চতুর্থ বরফ যুগের অবসানে পুরোপলীয় শিকারী যুগের মানুষরা যে সঙ্কটে পড়েছিল তার কথা আমরা আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এক যুগান্তকারী অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সাধনের মাধ্যমেই মানুষ এ সঙ্কটের হাত থেকে চিরকালের মতো মুক্তি পেয়েছে। এ বিপ্লব হল কৃষির আবিষ্কার। তারপর শুরু হল নুতন পাথরের যুগ বা নবোপলীয় যুগ। কৃষির সাহায্যেই মানুষ সর্বপ্রথম খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হল।
নতুন পাথর যুগের সংস্কৃতি
শিকারী মানুষেরা ছিল প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল পরগাছা স্বরূপ। কারণ, তারা নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না। শিকারী সমাজের একটা অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা হল, এরা খাদ্য সংগ্রহে খুব বেশি দক্ষতা অর্জন করলে তার ফল সমাজের পক্ষে আত্মঘাতী হত। কারণ উন্নত অস্ত্র ও হাতিয়ার আবিষ্কার করলে তার সাহায্যে মানুষ বেশি বেশি পশুপ্রাণী হত্যা করে ফেললে তার নিজেরই ভবিষ্যতের খাদ্য ধ্বংস হয়ে যেত।
কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এ রকম কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না। কৃষি কাজের দ্বারা মানুষ নিজেই নিজের খাদ্য উৎপাদন করত। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় হাজার উন্নতি হলেও তার ফলে কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হত না। বরং তার উল্টো। নবোপলীয় যুগে জনসংখ্যা বাড়লেই তার খাদ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান ছিল কৃষির বিস্তার। জনসংখ্যা বাড়লে খাওয়ার লোক বেড়ে যায় একথা ঠিক কিন্তু সাথে সাথে কাজ করার মতো লোকও বাড়ে।
শিকারী যুগের খাদ্য তথা পশুর পরিমাণ সীমিত থাকায় তার উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি বাড়তে পারত না। কিন্তু কৃষি আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানুষের সংখ্যা বাড়লে বাড়তি মানুষেরা নতুন জমিতে চাষ করত, এই মাত্র। যতদিন পৃথিবীতে অঢেল জায়গা ছিল, ততদিন লোকসংখ্যার বৃদ্ধিতে কোনো অসুবিধাও ছিল না। নবোপলীয় যুগে খাদ্যের যোগান বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়তে শুরু করেছিল।
বৈজ্ঞানিকরা প্রমাণ করেছেন, কয়েক লক্ষ বছর স্থায়ী শিকারী যুগে মানুষের সংখ্যা যতখানি বাড়তে পেরেছিল, নবোপলীয় কৃষি যুগের কয়েক হাজার বছরে মানুষের সংখ্যা তার কয়েকশ’ গুণ বেশি হয়েছিল। একমাত্র ফ্রান্সেই উচ্চ পুরোপলীয় যুগের যতগুলো মানুষের ফসিল কঙ্কালের সন্ধান পুরাতাত্ত্বিকরা পেয়েছেন তা হল তার পূর্ববর্তী সমস্ত যুগের সর্বমোট কঙ্কালের সংখ্যার সমান। আবার উচ্চ পুরোপলীয় যুগের কঙ্কালের সংখ্যা থেকে নবোপলীয় যুগের কঙ্কালের সংখ্যা কয়েক শ’ গুণ বেশি।
শিকারী যুগে যারা সবচেয়ে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিল, তারা কিন্তু এ যুগান্তকারী কৃষি ব্যবস্থার আবিষ্কার করতে পারেনি। ম্যাগদালেনীয় প্রভৃতি প্রাগ্রসর শিকারী মানুষরা বরফ যুগের বিশেষ অনুকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো বিশেষ ধরনের সংস্কৃতি
এঙ্গোলার একটি গ্রামের শস্যের গোলা । ভেজা মাটি এবং পশুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য খুঁটির মাথায় শস্য জমা রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।
নবোপলীয় যুগের একটি কুড়াল। কাঠের হাতলে পাথরের ফলা বসিয়ে এই কুড়াল তৈরী করা হত।
ও জীবন যাত্রা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু বরফ যুগের অবসানে সে পরিবেশ ধ্বংস হযে যাওয়ায় এবং পশুপ্রাণী বিরল হয়ে যাওয়া মাত্র তারা অসহায় হয়ে পড়ল। অপরপক্ষে উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষরা শিকারী যুগে খুব বেশি সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। এরা খুব উচ্চ সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারেনি এবং কোনো বিশেষ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েনি। অথবা এরা নির্দিষ্ট কোনো এক পন্থায়ই মাত্র শিকার সংগ্রহ করতে শেখেনি।
