পারস্পরিক লেনদেন 

আজকের আলোচনার বিষয় পারস্পরিক লেনদেন – যা  বিনিময় এবং বণ্টন এর অর্ন্তভুক্ত, যখন দুই পক্ষের মধ্যে দ্রব্যাদি (goods) বা পরিষেবার ( services) প্রায় সমমূল্যের বিনিময় হয় তখন তাকে পারস্পরিক লেনদেন বলা হয়। উপহার বিনিময়কেও এর অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। এখানে সমমূল্য কথাটি নিয়ে একটু ভাববার দরকার আছে।

আমাদের মাথায় মুদ্রার প্রচলন এত শক্তিশালীভাবে গেঁথে আছে যে ‘সমমূল্য’ বললেই আমরা মুদ্রার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে বসি – ‘দাম কত’। যে সকল সমাজে মুদ্রার একই রকম দাপট ছিল না সেখানে সমমূল্যের বলতে প্রয়োজনীয়তা ও মর্যাদা দিয়ে বুঝতে হবে। এই ধরনের বিনিময় বা বণ্টন পদ্ধতিতে মুনাফা বা লাভের প্রসঙ্গ আসে না – সেটা আপনারা আগেই – জেনেছেন। এখানে সামাজিক মান-মর্যাদার বিষয় কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আছে প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা। অর্থাৎ, যে জিনিসটা বিনিময় করা হচ্ছে তার ব্যবহারিক গুরুত্ব কি।

পারস্পরিক লেনদেন

পারস্পরিক লেনদেন 
পারস্পরিক লেনদেন

 

কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পারস্পরিক লেনদেনের ৩টি ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলি হচ্ছে: সাধারণীকৃত লেনদেন (generalized reciprocity), ভারসাম্যকৃত লেনদেন (balanced reciprocity) এবং নেতিবাচক লেনদেন (negative reciprocity)। সাধারণীকৃত লেনদেনের সবচেয়ে কার্যকরী উদাহরণ হচ্ছে খাবার-দাবার ভাগ করা যেখানে নিজের কোন ধরনের স্বার্থ কাজ করে না। এটা এমন একটা লেনদেন যেখানে প্রদত্ত জিনিসের মূল্য হিসেব করা হয় না, ফিরতি পাওনার জন্য কোন সময়কাল নির্দিষ্ট করা থাকে না। অস্ট্রেলীয় শিকারী সম্প্রদায় যখন কোন জন্তু হত্যা করে তখন শিকারীদের পরিবারে এবং অন্যান্য পরিবারে মাংস ভাগাভাগি করে নেয়া হয়।

একটা দলের সকলেই এর ভাগ পায়। কে কতটা এবং কি পাবে তা নির্ভর করে শিকারীর সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্কের উপর। যেমন, একটা ক্যাঙ্গারু হত্যা করা হলে এর পেছনের বাম পা ভাইয়ের পরিবারে যাবে, লেজ যাবে চাচাত ভাইয়ের কাছে, পাছার মাংস এবং চর্বি যাবে শ্বশুরের কাছে, শাশুড়ির কাছে যাবে পাঁজর, সামনের পা দুটো ফুপুর কাছে, মাথা যাবে শিকারীর স্ত্রীর কাছে এবং নাড়িভুঁড়ি ও রক্ত শিকারীর নিজের কাছে থাকবে। যে সকল নৃবিজ্ঞানী অস্ট্রেলীয় এই সমাজ পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী এই হচ্ছে সেই সমাজের নিয়ম। বণ্টনের এই সামাজিক নিয়ম মানা না হলে সেখানে এ নিয়ে তর্ক-বিবাদ হতে পারে।

এই ব্যবস্থায় শিকারী পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত মনে হতে পারে, কিন্তু অন্য একজন শিকার করলে তারা আবার সুবিধাজনক ভাগ পাবে। দেয়া ও নেয়ার বেলায় এই রেওয়াজ হচ্ছে বাধ্যতামূলক। যেমনটা কুরবানীর মাংসের বেলায় এই অঞ্চলে হয়ে থাকে। অনেকে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ককে সাধারণীকৃত লেনদেনের সম্পর্ক হিসেবে বলে থাকেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ভারসাম্যকৃত লেনদেন বলতে বোঝানো হয়ে থাকে যেখানে কোন দেয়া-নেয়া মূল্যের হিসেবে এবং ফেরতের সময়কালে নির্দিষ্ট করা থাকে। নৃবিজ্ঞানী রবার্ট লোঈ ক্রো ইন্ডিয়ান সমাজ থেকে এরকম বিনিময়ের উদাহরণ টেনেছেন। ধরা যাক কোন বিবাহিত নারী তাঁর ভাইকে খাবার উপহার দিলেন, তাঁর ভাই তখন মহিলার স্বামীকে ১০টা তীর দিতে পারেন যাকে একটা ঘোড়ার সমতুল্য মনে করা হয় ঐ সমাজে। এই ধরনের লেনদেনের সবচেয়ে খ্যাতিমান উদাহরণ হচ্ছে মালিনোস্কি বর্ণিত নিউ গিনির ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের কুলা চক্র। তবে এটাকেই কেউ কেউ আবার প্রাথমিক পর্যায়ের বার্টার (আধুনিক মুদ্রার বদলে অন্য কোন দ্রব্যকে বিনিময়ের মান হিসেবে ব্যবহার) ভিত্তিক বাণিজ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।

