উন্নয়ন ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা

আজকে আমাদের আলোচনা উন্নয়ন ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা নিয়ে। আগের পাঠ থেকে আপনারা জানেন কোন্ ধরনের প্রেক্ষাপট থেকে নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকাণ্ডে ফলিত গবেষণার একটা নিবিড় যোগাযোগ তৈরি হয়।

উন্নয়ন ভাবনা এবং তৃতীয় -বিশ্বে গবেষণা

 

উন্নয়ন ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা অধ্যায়ের সারাংশ

 

এখানে সারাংশ আকারে বলা যায়, বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক নীতিমালা প্রণয়নে নৃবিজ্ঞানীদের অংশ নেবার প্রক্রিয়াই ফলিত নৃবিজ্ঞান ধারার সূচনা করে, এবং গোড়াতে নৃবিজ্ঞানীদের এই সম্পর্ক ছিল ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রক্রিয়াটাতে উল্লেখযোগ্য বদল আসে।

সেই প্রেক্ষিতে ফলিত নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, এবং পদ্ধতিতেও। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার জায়গা হয়ে দাঁড়াল “উন্নয়ন’। আলোচনার সুবিধার্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা জরুরী।

 

উন্নয়ন ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা অধ্যায়ের সারাংশ:

আজকের আলোচনার বিষয় উন্নয়ন ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা অধ্যায়ের সারাংশ – যা উন্নয়ন- ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বে -গবেষণা এর অর্ন্তভুক্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর ব্যাপারে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের নীতিমালা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে।

উন্নয়ন নামক ধারণাটি নতুন রূপে দেখা দিল। এই ধারণার মুখ্য দিক হচ্ছে নতুন জাতিসমূহের ‘সংকট’ চিহ্নিত করা। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিতকায় গরিব বিশ্বে অনুদান এবং ঋণ আসতে শুরু করল এবং বড় সব পদ তৈরি হ’ল। এসব পদে নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ ফলিত নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে।

ফলিত নৃবিজ্ঞান কি ধরনের বিপজ্জনক ভূমিকা রেখেছে তার সবচেয়ে ব্যবহৃত উদাহরণ হচ্ছে ভিকোস প্রকল্প। ফলিত নৃবিজ্ঞানীরা এবং তাঁদের নিয়োগকর্তা সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনার মুখে এই ধারার গবেষণাকে রাজনৈতিক দিক থেকে আরও সংবেদনশীল করে তুলবার চেষ্টা করছেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি

আপনারা জানেন যে একটা সময় ইউরোপের বাইরের সারা দুনিয়ায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্য দখল বসিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জাতিসমূহ ইউরোপীয় উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। এই লড়াইগুলো আগেও ছিল।

তবে নানান অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এগুলো হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে সেগুলো উপনিবেশের বিরুদ্ধে জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সকল আন্দোলন ঔপনিবেশিক শক্তিকে হঠিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য লাভ করতে থাকে।

আফ্রিকা, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মানুষজন স্বাধীনতা লাভ করেন। এই প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে: যে সকল রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করেছে তার সবগুলোই একসময়ে ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনস্ত ছিল। নতুন পরিস্থিতিতে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর সঙ্গে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের সম্পর্ক কি হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা দেখা দিল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর পরিচালকদের মাথায়।

একই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই পরিকল্পনায় শরিক হয়ে উঠল। এটাও আমাদের খেয়াল রাখা দরকার যে, আফ্রিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে অনেকগুলো দেশ স্বাধীন হবার পরও সেখানকার শাসকরা মূলত ইউরোপের থেকে গেল। যে সকল দেশে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে শাসক দেশ থেকে প্রচুর সংখ্যক লোকজন এসে জায়গা-জমি দখল করে নিতে থাকল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারাই সেইসব দেশের শাসক হয়ে বসল। জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি রাষ্ট্রের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে ।

