পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন

আজকের আলোচনার বিষয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন – যা ধর্মীয় আন্দোলন এর অর্ন্তভুক্ত,  ধর্মের কার্যাবলী আলোচনার সময় এ বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে যে, ধর্ম সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে একথাও উল্লিখিত হয়েছে যে, ধর্ম সমাজ পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় সকল প্রধান ধর্মেরই আবির্ভাব ঘটেছে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে বা প্রয়াসে।

এছাড়া সরাসরি নূতন কোন ধর্মের প্রবর্তন না ঘটলেও বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সময়ে অনেক পরিবর্তনকামী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে ধর্মীয় ভাবাদর্শের আলোকে। স্বাভাবিক ভাবেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধর্মীয় আন্দোলনের স্বরূপ ও গতি-প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবে ধর্মীয় আন্দোলনের বিষয়টি নৃবিজ্ঞানে বিশেষভাবে নজরে এসেছে একটা সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে – ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সম্প্রসারণের মুখে নৃবিজ্ঞানীদের অধীত বিভিন্ন উপনেবিশত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, সেগুলির একটা অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধ্যান- ধারণার আলোকে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলন।

পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন

 

পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন

 

নৃবিজ্ঞানীরা এ ধরনের আন্দোলনকে ইংরেজীতে nativistic, revivalistic millenarian, messianic ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন, যেগুলোকে সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য এন্থনি ওয়ালেস revitalization movement প্রত্যয়টি চালু করেন, হয়েছে, যার বাংলা করা যেতে পারে ‘পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন’।

ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী বা শ্রেণী ও জাতিগত বৈষম্যমূলক নিপীড়নের মুখে পতিত কোন অধস্তন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সূচিত ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন বিভিন্ন রূপ নিতে পারে। কোন কোন আন্দোলনে নূতন কিছুকে গ্রহণ করার পরিবর্তে পুরাতন কিছুকে আঁকড়ে থাকার বা লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যকে নবউদ্যমে ফিরিয়ে আনার প্রবণতা দেখা যায়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে নূতন ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রসার ঘটতে পারে। কোন কোন আন্দোলনে এক ধরনের নিস্ক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাবল্য থাকতে পারে, যেখানে ক্ষমতাসীনদের সাথে সংঘাত ও সংঘর্ষ পরিহার করে চলা হয় এবং ইহজাগতিক মুক্তির পরিবর্তে পারলৌকিক পরিত্রাণের উপর জোর দেওয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের প্রত্যক্ষ আহ্বান থাকতে পারে, এবং শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, সশস্ত্র কর্মকান্ড পরিচালিত হতে পারে। পুনরীজ্জবনবাদী আন্দোলনসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত কোন নেতার অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উনিশ শতকে উত্তর আমেরিকার অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিলক্ষিত একটা বিশেষ ধরনের ধর্মীয় আন্দোলন, যা ‘প্রেত নৃত্য’ (Ghost Dance) নামে অভিহিত, পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। উক্ত আন্দোলনে আদিবাসীদের মৃত পূর্বসূরীরা প্রেত-জগত থেকে ফিরে এসে শ্বেতাঙ্গদের নির্মূল করতে সহায়তা করবে, এই ধরনের ভবিষ্যৎবাণীতে বিশ্বাসীরা সেই প্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি হিসাবে ব্যাপকভাবে নৃত্য-নির্ভর আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে শুরু করে।

অনেক ক্ষেত্রেই এই ‘প্রেত নৃত্য’সমূহ সংশ্লিষ্ট আদিবাসীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছিল, এবং তাদের অনেকে শ্বেতাঙ্গদের বন্দুকের গুলি ঠেকাতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হত, এমন জাদুকরী জামা গায়ে পরিধান করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসীদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের মুখে এ ধরনের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় বা অর্ন্তমুখী রূপ লাভ করে।

 

পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন

 

বিশ্বের অন্যান্য উপনেবিশিত অঞ্চলেও আমেরিকার আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ আন্দোলন লক্ষ্য করা গেছে, যেগুলির মধ্যে মেলানেশীয়দের মাঝে পরিলক্ষিত ‘কার্গো কাল্ট’ নামে পরিচিত আন্দোলনের প্রতি নীচে আমরা নজর দেব। কিছুটা ভিন্ন চরিত্রের হলেও এই উপমহাদেশেও ব্রিটিশ শাসনের সময় বেশ কিছু ধর্মীয় সংস্কারবাদী বা পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যেগুলির মধ্যে আমরা ‘ব্রাহ্ম আন্দোলন’ ও ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ সম্পর্কে নীচে আলোচনা করব।

Leave a Comment