এদের মধ্যে পুরুষরা যখন শিকার করতে যেত, মেয়েরা তখন ফলমূল এবং ঘাসের বিচি সংগ্রহ করত। আস্তানার কাছাকাছি ঘাসের বিচি পড়লে তার থেকে যখন নতুন ঘাসের জন্ম হত, সেটা দেখে দেখেই হয়তো কালক্রমে মানুষ বীজ রোপন করে বুনো ঘাসের চারা করতে শিখেছিল। এসব বুনো ঘাসই হচ্ছে আজকালকার গম, যব প্রভৃতির পূর্বপুরুষ। ধীরে ধীরে মানুষ ধান প্রভৃতির চাষও আয়ত্ত করেছে।
কিন্তু প্রথম কৃষি সমাজ গড়ে উঠেছিল গম ও যবের চাষের উপর ভিত্তি করে। এবং এ বিষয়েও বিজ্ঞানীরা একমত যে মেয়েরাই কৃষিকাজের আবিষ্কার করেছিল। পণ্ডিতদের মতে পশ্চিম এশিয়ার কোনো স্থানে প্রথম কৃষিভিত্তিক সমাজের উদয় হয়েছিল। বরফ যুগের অবসানে একদিকে যেমন এশিয়া ইউরোপের বরফাস্তীর্ণ সমভূমিতে বনভূমির উদয় হয়েছিল, তেমনি আবার উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়াতেও জলবায়ুর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল।
বরফ যুগে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে এশিয়ার ইরান পর্যন্ত ছিল একটানা তৃণভূমি। বরফ যুগের অবসানে এ তৃণভূমি পরিণত হয় মরু অঞ্চলে। মরুভূমির মাঝে মাঝে অবশ্য মরূদ্যান এবং কিছু কিছু নদী তীরবর্তী উর্বর ভুমিও থাকে। এসব স্থানের জঙ্গল ও ভূমিতে এসে জড়ো হয় আশেপাশের সব জীব জানোয়ার ও শিকারী মানুষরা। এসব জায়গায় অল্প পরিমাণ শিকারের উপর নির্ভর করা ক্রমেই কঠিন হয়ে ওঠে। এ অঞ্চলের মানুষই সম্ভবত প্রথম কৃষির আবিষ্কার করেছিল।
অবশ্য নবোপলীয় কৃষিবিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য শুধু উপযুক্ত শস্য এবং তার চাষের পদ্ধতি আবিষ্কারই যথেষ্ট না। সাথে সাথে জমি চাষ করার ও শস্য কাটার যন্ত্র বা হাতিয়ার, শস্য থেকে খাদ্য তৈরির পদ্ধতি, সারা বছর ধরে শস্য জমা করে রাখার ব্যবস্থা ইত্যাদির আবিষ্কার না হলে কৃষি ব্যবস্থার জন্ম হতে পারত না। প্রয়োজনের সাথে সাথে এ সবের আবিষ্কারও হয়েছিল। এবং আরও উল্লেখযোগ্য যে মেয়েরাই এ সবকিছু আবিষ্কার করেছিল। কারণ প্রথম অবস্থায় মেয়েরাই চাষাবাদের সাথে জড়িত সব কাজ করত।
প্রথম আমলে জমি চাষ করা হত একটা চোখা লাঠি বা শিং দিয়ে। ক্রমে লাঠির মাথায় চোখা পাথরের ফলক দড়ি দিয়ে বেঁধে আদিম ধরনের কোদাল তৈরি করতে শেখে মানুষ। এ সব কোদাল বা শিঙের হাতিয়ার দিয়ে মাটি কুপিয়ে আলগা করে মেয়েরা গম বা বার্লির দানা মাটিতে ছিটিয়ে দিত। আগের বছরের ফসল থেকে সাবধানে জমিয়ে রাখতে হত এ সব শস্যের দানা।
ফসল পাকলে প্রথম প্রথম জানোয়ারের চোয়ালের হাড় দিয়ে ফসল কাটত মেয়েরা। ক্রমশ তার অনুকরণে কাঠের কাস্তে বা হাড়ের হাতল লাগান ধারাল পাথরের কাস্তে আবিষ্কৃত হয়। নবোপলীয় যুগের সূত্রপাত সব যায়গায় এক সাথে হয়নি। পশ্চিম এশিয়ার সম্ভবত আজ থেকে আট দশ হাজার বছর আগে এর উদয় হয়েছিল। মিশরেও সাত আট হাজার বছর আগে নবোপলীয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আবার ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের আগে (অর্থাৎ এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে) ইউরোপে এ ব্যবস্থা ঠিকমত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আবার সর্বত্র এ ব্যবস্থা সমান স্থায়ী হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে মিশরে এবং তার কিছুকাল পরে ব্যাবিলনিয়ায় নবোপলীয় গ্রাম সমাজের বিলোপ ঘটে এবং তার স্থানে উদিত হয় নগরকেন্দ্রিক সভ্য সমাজ। কিন্তু ক্রীট দ্বীপ ছাড়া ইউরোপের কোনো স্থানেই ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে নবোপলীয় সমাজের বিলোপ ঘটেনি।

আর ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে তো নবোপলীয় সমাজ তার পরেও কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত টিকে ছিল। মানুষের ইতিহাসে নবোপলীয় যুগ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এ পর্যায়ে মানুষ কৃষি আবিষ্কার করেছিল, তা আমরা আগেই বলেছি। এ সময়ে মানুষ পশুপালনের কৌশল আবিষ্কার করে। কৃষি ও পশুপালন আয়ত্ত করার ফলে মানুষ খাদ্য উৎপাদনকারী হয়ে ওঠে এবং খাদ্যের অভাবে মানুষের ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা দূর হয়।
গোলায় জমান শস্য এবং পোষা পশুর পাল আয়ত্তে থাকার ফলে মানুষের অনাহারে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দূর হয়। সাথে সাথে মানুষের বস্তুগত সংস্কৃতিরও উচ্চতর বিকাশ ঘটে। সব রকম আবহাওয়ায় বেঁচে থাকার মতো ঘরবাড়ি, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি নবোপলীয় মানুষ আবিষ্কার করে।