এই সময়কালে শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে ‘উন্নয়ন’ ধারণাটি আসে। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন, তারা যথেষ্ট পিছিয়ে আছে এই প্রচারণাটি উন্নয়নের ধারণার ভিত শক্ত করতে – সাহায্য করে। উন্নয়ন ধারণাটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া এবং উপনিবেশোত্তর (যে সকল সমাজে উপনিবেশ ছিল) সমাজের জন্য সেটাকে আবশ্যিক গ্রহণযোগ্য করে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রচারণা উদ্যোগ সফল হয়েছিল। ইতিহাসেই তার প্রমাণ মেলে।

এ জন্যেই ‘উন্নয়ন’কে অনেকে বৈশ্বিক প্রকল্প বলে মনে করেন। অনেক চিন্তাবিদ বিশ্বজুড়ে এই উন্নয়ন প্রকল্পকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, এটা হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসকদের যুদ্ধের পরবর্তী সময়কালের পরিকল্পনা। এর মানে হ’ল: যেহেতু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নানান কারণে উপনিবেশের প্রত্যক্ষ শাসন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তাই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবার নতুন পরিকল্পনা তাদের জন্য দরকার হয়ে পড়ল।

সেই পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে উন্নয়নের ধারণা। এই ধারণার মুখ্য দিক হচ্ছে নতুন জাতিসমূহের ‘সংকট’ চিহ্নিত করা। এই ধরনের চিন্তাবিদদের বক্তব্য হচ্ছে, উপনিবেশের সম্পর্ক মোচনের পথে কৌশলগতভাবে উন্নয়নের গল্প ফাঁদা হ’ল। তাতে সাবেক ঔপনিবেশিক আমলা এবং নতুন স্থির হতে না পারা জাতীয়তাবাদী শাসকদের জন্য ক্ষমতার একটা ছাড়পত্র তৈরি হ’ল।

তবে বন্দোবস্তটা নিছক এখানেই থেমে থাকল না। বহুজাতিক কুলীন যারা, ধরা যাক বহুজাতিক বাণিজ্যসংস্থা, তারাও এর শরিক হতে পারল। প্রত্যেকেরই কাজ দাঁড়াল যেটা এরই মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে – নতুন জাতিরাষ্ট্রের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। সেই এক – পুরোনো কাহিনী। কিভাবে রাষ্ট্রসমূহ ‘পশ্চাৎপদতা’ থেকে ‘আধুনিকতা’র দিকে যাত্রা করতে পারে। চিন্তাবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ অনেকেই এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে উন্নয়নের এই ধারণা ও আলাপ-আলোচনা কপট ।

উন্নয়ন নিয়ে এইসব আলাপ আলোচনার প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠল একটার পর একটা উন্নয়ন সংস্থা – প্রথমে আন্তর্জাতিক এবং আস্তে আস্তে দেশীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই এসব ঘটতে শুরু করে দিয়েছিল। এর প্রভাব এবং ফলাফল নানামুখী হয়ে উঠল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে বিষয়টা আমাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে: এই প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে অনুদান এবং ঋণ আসতে শুরু করল। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বড় বড় সব পদ তৈরি হ’ল। সেই সকল পদে এমন বিশেষজ্ঞরা কাজ পেতে শুরু করলেন যাঁদের প্রশিক্ষণকে নতুন এই জাতিরাষ্ট্রগুলির বদলের জন্য জরুরী হিসেবে দেখানো হচ্ছিল, ভাবানো হচ্ছিল।

বিশাল এই চক্রের মধ্যেই উন্নয়ন এবং নৃবিজ্ঞান কাছাকাছি আসতে পেরেছে। তার মানে, স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলির উন্নয়ন পরিকল্পনায় নৃবিজ্ঞানীদেরও ডাক আসতে শুরু করল। আপনাদের মনে পড়বে ম্যালিনোস্কির বক্তব্য যেখানে বাস্তবানুগ নৃবিজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। ‘উন্নয়ন’ ধারণার যুগে নৃবিজ্ঞানের বাস্তবানুগ হওয়া বলতে বোঝা হ’ল উন্নয়ন পরিকল্পনায় নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ। আর এই পরিকল্পনা করে দিতে থাকল সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা।

 

নৃবিজ্ঞানে উন্নয়ন-এর দুই প্রকার ধারণা

 

