম হন। তিনি উত্তরবাড়ের শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন।

‘ভোটরাজা’ নামে তিনি পরিচিত। প্রজাগণের মঙ্গগার্থে তিনি রাঢ় দেশের বহু জায়গায় জলাভাব দূরীকরণের জন্য পুষ্করিণী খনন করে দিয়েছিলেন। বিক্রমপুরে তিনি নারায়ণের এক মন্দির নির্মাণ ও তৎসংলগ্ন এক জলাশয় খনন করে দিয়েছিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র, সিদ্ধান্ত, তন্ত্র, গণিতশাস্ত্র ও আয়ুর্বেদশাস্ত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। বৌদ্ধদের মতামত খণ্ডন করে তিনি বহু বৌদ্ধকে হিন্দু বর্ণাশ্রম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। হিন্দুর আচার, ব্যবহার ও প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে বহু প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যথা ‘দশকর্ম পদ্ধতি’, ‘প্রায়শ্চিত্ত-প্রকরণ’, ‘ব্যবহার-তিক ও মীমাংসাদর্শনের ওপর এক টীকা।

পরবর্তীকালে রঘুনন্দন, মিত্র মিশ্র প্রভৃতি পণ্ডিতেরা তাঁর মতামত উদ্ধৃত করেছেন। সমাজের তিনি বহু সংস্কার করে গিয়েছেন। তিনি বাঙলাদেশের ব্রাহ্মণদের মাছ খাবার বিধান দেন। পরে জীমূতবাহনও সেই বিধান দিয়েছিলেন এবং সেই সময় থেকেই বাঙালী ব্রাহ্মণরা মাছ খাওয়া শুরু করেন। তাঁর অব্যবহিত পরেই বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা বাঙলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেন।

বৃহস্পতি মিশ্র পঞ্চদশ শতাব্দীর লোক। পিতা গোবিন্দ ছিলেন ‘মাহিস্তা’ শ্রেণীভুক্ত রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ। তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন ও বহু টীকা গ্রন্থ ও স্মৃতিগ্রন্থ লিখে গিয়েছেন। যে সকল টীকাগ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন তার অন্যতম হচ্ছে ‘সুকেশ’ নামে কুমারসম্ভবের টীকা, ‘রঘুবংশ বিবেক’ নামে রঘুবংশের টীকা, ‘নির্ণয় বৃহস্পতি’ নামে শিশুপালবধের টীকা, ‘পদচন্দ্রিকা’ নামে অমরকোষের টাকা ও ‘বোধবতী’ নামে মেঘদূতের টীকা। তাঁর রচিত স্তুতিগ্রন্থের মধ্যে ‘রায়মুকুটপদ্ধতি’ ও ‘স্মৃতিরত্নহার’ বিশেষ প্রসিদ্ধ। রঘুনন্দন এ দুখানা স্মৃতিগ্রন্থের প্রামাণ্য উদ্ধৃত করে গিয়েছেন।

গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন ও বরাবক শাহের অধীনে উচ্চরাজকর্মে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাঁকে ‘রায়মুকুট’ উপাধি দিয়েছিলেন। তাঁর গুরু শ্রীধর মিশ্রের কাছ থেকে তিনি ‘মিশ্র’ উপাধি পেয়েছিলেন।

রঘুনন্দনই মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় স্মার্ত পণ্ডিত। তিনি রাঢ়দেশের লোক ছিলেন। নবদ্বীপের হরিহর ভট্টাচার্য তাঁর পিতা। নবদ্বীপের তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত শ্ৰনাথ তর্কচূড়ামণির নিকট স্মৃতি ও মীমাংসা অধ্যয়ন করেন। এই উভয় শাস্ত্রেই রঘুনন্দনের ছিল অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন এবং চৈতন্যদেবের ন্যায় তিনিও হিন্দু সমাজকে সুলতান হুসেন শাহের সময়কার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। তিনিই বিধান দেন যে মুসলমানগণ কর্তৃক অপহৃতা হিন্দুনারীকে সামান্য প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা পুনরায় হিন্দুসমাজে গ্রহণ করা চলবে। তিনি ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব স্মৃতিগ্ৰন্থ’, ‘প্রয়োগগ্রন্থ’, দায়তত্ত্ব এবং জীমৃতবাহনের ‘দায়ভাগ’-এর ওপর টীকা লেখেন। তিনি আরও বিধান দেন যে বাঙালী ব্রাহ্মণরা মসুর ডাল খেতে পারেন। হিন্দু সামাজিক ও ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর বিধানসমূহ এখনও হিন্দুসমাজে গ্রাহ্য।

আরও পড়ুন:

বাঙালীর লোকায়ত ধর্ম ও যুক্তসাধনা

লোকায়ত ধর্ম ও যুক্তসাধনা নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- বাঙলার গৌরবময় প্রাচীন সংস্কৃতির অবসান ঘটেছিল মুসলমানগণ কর্তৃক বাঙলা বিজিত (১২০৪) হবার পর। মনে হয়, ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তুর্কি আক্রমণের ফলে বাঙলাদেশে সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল অনেক লোকায়ত দেবদেবীর। পূর্বে এই সকল দেবদেবী সমাজের নিম্নকোটির লোকগণ কর্তৃক পূজিত হতেন। মুসলমানরাজগণের আমলে ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজের মধ্যে শৈথিল্য ঘটায় নিম্নশ্রেণী কর্তৃক পুজিত বহু দেবদেবী প্রাধান্য লাভ করতে থাকেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শীতলা, বাগুলী, মনসা, চণ্ডী ইত্যাদি।

পটচিত্রে মনসামঙ্গল [ Manasa Mangal ]
হিন্দু দেবতামণ্ডলে স্থান দেবার জন্য তাঁদের অধিকাংশকে শিবজায়া উমার সহিত অভিন্ন করা হয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, এ যুগের হিন্দুসমাজে গৃহীত এই সকল দেবদেবী বাঙলাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই পূজিত হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণী কর্তৃক পূজিত এই সকল দেবদেবী ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে স্বীক্বাত্তলাভ করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ ছিল এই যে, আর্যসমাজের প্রধান দেবতাসমূহ ছিল পুরুষদেবতা, আর আর্যেতর সমাজের প্রধান দেবতাসমূহ ছিলেন নারীদেবতা।

[ লোকায়ত ধর্ম ও যুক্তসাধনা]

আর্যদেবতাসমূহ যতই প্রাধান্যলাভ করতে লাগলেন, আর্যেতর এই সকল নারীদেবতাসমূহ ততই পর্বতকন্দরে, ঝোপজঙ্গলে বা গাছতলায় আশ্রয়লাভ করলেন। কিন্তু মধ্যযুগে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভিত্তি টলমল করে উঠল, তখন এই সকল নারীদেবতা তাঁদের পর্বতকন্দর, ঝোপজঙ্গল ও গাছতলার আশ্রয় পরিহার করে ক্রমশ হিন্দুর আনুষ্ঠানিক ধর্মসংস্কারের মধ্যে প্রবেশলাভ করতে লাগলেন। এই অনুপ্রবেশকে সহজ করবার জন্য তাদের পৌরাণিক মাতৃদেবীর সঙ্গে অভিন্ন প্রতিপন্ন করা হল।

মনসা দেবী

আর্যেতর এই সমস্ত দেবদেবীকে নিয়ে এক নতুন সাহিত্য গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগের এই সাহিত্যকে ‘মঙ্গল সাহিত্য’ বলা হয়। মঙ্গল সাহিত৷ সাধারণত চার শ্রেণীতে বিভক্ত—মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন। মনসামঙ্গলের আখ্যান-বিষয় ছিল মনসা বা সর্পদেবীর পূজামাহাত্ম্য প্রচার করা। ইনি যোষিগণ কর্তৃক নানা নামে পূজিতা হতেন। মধ্যযুগে তাঁর দুই নাম প্রাধান্য লাভ করেছিল, যথা- মনসা ও পদ্মা ঘোষিগণ কর্তৃক পূজিতা এই দেবীকে পুরুষসমাজের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

