আজকের আলোচনার বিষয় পাশ্চাত্য অণু পরিবার -তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ – যা পরিবার ও গৃহস্থালী এর অর্ন্তভুক্ত, পাশ্চাত্য সমাজে “পরিবার” বলতে বোঝায়: একজন স্বামী ও তার স্ত্রী, এবং তাদের সন্তান। সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন অনু পরিবার। ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিতে এই অনু পরিবারের আছে কিছু আকর বৈশিষ্ট্য, যথা: পরিবারের সদস্যরা একত্রে বসবাস করেন, পারিবারিক আয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই অনু পরিবারের প্রধান কার্য হচ্ছে: সন্তান লালন-পালন । নৃবিজ্ঞানী মার্ডক-এর নিােল্লেখিত সংজ্ঞায় বিষয়টা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ।
“পরিবার হচ্ছে একটি সামাজিক দল যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একত্রে বসবাস, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং পুনরুৎপাদন। পরিবারে থাকে দুই লিঙ্গের প্রাপ্ত-বয়স্ক ব্যক্তি, যাদের অন্তত দুইজনের মধ্যে থাকে সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য যৌনসম্পর্ক। পরিবারে আরো থাকে, এই প্রাপ্তবয়স্ক, একত্রে বসবাসকারী যৌন সম্পর্কে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের অন্তত একটি সন্তান। সন্তানটি তাদের নিজেদের হতে পারে অথবা হতে পারে পালিত।
পাশ্চাত্য অণু পরিবার
পরিবার-সম্পর্কিত এই ধারণা পাশ্চাত্য সমাজে খুবই শক্তিশালী। ধরে নেয়া হয় এধরনের পরিবার স্বাভাবিক; এ ধরনের পরিবার শুধুমাত্র কাম্য নয়, বাস্তবেও প্রতিফলিত। সমস্যা হ’ল, পাশ্চাত্য নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন পরিবারের এই মডেল বিশ্বব্যাপী এবং তাঁরা পরিবারের এই সংজ্ঞা ধরে অপাশ্চাত্য সমাজগুলোতে গবেষণা চালান।
কেবল মাত্র পরিবার নয়, অপাশ্চাত্য সমাজের অপরাপর সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির ব্যাপারে পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক এই দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞান আহরণের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে পারে, এ ধারণা ৭০-এর দশকে নৃবিজ্ঞানী মহলে জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়। জাতিকেন্দ্রীক (ethnocentric) এথনোগ্রাফি রচনা, তার সমস্যা, সেটাকে বর্জন করার প্রয়োজনীয়তা – এসব নিয়ে প্রচুর পরিমাণে লেখালেখি হয়, তর্ক-বিতর্ক হয়। বর্তমানে অবশ্য সমস্যাটাকে শুধুমাত্র জ্ঞাতি- কেন্দ্রিকতার সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। দেখা হচ্ছে পাশ্চাত্য আধিপত্যের জ্ঞানগত দিক হিসেবে (অন্যান্য দিকগুলো হ’ল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক)।
পরিবারের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসা যাক। পাশ্চাত্যের নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে পরিবারের এই মডেল পৃথিবীর সকল সমাজের জন্য কার্যকরী। খ্যাতিমান নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস্লো ম্যালিনোস্কি পাশ্চাত্য ধারণা নিয়ে এগোন, যদিও তিনি অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের নিয়ে লিখেছিলেন। ম্যালিনোস্কি লেখেন, পরিবার বিশ্বের সকল সমাজে উপস্থিত। কিন্তু ম্যালিনোস্কির পূর্বানুমান (অর্থাৎ, তিনি আগে থেকেই ধরে নিচ্ছেন, অনুমান করছেন) খেয়াল করবেন; সেটি হচ্ছে যে, পরিবার মাত্রই পাশ্চাত্য পরিবার: স্বামী, স্ত্রী, এবং তাদের সন্তান।

পরিবার কেন বিশ্বজনীন? এক্ষেত্রে ম্যালিনোস্কির যুক্তি ছিল, সন্তান লালন-পালনের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা যেহেতু বিশ্বজনীন, এবং যেহেতু সে চাহিদা মেটাতে পারে শুধুমাত্র পরিবার নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান – এ কারণেই বিশ্বের সকল সমাজে পরিবার উপস্থিত। ম্যালিনোস্কি আরো বলেন, একই ধরনের সামাজিক একক থাকা সত্ত্বেও পরিবার অন্য সব একক থেকে স্বতন্ত্র। পরিবারের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: পরিবারের সদস্যদের একে অপরের প্রতি বিশেষ ধরনের অনুভূতি (ভালবাসা, স্নেহ) থাকে। এর কারণ, একমাত্র পরিবারের সদস্যরা রক্ত (বাবা-মা এবং তাদের ঔরসজাত সন্তান) এবং বিবাহ (স্বামী এবং স্ত্রী) – এই দুই সূত্রে সম্পর্কিত।
জ্ঞাতি সম্পর্কের এই ঘনত্ব আর অন্য কোন একত্রে বসবাসকারী একক বা জ্ঞাতি দলে দেখা যায় না। পরিবারের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, পরিবারের সদস্যরা নির্দিষ্ট স্থানে একত্রে বসবাস করেন, এবং তৃতীয়ত, পরিবার সন্তান লালনপালনের কার্য সম্পাদন করে। ম্যালিনোস্কির দৃষ্টিতে পরিবারের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি একটি সীমানা-নির্দিষ্ট সামাজিক একক। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিবাহিত পুরুষ কিংবা নারীর যৌনক্রিয়া বিয়ের সম্পর্কের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকে, একজন পুরুষের আয় বণ্টিত হয় পরিবারের ভিতরে।
ম্যালিনোস্কি যেভাবে সর্বজনীন পরিবারের সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছিলেন, নৃবিজ্ঞানী র্যাডক্লিফ-ব্রাউন সেটা অনুসরণ করেননি। তিনি বলেছেন “মৌলিক পরিবার”-এর কথা। র্যাডক্লিফ-ব্রাউন মৌলিক পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: “একজন পুরুষ এবং তার স্ত্রী, এবং তাদের একটি অথবা একাধিক সন্তান । তাঁরা সকলে একত্রে বসবাস করতেও পারেন, নাও পারেন”।” যদিও র্যাডক্লিফ-ব্রাউন ধরে নেননি পরিবার মাত্রই একটি একত্রে বসবাসকারী একক কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পরিবারের ধারণা পাশ্চাত্য অণু পরিবারকে ধারণ করে (একজন পুরুষ এবং তার স্ত্রী)। বর্তমানের নৃবিজ্ঞানীরা সে কারণে তার পরিবারের ধারণাকে অপর্যাপ্ত মনে করেন।
জাতি-কেন্দ্রিকতার প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৭০ এর দশকের বিশ্বব্যাপী রাজনীতির পরিসরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মার্কিনী আগ্রাসন, ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, কিছু নৃবিজ্ঞানীদের মার্কিন সরকারের সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন। বৃহত্তর এই প্রেক্ষিতে, নৃবিজ্ঞানে কিছু বদল ঘটল। নিজ (পাশ্চাত্য) সমাজ হয়ে উঠল নৃবিজ্ঞানীর গবেষণার ক্ষেত্র। যা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন শুরু হ’ল। পরিবার প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানীদের কাজ থেকে ধরা পড়ল দুটি জিনিস।
একটি হচ্ছে, পাশ্চাত্য সমাজে অণু পরিবার স্বাভাবিক, এ ধারণা শক্তিশালী হলেও বাস্তবে এমন বহু পরিবার আছে যেখানে একই সাথে বসবাস করেন দাদা/দাদী বা নানা/নানী, বাবা-মা’র ভাই-বোন, সন্তানদের স্ত্রী কিংবা স্বামী। এমনকি, এমনও হতে পারে যে একইসাথে বসবাস করছেন এমন মানুষজন যাঁরা জ্ঞাতি নন। যেমন ধরুন, বন্ধু, ভাড়াটিয়া। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিকতার ধারণা শ্রেণী আধিপত্যের সাথে যুক্ত। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে অণু পরিবার শুধুমাত্র আদর্শ নয়, বাস্তবও বটে। প্রথাগত নৃবিজ্ঞানে পরিবারের সাথে শ্রেণীর যুক্ততা এবং শ্রেণী আধিপত্যের প্রসঙ্গগুলোকে আড়াল করা হয়েছিল।
আরও দেখুনঃ