নৃবিজ্ঞানে উন্নয়ন-এর দুই প্রকার ধারণা

এখানে প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়ে কিছু আলাপ করা হবে। নৃবিজ্ঞানের জগতে উন্নয়ন ধারণাটির অর্থ নিয়ে এই আলাপ। পশ্চিমা সমাজের দর্শন এবং সংস্কৃতিতে উন্নয়ন ধারণাটি একেবারে কেন্দ্রীয়। নৃবিজ্ঞান শাস্ত্রে এর অর্থ দুইভাবে দেখা দিয়েছে। একটি অপেক্ষাকৃত পুরোনো কালের নৃবিজ্ঞানের বিষয় এবং তুলনামূলকভাবে বড় প্রেক্ষাপটে তার অর্থ নির্দিষ্ট ছিল। অন্যটি সেই তুলনায় সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞানের বিষয় এবং আরও নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এর অর্থ ক্রিয়াশীল।

উন্নয়নের প্রথম ধারণাটি ঊনবিংশ শতকের নৃবিজ্ঞানের বিবর্তনবাদী চিন্তার একেবারে কেন্দ্রীয় ধারণা। এখানে সমগ্র মানবসমাজের ইতিহাসকে দেখা হত সোজাসুজিভাবে। ধারণা করা হ’ত যে, মানুষ ‘বন্যতা’ এবং ‘বর্বরতা’র ধাপ ডিঙিয়ে সামাজিক বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ‘সভ্যতা’র দশায় উপনীত হয়। এই যাত্রাকে তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রগতি (progress) বলা হয়েছে। লক্ষ্য রাখা দরকার যে, সভ্যতার এই ধারণা বানানো হয়েছিল পশ্চিমের সমাজ মাথায় রেখে। অর্থাৎ, পশ্চিমা সমাজই সভ্য – এই ধারণা থেকেই বিবর্তনের ধাপ ও চিন্তামালা গড়ে উঠেছে।

বিবর্তনবাদী চিন্তার এই উন্নয়নকে বাংলা লেখালেখিতে “বিকাশ” হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। আবার, বাংলায় বিকাশ ও প্রগতি দুটো শব্দই ইংরেজি ‘প্রোগ্রেস’ শব্দটির অর্থানুবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যাই হোক, উন্নয়ন সংক্রান্ত উনিশ শতকের নৃবিজ্ঞানের এই ধারণা খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল – সেটা মনে রাখা জরুরী। 

নৃবিজ্ঞানে উন্নয়নের সাম্প্রতিক ধারণাটি আপনারা ইতোমধ্যেই জেনেছেন। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এই ধারণাটি গড়ে ওঠে। বিশেষ এই ধারণাতে উন্নয়নকে মূলত আর্থনীতিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করে দেখা হয়। এক্ষেত্রে মুখ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত বিষয়গুলো হচ্ছে: উৎপাদন বাড়ানো, ভোগ বাড়ানো, এবং জীবন যাপনের মান বাড়ানো। মূলত গরিব বিশ্বের সমাজের জন্য এই লক্ষ্যগুলো ধার্য করা হয়েছে। এটাও এখানে স্মরণে রাখা দরকার যে, জীবন যাপনের মান বাড়ানো বলতে সাধারণ ভাবে ভোগ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়ে থাকে। সমাজের মানুষের মধ্যে বৈষম্য বা ফারাক নিয়ে তেমন একটা ভাবনা- চিন্তা করবার রেওয়াজ এই চিন্তাধারাতে নেই।

গত দু’ দশকে দারিদ্র্য বিমোচন করবার একটা উদ্যোগ উন্নয়ন পরিকল্পনাতে নেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে সেটাও উন্নয়ন ধারণার মত কপট। তাঁদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় গরিব বিশ্বের সমাজগুলোর বাস্তবতা দেখে। নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকাণ্ডের ইতিহাসে উন্নয়ন সংক্রান্ত যে দুই প্রকার ভাবনা পাওয়া যায় তাকে আলাদা আলাদা করে দেখে থাকেন কেউ কেউ । কিন্তু নৃবিজ্ঞানে উন্নয়ন ধারণা কাজ করেছে কিভাবে তার হদিস নিতে গেলে এই দুই প্রকারের – ভাবনাকে একত্রেই বুঝতে হবে। তাছাড়া ফলিত নৃবিজ্ঞানের গড়ে ওঠার সাথে এই দুই ভাবনারই নিবিড় যোগাযোগ আছে।

