আজকের আলোচনার বিষয় ব্রাহ্ম আন্দোলন – যা ধর্মীয় আন্দোলন এর অর্ন্তভুক্ত, বাংলার ইতিহাসে উনিশ শতকের গোড়ায় সূচিত ব্রাহ্ম আন্দোলন একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই আন্দোলন এমন এক সময়ে সূচিত হয়েছিল যখন ব্রিটিশ শাসনের আওতায় বাংলায় ব্যাপক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, বাঙালী সমাজে কলিকাতা-কেন্দ্রিক একটি নূতন শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, যাদের মাধ্যমে বাংলার একটা ‘নবজাগরণ’ ঘটেছিল বলে বলা হয়। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সাথে একজনের নাম বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন রামমোহন রায়।
ব্রাহ্ম আন্দোলন
তবে এটি তাঁর একার আন্দোলন ছিল না, বরং সংখ্যায় খুব বেশী না হলেও এতে তাঁর সাথে যাঁরা শরীক ছিলেন, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁরা ছিলেন তৎকালীন সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রভাবশালী শ্রেণীর প্রতিনিধি। ব্রাহ্ম আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্যের আলোকে আধুনিক প্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য একেশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। তবে এই আন্দোলনের লক্ষ্য বা ফলাফল শুধু ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যেই সীমিত ছিল না, বরং বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে এর প্রভাব পড়েছিল।
ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান রামমোহন রায় বেশ অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। ফারসী ও আরবী ভাষায় তাঁর দখল ছিল এবং পরবর্তীতে তিনি ইংরেজীও রপ্ত করেন এবং সেসূত্রে তথা ব্যবসায়িক সূত্রে ইউরোপীয়দের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে সমকালীন পশ্চিমা ধ্যান ধারণা সম্পর্কেও ঘনিষ্ঠভাবে অবগত হন।

হিন্দু ধর্মের অনেক কিছু অযৌক্তিক, মিশনারীদের এ ধরনের প্রচারণার বিপরীতে রামমোহন রায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ইসলামী বা খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের অনুরূপ ধর্মীয় বিশ্বাস আদি বৈদিক ঐতিহ্যেও রয়েছে। এই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ। ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারীরা পৌত্তলিকতা পরিহার করে নিরাকার ইশ্বর বা ব্রহ্মার উপাসনার পথ বেছে নেয়, এবং মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মত সাপ্তাহিক সমবেত প্রার্থনা-সভার আয়োজন করেছিল। একসময় মিশনারীদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন যে, রামমোহন রায় খ্রিস্টান হতে যাচ্ছিলেন। তিনি তা হন নি, তবে তাঁর প্রবর্তিত ব্রাহ্ম রীতি-নীতিতে খ্রিস্টীয় প্রভাব শনাক্ত করা কঠিন নয়।
রামমোহন রায় ও তাঁর সহযোগী-অনুসারীরা মূলতঃ কলিকাতায় গড়ে ওঠা শিক্ষিত ও বিত্তবান ভদ্রলোকদের শ্রেণীকেই প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁরা পশ্চিমা উদারনৈতিক চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এবং আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংস্কার করে যুগোপযোগী করে তুলতে আগ্রহী করেন।
একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় ধারা হিসাবে ব্রাহ্ম আন্দোলন পরবর্তীকালে তেমন প্রসার লাভ করে নি, তবে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরা বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। যেমন, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন রায় ছিলেন সোচ্চার। একইভাবে বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ চালু করা, ইত্যাদি সামাজিক আন্দোলনে ব্রাহ্মরা সক্রিয় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত ব্যক্তিত্ব তথা ঠাকুর পরিবার ও অনুরূপ অন্যান্য প্রভাবশালী ব্রাহ্ম পরিবার একত্রে বাঙালী ভদ্রলোক শ্রেণীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কাজেই এসব বিবেচনায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
আরও দেখুনঃ