মনসামঙ্গলসমূহের কাহিনীতে সেটাই প্রকাশিত হয়েছে। মনসার কোপে পড়ে চাঁদ সদাগর তার সাতপুত্র ও সাতডিঙ্গিভরা পণ্যসম্ভার হারালেন, কিন্তু তথাপি তিনি মনসার পূজা থেকে বিরত রইলেন। যখন পুত্রবধূ বেহুলা মনসার কৃপালাভ করে নিজ স্বামী ও ছয় ভাশুরের পুনর্জীবন দান করাল ও নিমজ্জিত সাতখানি ডিঙ্গি পণাসহার-সমেত ফেরত আনল, তখনও বেহুলা তার শ্বশুরকে মাত্র একবারের জন্য ও মনসাদেবীর পূজায় সম্মত করাতে পারল না। ঘৃণার সঙ্গে চাঁদ সদাগর পুত্রবধূকে উত্তর দিলেন, ‘আমার সাতপুত্র ও সাতডিঙ্গি ধনদৌলত রসাতলে যাক্, তবুও আমি মনসার পূজা করব না। যেহেতু চাঁদ শিবোপাসক ছিলেন, সেই হেতু শিবপত্নী চণ্ডীকে তখন হস্তক্ষেপ করতে হল।

স্বপ্নে আবির্ভূতা হয়ে তিনি চাঁদকে বললেন, চাঁদ, তুমি পদ্মাবতীকে পূজার্ঘ্য দাও, কেননা পদ্মাবতী আমি ছাড়া আর কেউ নয়। এই স্বপ্নাদেশের পরেই চাদ সম্মত হয়েছিলেন পদ্মাবতীকে পূজার্ঘ্য দিতে। এইরূপে মনসার পূজা নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজে প্রতিষ্ঠিত হল। হিন্দুসমাজ তখন মনসাকে পুরাণেও স্থান দিলেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কাহিনী অনুযায়ী মনসা সর্পগণের দেবী। ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপমুনি সর্পমন্ত্রের সৃষ্টি করেন ও তপোবলে মন দ্বারা তাঁকে সৃষ্টি করে তাকে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী করেন। এজন্যই তাঁর নাম মনসা। কুমারী অবস্থায় মনসা মহাদেবের কাছে যান ও তাঁর কাছ থেকে স্তব, পূজা ও মন্ত্র ইত্যাদি শিক্ষা করে সিদ্ধা হন ও সর্পদংশন মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে পরিগণিত হন। সেই থেকেই দেবতা, মহু, মুনি, নাগ, মানুষ সকলেই মনসাদেবীর পূজা করতে থাকেন।

শীতলা দেবী

‘মঙ্গল’ সাহিত্যসমূহের প্রধান। দেবী ছিলেন মঙ্গলা বা চণ্ডী। তিনি সর্ববিষয়েই সকলের ইষ্টসাধন করেন। মনসার ন্যায় চণ্ডীও পূর্বে নারীগণ কর্তৃক পূজিতা হতেন। দেবীভাগবতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, মঙ্গলা নারীগণ কর্তৃ ক পূঞ্জিতা দেবতা—‘যে।র্ষিতানাম্ ইষ্টদেবতাম্’। বোধ হয় এই কারণেই ‘মঙ্গলা’-কে অষ্টযোগিনীর অন্যতম। বলা হয়েছে। ( ‘মঙ্গল। পিঙ্গলা ধ্যা ভ্রামরী ভর্তু’কা তথ্য উল্কা সিদ্ধি সঙ্কটা চ যোগিনী অষ্ট প্রকীর্তিতা’)। এখনও পর্যন্ত মেয়েরা মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত পালন করে থাকে। অহুরূপভাবে অষ্টযোগিনীর অন্যতমা সঙ্কটার ব্রতও মেয়েরা পালন করে।

সর্ব বিষয়ে যিনি সকলের ইষ্টসাধন করেন তিনিই ‘সর্বমঙ্গলা’। ওড়িশার শাক্ত কবি সারলাদাস তাঁর ‘চণ্ডীপুরাণ’ ও ‘বিলরামায়ণ’-এ সর্বমঙ্গলাকে কালীর সঙ্গে অভিন্নরূপে গণ্য করেছেন। সেখানে বিবৃত হয়েছে যে দুর্গ। যখন মহিষাহর নিধনে অসমর্থ হন, তখন তাঁর সহচরী মনোরমা তাঁকে কালীর বিবস্ত্রা রূপ ধারণ করতে বলেন। সহচরীর এই উপদেশ অনুযায়ী দুর্গ। যখন কালীরূপ ধারণ করেন, তখনই তিনি মহিষাসুরকে বিনাশ করতে সক্ষম হন। মনুষ্যসমাজের মঙ্গলসাধক মনোরমার এই উপদেশ কার্যকরী হওয়ায় দুর্গা মনোরমাকে বলেন, তোমার মঙ্গল হউক। আজ থেকে তুমি ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে অভিহিতা হবে।

শীতলা দেবী

চণ্ডিকা পূজার প্রচার সম্বন্ধে বাংলা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যসমূহে দুটি আখ্যান বিবৃত হয়েছে। প্রথমটি ব্যাধ কালকেতু সম্বন্ধে ও দ্বিতীয়টি বণিক ধনপতি সম্পর্কে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই যে সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হবার অনেক আগে থেকেই ঘোষিগণ কর্তৃক পুজিতা এই সকল নারীদেবতা-সম্পর্কিত কাহিনী বাঙলার অলিখিত জাতীয় সাহিত্যমানসে সজীব ছিল। সেদিক থেকে মনে হয় যে ব্যাধ কালকেতু-সম্পর্কিত কাহিনীটি বণিক ধনপতির কাহিনী অপেক্ষা প্রাচীনতর। এ সকল কাহিনী যে অতি প্রাচীন কালের অলিখিত সাহিত্যের কাহিনী, তা এই উভয় কাহিনীর সারল্যপূর্ণ বর্ণনা থেকেই বুঝতে পারা যায়।

বণিক ধনপতির দুই বনিতা ছিল-গহনা ও খুল্লনা (নাম দুটি অস্ট্রিক সমাজের বলে মনে হয়)। সপত্নী লহনা খুল্লনাকে ছাগল চরাতে পাঠিয়েছিলেন। একটি ছাগল দলচ্যুত হয়ে হারিয়ে যায়। খুলনা দুঃখে ও ভয়ে অভিভূত হন। দলচ্যুত ছাগলটিকে খুঁজতে খুঁজতে তিনি এক জায়গায় এসে দেখেন যে পাঁচটি মেয়ে উলুধ্বনি-নহ এক দেবীর পূজায় রত রয়েছে। তারা খুল্লনাকে বলে যে, সে যদি ওই দেবীর পূজা করে, তাহলে সে তার ছাগল খুজে পাবে।

তাদের কথামত খুলনা ওই দেবীর পূজায় প্রবৃত্ত হন এবং অচিরে তাঁর ছাগল খুঁজে পান। গৃহে প্রত্যাগমন করে খুল্লনা ওই দেবীর পূজা করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু শিবো সাসক ধনপতি দেবীপুজা পছন্দ করেন না। ধনপতি খুল্লনার পূজার ঘট ভেঙে দেন। এর কিছুকাল পরে ধনপতি বাণিজ্য উপলক্ষে সিংহল দ্বীপে যান। সিংহল দ্বীপের রাজা তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এরপর ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত যখন চণ্ডিকার পূজা করেন তখনই ধনপতি কারামুক্ত হন ও দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর থেকে ধনপতিও চণ্ডিকার পূজা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাঙলার বণিকসমাজে চণ্ডিকা পূজার প্রবর্তন হয়।