কারণ, নৃবিজ্ঞানের প্রথম জমানায় ‘সভ্যতা’র ধারণা নৃবিজ্ঞানীদেরকে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত করেছে; আর পরের জমানায় ‘সমৃদ্ধি’র ধারণা নৃবিজ্ঞানীদেরকে আন্তর্জাতিক ক্ষমতা- নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দুটো ধারণাই উন্নয়নের ধারণা। তবে প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে, বর্তমানের সম্পর্কটা ফলিত নৃবিজ্ঞানের পরিচয়ে কাজ করছে।

 

 

 

উন্নয়ন গবেষণায় নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ

উন্নয়ন গবেষণায় নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ

সাধারণভাবে আপনারা জেনেছেন যে, ইউরোপ ও মার্কিনের নৃবিজ্ঞানীরা উন্নয়ন পরিকল্পনায় ও গবেষণায় যুক্ত আছেন। আর তাঁদেরকে সংক্ষেপে ফলিত নৃবিজ্ঞানী বলা হয়। কিন্তু এই ধারাটি বিশেষভাবে বেড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণের পয়লা শর্ত এবং বৈশিষ্ট্য হ’ল তাঁরা গরিব বা তৃতীয় বিশ্বের জন্য উন্নয়ন-পরিকল্পনার আবশ্যিকতা মেনে নেন। এই নৃবিজ্ঞানীরা প্রধানত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কাঠামোকে মঙ্গলময় হিসেবে দেখে নিয়ে এগিয়েছেন যা তাঁদের প্রতি সমালোচকদের সমালোচনার একটা বড় জায়গা।

উন্নয়ন-নৃবিজ্ঞানীদের তৎপরতার মুখ্য দিক হ’ল: বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্বকে বাড়তে না দেয়া – যেমন, ধনী এবং গরিবদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব; – বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে প্রশমিত করা; শিল্পোন্নত এবং গরিব দেশগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক স্থাপনে চেষ্টা করা।

ফলিত নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিরীক্ষা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত পেরুর ভিকোস প্রকল্প। এখানে নৃবিজ্ঞানীদের বড় একটি দল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মুরুব্বী হয়ে পড়েন। তাঁরা ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি চালান। এর সমালোচনা করা হয় এই বলে যে, এর মাধ্যমে চূড়ান্ত বিচারে উৎপাদকদের (মালিক) ক্ষমতা চালান দেয়া হয়েছে। ফলিত নৃবিজ্ঞানীদের এই বৈশিষ্ট্যটা আলোচনায় আসা খুবই প্রয়োজন। পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত ফলিত নৃবিজ্ঞানীদের কাজের এই বৈশিষ্ট্যটি চিহ্নিত করা হচ্ছে যে, তাঁরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং পরিষেবা সরবরাহ করবার একচেটিয়া কর্তৃত্ব উৎপাদনকারী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে সাহায্য করে থাকেন।

বাংলাদেশের পানীয় জল সংক্রান্ত আলোচনায়ও এরকম বিশ্লেষণ দেখা দিচ্ছে। ফলিত নৃবিজ্ঞানীরা একাধারে পানীয় জলের সমস্যার কথা বলে একটা সময়ে দেশীয় পানির ব্যবস্থা (ইঁদারা, খাসপুকুর, কূয়া) বিলোপ করেছেন। আবার, আর্সেনিক সমস্যার প্রাক্কালে বিশুদ্ধ পানির সংকটকে চিহ্নিত করে তাঁরা বোতলজাত পানির বিস্তারকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তা দিচ্ছেন। মুস্কিল হ’ল: এখন তাঁরা দেশীয় পানির ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরলেও সেই ব্যবস্থায় পুনরায় ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

 

 

 

উন্নয়নের নানান ক্ষেত্র এবং ফলিত নৃবিজ্ঞানীর বিভিন্নতা

 

উন্নয়নের নানান ক্ষেত্র এবং ফলিত নৃবিজ্ঞানীর বিভিন্নতা

 

উন্নয়নের প্রচলিত ধারণা ক্রমশই বিস্তার লাভ করছে। গরিব বিশ্বের সরকারেরাও এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রাখছেন। উন্নয়ন ধারণার এই বিস্তারের প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের নানান দিক বা ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

সেটা করা হয়েছে উন্নয়ন-পরিকল্পনা নিতে যাতে সুবিধা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত, দারিদ্র্য খাত, পরিবেশ খাত ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো খাতওয়ারী এরকম ভাগ করবার মধ্য দিয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও তার প্রভাব পড়েছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পরিবেশ সংক্রান্ত উন্নয়ন-পরিকল্পনার দায়িত্বই নেবেন, দারিদ্র্যের উন্নয়ন-পরিকল্পনা নেবেন না। এভাবে ফলিত নৃবিজ্ঞানের পরিমণ্ডলেও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের জন্ম হয়েছে। এই অনুযায়ী নৃবিজ্ঞানীদের নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন, স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যে সকল নৃবিজ্ঞানী, কিংবা যাঁরা বর্তমানের স্বাস্থ্য-সংকটকে আবিষ্কার করেন তাঁদেরকে বলা হয় স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী (medical anthropologist), কিংবা যাঁরা শিক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা করে থাকেন তাঁদেরকে বলা হয় শিক্ষা-নৃবিজ্ঞানী। কিন্তু সমন্বিতভাবে তাঁদেরকে উন্নয়ন-নৃবিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে। তবে এখানে মনে রাখা দরকার, উন্নয়নের গবেষাণায় বিভিন্ন শাস্ত্রের মধ্যেকার ভিন্নতা আর তেমন ধরা পড়ে না যেমন ধরা যাক, সমাজতত্ত্ব কিংবা নৃবিজ্ঞানের ভেদাভেদ । 

এই পাঠের শেষ পর্যায়ে আমরা ফলিত নৃবিজ্ঞানের, কিংবা সাধারণভাবে উন্নয়ন নৃবিজ্ঞানের সমালোচনার মধ্য দিয়ে কিছু বদলের প্রসঙ্গে কথা বলব। দুটো স্পষ্ট বদলের কথা উল্লেখ করা জরুরী। এক, উন্নয়ন ধারার নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে একদল নৃবিজ্ঞানী নিজেদেরকে গড়ে তুলেছেন যাঁরা উন্নয়নের কপট ধারণা নিয়ে বিশ্লেষণ করে চলেছেন। তাঁদের প্রধান কাজ হচ্ছে, উন্নয়ন ধারণার ফাঁক-ফোকরগুলোকে চিহ্নিত করা, রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-পরিকল্পনার ক্ষয়-ক্ষতি বুঝিয়ে দেয়া এবং ক্ষমতার ফারাক আবিষ্কার করে দেয়া। এঁদের মধ্যে অনেকেই পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন, কেউ কেউ পুঁজিবাদ নিয়ে কাজ করছেন, কেউ কেউ আবার ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং বর্তমান সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে কাজ করছেন।

দুই, ফলিত নৃবিজ্ঞানীরা এবং তাঁদের নিয়োগকর্তা সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনার মুখে এই ধারার গবেষণাকে রাজনৈতিক দিক থেকে আরও সংবেদনশীল করে তুলবার চেষ্টা করছেন। কোনও একটা উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি তাঁরা এখন নিজেরাও কিছু হিসেব করে দেখেন। তাছাড়া গবেষণা এলাকার মানুষজনের ভাবনাকেও সম্পর্কিত করা যায় কিভাবে – সে ধরনের উৎসাহ দেখা দিয়েছে। – এসব প্রচেষ্টায় নৃবিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি ও উপলব্ধিতে নানারকম বদল এসেছে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞান (medical anthropology / anthropology of health) এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আগামী পাঠে ফলিত নৃবিজ্ঞানের একটা শাখা হিসেবে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নৃবিজ্ঞানের কথা উল্লেখ করব।

Leave a Comment