আজকের আলোচনার বিষয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও আর্থব্যবস্থা – যা অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এর অর্ন্তভুক্ত, অর্থশাস্ত্রের জগতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলতে কেবল বাজার ও বাজার সংক্রান্ত বিষয় বোঝানো হয়ে থাকে। এখানে লক্ষ্য রাখা দরকার যে অর্থশাস্ত্র (Economics) যখন বিকাশ লাভ করেছে তখন ইউরোপের সমাজগুলোতে শিল্পভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। সেটা আঠারো শতকের কথা। তাছাড়া সেই সব সমাজে তখন মুনাফা বা লাভের জন্য নানাবিধ রকম দ্রব্য উৎপাদন চালু হয়েছে।
সেইসব দ্রব্য তৈরি করে বাজারে তা বিক্রী করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে শিল্প-কল-কারখানার মালিকেরা বিপুল পরিমাণ লাভ করে থাকে। আবার ঐ সকল দ্রব্যের প্রয়োজন থাকায় ক্রেতাদের পক্ষেও তা কিনতে হয়। সংক্ষেপে বলা যায় অর্থশাস্ত্র এই দুই কর্মকান্ড – কারখানায় উৎপাদন এবং বাজারে ক্রেতাদের কেনাকাটা – এর উপর মনোযোগ দিয়ে এসেছে। কিন্তু নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সমাজে গবেষণা করতে গিয়ে গোড়াতেই বুঝতে পারলেন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে এরকম সীমাবদ্ধ করে বোঝা যাবে না।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও আর্থব্যবস্থা
তাঁদের চিন্তা-ভাবনা গড়ে ওঠার পেছনে কিছু বিষয় কাজ করেছে। প্রত্যেকটা সমাজেই মানুষ কিছু না | কিছু উৎপাদন করে থাকে। এই উৎপাদন প্রাথমিকভাবে খাবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য। আর এর পর বাসস্থানের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। অর্থাৎ শিল্পভিত্তিক সমাজে নানাবিধ ধরনের দ্রব্য তৈরি হয়ে থাকে যেগুলো মূলত ভোগ্য দ্রব্য। কিন্তু এর বিপরীতে খাবার এবং বাসস্থানের জন্য কিছু উৎপাদন সকল সমাজেই হয়ে থাকে। মানুষ খাবারের তাগিদ থেকেই খাদ্য উৎপাদন করে। থাকবার তাগিদ থেকেই কিছু জিনিস বানায়। সেটা সকল সমাজের জন্যই বাস্তব।
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান সে কারণে গোড়াতেই উৎপাদন ব্যবস্থাকে বোঝার চেষ্টা করল। উৎপাদনকে ঘিরে আরও কিছু ধারণা বোঝা দরকার হয়ে পড়ে। কারণ উৎপাদন হবার পরে সেগুলো কি প্রক্রিয়ায় সমাজের সদস্যদের হাতে পৌঁছায় সেটাও একটা মূল জিজ্ঞাসা। একে কেন্দ্র করেই অন্য ধারণা গুলো হচ্ছে বিনিময় এবং বণ্টন। আসলে – বিনিময় এবং বণ্টন দুটো দুই বিষয় হলেও একটার সঙ্গে একটা সম্পর্কিত। এই বিষয়ে স্বতন্ত্র পাঠ রয়েছে। তাই এখানে সে বিষয়ে আলাদা করে কোন আলোচনা করা হচ্ছে না। আপাতত কেবল এটুকু খেয়াল রাখা দরকার যে, কোন একটি সমাজ, দল বা মানুষ নিজের প্রয়োজনীয় সকল কিছুই উৎপাদন না করতে পারে।

তাহলে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিগুলো অন্যত্র হতে সংগ্রহের জন্য একটা বিনিময় করতে হবে। সেটা আধুনিক কালের টাকার ব্যবস্থায় হোক। আর অন্য কোন ব্যবস্থায় হোক। আবার বিনিময় করে নিজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেউ পাবেন কিনা তা নির্ভর করছে তাঁর/তাঁদের কাছে কি পরিমাণ সম্পদ আছে এবং সেই সম্পদের বিনিময় মূল্য কত তার উপর। কিন্তু তাঁর হাতে সম্পদের পরিমাণ – এবং এর বিনিময় মূল্য একেবারেই বণ্টন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করছে। ফলে একটা অন্যটার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্য দিয়েই সমাজে ভোগের পার্থক্য তৈরি হয়। অর্থাৎ সমাজের মানুষের মধ্যে কে বেশি সম্পদ ভোগ করছেন আর কে তা করতে পারছেন না তার সবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে ভোগ ধারণাটিও দরকার হয়ে পড়ছে।
তাহলে যে কোন সমাজের মানুষজনের উৎপাদন ও এই সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকান্ডই অর্থনৈতিক | কর্মকান্ড। আর উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময়, ভোগ এই সকল মিলে যে একটা ব্যবস্থা তৈরি হয় – সেটাই আর্থব্যবস্থা। মার্ক্সবাদী নৃবিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে একটা ধারণা ব্যবহার করে থাকেন উৎপাদন পদ্ধতি (mode of production)।
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান শাখাটি বিশ শতকেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু | নৃবিজ্ঞানীরা যখন এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করেন তখন নৃবিজ্ঞানীদের পুরোনো গবেষণা থেকেও | উদাহরণ টানেন এবং সে সমস্ত কাজের মধ্যকার তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ তুলে আনেন। আপনারা আগেই জেনেছেন অনেকেই অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানকে অর্থনীতি এবং নৃবিজ্ঞানের সমন্বয় হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবে নৃবিজ্ঞানের এবং অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব ও পদ্ধতি তেমন একটা একত্রিত হয়নি। প্রধান সমস্যা হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ আর অন্যান্য সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক ভাবনা-চিন্তা এবং বাস্তব চর্চার বিশাল ফারাক আছে। আর অর্থশাস্ত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই মূলত লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। সে কারণেই সমন্বয়ের ব্যাপারটা মূলত স্বপ্নই রয়ে গেছে। এই একই প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের মধ্যেও তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
আরও দেখুনঃ