শীতলা দেবী

বণিক ধনপতির কাহিনী অপেক্ষা ব্যাধ কালকেতুর কাহিনী প্রাচীনতর সমাজের ইঙ্গিত বহন করে। কালকেতু সমাজের নিম্নকোটির লোক ছিল। তাঁর, ধনুক ও জাল (পাশ) নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে পশু শিকার করে সে তার আহার্য ও জীবিকা সংগ্রহ করত। শিকার করে আনা পশুর মাংস ও চর্ম তার স্ত্রী হাটে নিয়ে গিয়ে বেচে আসত। একদিন কালকেতুর জালে এক স্বর্ণগোধিকা ধরা পড়ে। কালকেতু সেটিকে ঘরে নিয়ে আসে। সেই গোধিকা দেবীমূর্তি ধারণ করে। কালকেতু তাঁকে পূজা করতে শুরু করে। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই কালকেতু বিত্তশালী হয়ে ওঠে। তখন সে জঙ্গল পরিষ্কার করে এক নগর স্থাপন করে।

উচ্চকোটির লোকেরা প্রথমে সেই নগরে গিয়ে বাস করতে অসম্মত হয়। কিন্তু পরে তার ধন-ঐশ্বর্য ও প্রতাপ নিষ্ঠাবান সমাজকে আকৃষ্ট করে। তারা সেখানে গিয়ে কালকেতু কর্তৃক পূজিতা দেবীর পূজা করতে শুরু করে। কালকেতু কতৃ ক পূজিতা দেবী, চণ্ডিকা ব্যতীত আর কেউই নন। এই আখ্যানে গোধিকার উল্লেখ দেখে মনে হয় যে, কালকেতু কর্তৃক পূজিতা দেবী প্রথমে আর্যেতর জাতি কর্তৃক পূজিতা কোন দেবী ছিলেন, যিনি পরে নিষ্ঠাবান সমাজে চণ্ডিকারূপে গৌরবান্বিত স্থান অধিকার করেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে গঠিত কয়েকটি দেবীমূর্তি বাঙলার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গিয়েছে; তাদের পাদমূলে গোধিকামূর্তি দৃষ্ট হয়।

সংস্কৃত ভাষায় রচিত মূর্তি নির্মাণ-সম্পর্কিত কতকগুলি গ্রন্থে আমরা গোধিকা-বাহিনী দেবীমূর্তির উল্লেখ পাই—‘গোঁধাসনে ভবেদ গৌরী লীলয়া হংসবদনা’ ও ‘অক্ষসূত্রং তথা পদ্মম্ অভয়চ বরং তথা। গোধাসনাশ্রিতা মূর্তি গৃহে পুজ্যা স্ত্ৰীয়া সদা। লক্ষণীয় যে এখানেও তাঁকে যোধিগণ কর্তৃক পূজিতা দেবী বলা হয়েছে। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে মঙ্গলকাব্যের কতকগুলি কাহিনীতে দেবীকে ‘কমলে কামিনী’ বা ‘পদ্মাসনা দেবী’ বলা হয়েছে। এর দ্বারা লক্ষ্মীর সঙ্গে চণ্ডিকার সম্পর্ক সূচিত হয়।

শীতলা দেবী

দুই আর্যেতর সমাজে যে কেবল নারীদেবতাই ছিলেন, তা নয়। পুরুষদেবতা ও ছিলেন। তবে নারীদেবতার তুলনায় তাঁরা সংখ্যায় অল্প। শিব ও ধর্মঠাকুর তাদের অন্যতম। তাদের আশ্রয় করেও মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল। এগুলিকে ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন আখ্যা দেওয়া হয়। ধর্মমঙ্গলের বিষয়বস্তু হচ্ছে ধর্মরাজার পূজা। তিনি আসলে কে? শিব, না বুদ্ধ ? না অনার্যসমাজের অপর কোন দেবতা? সে সম্বন্ধে কোন মতৈক্য নেই। তবে তিনি যে আর্যের সমাজের দেবতা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, ধর্মঠাকুরের পূজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে কেবল ডোমজাতীয় লোকরাই এঁর পুরোহিতের কাজ করে।

হিন্দু সমাজে ধর্মঠাকুরের পূজা-প্রবর্তন প্রসঙ্গে রাজা কর্ণসেনের পত্নী রঞ্জাবতী ও তাঁর পুত্র ময়নাগড়ের লাউসেনের নাম জড়িত। পালসম্রাট মহীপাল (৯৭৭-১০২৭ খ্রীস্টাব্দ) তখন গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তা থেকে প্রমাণ হয় যে, খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীতে ধর্মঠাকুরের পূজা হিন্দুসমাজে গৃহীত হয়েছিল। হিন্দু সমাজে গৃহীত হবার পর ক্রমশ ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও ধর্মঠাকুরের পূজায় অংশ গ্রহণ করতে থাকেন। তা ধর্মের গাজন-উৎসবের অভষ্ঠান ও আচার-পদ্ধতি থেকেও বুঝতে পারা যায়। ধর্মঠাকুর হচ্ছেন নিরাকার, তবে বীরভূমের কয়েক স্থানে তাকে খ্যামরায় প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয়। বলা বাহুল্য এ সকল নাম পরবর্তী কালের নিষ্ঠাবান সমাজ কর্তৃক আরোপিত হয়েছিল ।

শীতলা দেবী

শিবের সঙ্গে ধর্মঠাকুরের নৈকট্য হুচিত হয় শিবের গাজন-উৎসবের মাধ্যমে। ধর্মঠাকুরের গাজন, শিবের গাজন, আছ্যের গম্ভীরা প্রভৃতি উৎসবের আচার অনুষ্ঠান প্রায়ই এক। বস্তুত মধ্যযুগের হিন্দুসমাজে শিবই ছিলেন প্রধান উপাস্থ্য দেবতা। বাঙলায় শিবমন্দিরসমূহের প্রাচুর্য থেকেও তাই প্রমাণ হয়। শিবকে অবলম্বন করে যে কাব্য রচিত হয়েছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল শিবায়ন। এই সকল কাব্যে শিবঠাকুরকে আমরা সাধারণ বাঙালী গৃহস্থরূপে দেখি।

গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মতো তিনিও মাঠে চাষ করেন এবং গৌরীর সঙ্গে গৃহস্থজীবন যাপন করেন। বস্তুত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে গৌরীর বিবাহের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা সাধারণ বাঙালী মেয়েরই বিবাহ। পতি হিসাবে শিবের মতো পতিই বাঙালী মেয়ের কাঙ্ক্ষিত আদর্শ হয়ে উঠেছিল। এর প্রকাশ পাই কুমারীগণ কর্তৃক বৈশাখ মাসে পালিত শিবপুজায়।

মধ্যযুগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে এসে এবং তার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে হিন্দু সমাজে আরও অনেক দেবদেবী আবির্ভূত হন। তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন সত্যপীর, গাজীসাহেব, বনবিবি প্রভৃতি। এর মধ্যে সভাপীরের পূজা বিশেষ ব্যাপকতা লাভ করে। সত্যপীরের পূজা কথায় বলা হয়েছে যে, সত্যপীর ও নারায়ণ অভিন্ন। সেজন্য সত্যপীর বর্তমানে সত্যনারায়ণ নামে পুজিত হন।

বলা বাহুল্য, মধ্যযুগে এই সকল যুক্তসাধনামূলক গণতান্ত্রিক দেবদেবীর পূজার উদ্ভবের ফলে, হিন্দুসমাজ মুসলমান কর্তৃক ধর্মান্তর-করণের ফলে যে ভাঙনের সম্মুখীন হয়েছিল, তা থেকে রেহাই পায়।

চণ্ডীর ব্রহ্মদেশীয় রূপ সন্ডি দেবী

ধর্মীয় সাধনার ক্ষেত্রে মধ্যযুগে আর এক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। এ সম্প্রদায় হচ্ছে বাউল ( সংস্কৃত ‘বাতুল’ ; তুলনীয় হিন্দী ‘বাউরা’ ) সম্প্রদায়। এরা সন্ত ও ফকিররূপে বিচরণ করত। মনে হয়, বৈষ্ণব সহজিয়াদের সঙ্গে শফীদের যোগাযোগের ফলে এদের উদ্ভব ঘটেছিল। বাউলদের সাধনার লক্ষ্য হচ্ছে ‘মনের মানুষ’ লাভ করা। ‘মনের মানুষ’ অনন্ত পরম সত্য, আবার ব্যক্তিগত প্রেমের আধার। বাউলদের ‘মনের মানুষ’ আছে দেহসীমার মধ্যে। এক কথায় তারা সীমার মধ্যে অসীমকে অনুভব করতে চায়।

তারা ‘মনের মানুষ’-এর সঙ্গে সমন্বিত হতে চায় প্রেমের দ্বারা। সেজন্যই ‘প্রেম-ব্যাকুলতায় বাউলেরা উন্মত্ত’। বাউল সাধনার একটা ঘনিষ্ঠ অঙ্গ হচ্ছে বাউল গান । বাউলেরা এই গানের মাধ্যমেই নিজেদের সাধন-ভজনের গূঢ়তত্ত্ব নানারূপ রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন। অনেকে বলেন বাউলদের আধ্যাত্মিক অনুভূতি রবীন্দ্র-জীবন-দর্শনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। জয়দেবের জন্মতিথি উপলক্ষে কেন্দুলিতে যে মেলা হয়, সেখানে সকল স্থানের বাউলরা একত্রিত হয়।

চণ্ডী দেবী

মধ্যযুগের ধর্মীয় যুক্তসাধনার ক্ষেত্রে সুফীবাদের অবদানও বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। সুফীবাদ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে এদেশে এসেছিল। সূফীগণ ঈশ্বর সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান দিতেন ও ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগলাভের পথনির্দেশ করতেন। তাঁরা পবিত্র জীবনযাপন করতেন ও অনেক অলৌকিক শক্তির পরিচয় দিতেন। তা ছাড়া, তাঁরা বহু লোকহিতকর কার্যে নিজেদের নিযুক্ত রাখতেন। নানা জনহিতকর কাজের জন্য তাঁরা সাধারণ লোকের প্রণম্য হয়ে ছিলেন, এবং তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের দরগাগুলি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের কাছেই পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হত, যদিও অধিকাংশ দরগাগুলি হিন্দুদের পবিত্র স্থানগুলির ওপর নির্মিত হত। যেমন বগুড়া জেলার মহাস্থানে সৈয়দ সুলতান শাহী সওয়ারের দরগা এক শিব মন্দিরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে সত্যপীরের স্থান এক বৌদ্ধ মঠের ওপর নির্মিত।

হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনায় পীরপূজা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত। পীর বলতে শাহ, শেখ, মুরশিদ, ওস্তাদ, শূফী প্রমুখ সাধুসন্তদের বুঝাত। মুসলমান সেনাপতিগণও যুদ্ধে নিহত হলে গাজী-পীর রূপে পূজিত হতেন। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে বহু পীরের বলনা আছে। পীরের দরগাসমূহের প্রতি হিন্দু মুসলমান উভয়েই সমানভাবে তাদের শ্রদ্ধা ও অর্ঘ্য নিবেদন করত।

পীর পূজাকে অবলম্বন করে হিন্দুসমাজে অনেক দেবদেবীর উদ্ভব হয়েছিল। তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন সত্যপীর, গাজীসাহেব, বনবিবি ইত্যাদি। এর মধ্যে সত্যপীরের পূজা বিশেষ ব্যাপকতা লাভ করে। সত্যপীরের পূজা কথায় বলা হয়েছে যে সত্যপীর ও নারায়ণ অভিন্ন। সত্যপীরকে অবলম্বন করে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবিরাই অনেক পাঁচালী রচনা করেন। ফৈজুল্লার পাচালীতে আছে —’তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি নারায়ণ। শুন গাজী আপনি আসরে দেহ মন।’ সত্যপীর বর্তমানে সত্যনারায়ণ নামে পূজিত হন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর এক ফরাসী লেখকের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে হিন্দুরা যেমন নুসলমান পীর ও সাধুসন্তদের প্রতি ভক্তি দেখাতেন, মুসলমান পীর ও সন্তদের মধ্যে অনেকেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামী ছিলেন। এক কথায় মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই যুক্তসাধনার একটা ধারা প্রবাহিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন:

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, সামাজিক নৃবিজ্ঞান, জৈবিক নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস

Exit mobile version