কুলা চক্র বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। যখন কোন বিনিময়কারী গ্রহীতা হিসেবে বাড়তি সুবিধা পাবার চেষ্টা করে থাকে তখন নেতিবাচক লেনদেন বলা হয়। এক্ষেত্রে লেনদেনের দুই পক্ষের মধ্যে পরস্পর বিরোধী স্বার্থ কাজ করে। কোন কিছু জোর করে নিয়ে নেয়াকে এ ধরনের লেনদেনের গুরুতর উদাহরণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানী ক্লাকহন নাভাজো সমাজের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে কোন ভিনদেশী মানুষের সাথে দেনাপাওনার সময় তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা নৈতিকভাবে সমর্থন করা হয়ে থাকে। ভারসাম্যকৃত লেনদেনের একটা ধরন হিসেবে সমতা বিধানের কৌশল ( levelling mechanism) উল্লেখ করা হয়ে থাকে । এটার মূলনীতি হচ্ছে কোন সমাজে বিশেষ কারো হাতে সম্পদ জমতে না দেয়া।

এখানে একটা ব্যাপার ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এ ধরনের লেনদেন নিয়ে নৃবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায় অনেক সময়ই ব্যাপক অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন, পারস্পরিক লেনদেন সম্পর্কে বলা হয় এটা স্বার্থের ঊর্ধ্বে সমতুল দ্রব্যাদির বিনিময়, আবার নেতিবাচক লেনদেনের উদাহরণ হিসেবে লুণ্ঠন বা চুরিকে উল্লেখ করা হয়। এই অসঙ্গতিগুলোর একটা কারণ হতে পারে; যে সকল সমাজ নৃবিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন তার অধিকাংশই দুর্বোধ্য লেগেছে তাঁদের কাছে। কারণ পশ্চিমা সমাজ থেকে এই সমাজগুলো সবিশেষ ভিন্ন।

কুলা চক্র: ভারসাম্যকৃত লেনদেনের সাধারণ উদাহরণ হিসেবে উপহার বিনিময়ের কথা সবসময়ই উল্লেখ করা হয়। নৃবিজ্ঞানের গবেষণার ইতিহাসে কুলা চক্রের কথা এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ভাবে বলা হয়ে থাকে। | ম্যালিনোস্কি নিউ গিনির ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জে প্রচলিত এই প্রথা বর্ণনা করেছেন। একে বাণিজ্য হিসেবেও দেখা হয়। কুলা হচ্ছে বৃত্তাকারে সজ্জিত কতগুলো দ্বীপে বসবাসরত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিয়াশীল ব্যাপক একটি লেনদেন। এই লেনদেনে দুই ধরনের বস্তু প্রধান, এগুলো দুইটা ভিন্ন ভিন্ন গতিপথে | ভ্রমণ। লাল শামুক দিয়ে বানানো বড় কণ্ঠহার (soulava) যা ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে এবং সাদা শামুকে বানানো বাজুবন্দ্ (mwali) যা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে।

এক দ্বীপ থেকে আরেক | দ্বীপে কোন একটি বস্তু অন্যটার বিনিময়ে বিনির্মিত হয়। এই লেনদেনের অপরাপর খুঁটিনাটি নির্ধারিত হয় সমাজের প্রথা ও কানুন দ্বারা। অংশীদার প্রত্যেকটা গ্রামের কিছু পুরুষ কুলা চক্রে অংশ নিয়ে থাকে। এরা এই প্রথার শরিকদের কাছ থেকে বাজুবন্দ কিংবা কণ্ঠহার গ্রহণ করে এবং কিছুক্ষণ নিজের | কাছে রেখে অন্য কারো কাছে চালান দেয়। কেউই কোন বস্তু চিরতরে দখল করে না। এই আদান- প্রদান সম্পর্ক সেখানে চিরস্থায়ী, জীবনব্যাপী সম্পর্ক।

 

পারস্পরিক লেনদেন 
পারস্পরিক লেনদেন

 

ম্যালিনোস্কির মতে, কুলা বিনিময়ের সন্তুষ্টি জড়িয়ে আছে তাদের মর্যাদা আর অনুভূতিকে ঘিরে। তবে কুলা বিনিময়কে সমাজ সংহতির একটা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। লেনদেনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে অংশীদারবৃন্দ সামাজিকভাবে একে অপরের আপন থাকে। কুলার মূল দ্রব্যাদির পাশাপাশি অন্যান্য দ্রব্যাদিও বিনিময় হয়ে থাকে। সেই বাণিজ্যের একটা স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে এই প্রথায়। কিন্তু সর্বোপরি, কুলা প্রথার গুরুত্ব হচ্ছে একটা সমাজের মানুষজনের মধ্যকার সৌহার্দ্য। নৃবিজ্ঞানীদের সেরকমই অভিমত ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment