আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাক রাজবংশীয় যুগ
প্রাক রাজবংশীয় যুগ
প্রাক রাজবংশীয় যুগ
মিশরের নোম বা নগররাষ্ট্রের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ শুরু হবার অল্পকাল পরেই (অর্থাৎ খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে) নোমগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে দুটো বড় ‘রাজ্যের সৃষ্টি করে ঃ একটা উত্তর মিশর, আরেকটা দক্ষিণ মিশর। সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে এগুলোকে একত্রিত করা হয়েছিল এ রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে এরা একত্রিত হয়েছিল, এবং সেটাই স্বাভাবিক।
কারণ একই নদীর বন্যার ওপর নির্ভরশীল বলে বাঁধ দেয়া, সেচের ব্যবস্থা করা ইত্যাদির জন্য তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুবই জরুরী ছিল। উত্তর মিশর ও দক্ষিণ মিশর রাজ্য দুটি কিছুকাল আলাদা ভাবে থাকে। কালক্রমে ৩২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে দক্ষিণ মিশরের রাজা মেনেস্-এর অধীনে এ দুটি রাজ্য ঐক্যবদ্ধ হয়। এরও একটা অর্থনৈতিক প্রয়োজন ছিল। নীলনদ একটি অতি দীর্ঘ নদী। চার হাজার মাইল লম্বা এ নদীটি আবিসিনিয়ার পর্বতমালা থেকে নেমে এসে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে।
এ নদীর গতিপথে মাঝে মাঝে রয়েছে ছ’টি বড় বড় জলপ্রপাত। মোহনার দিক থেকে দক্ষিণে প্রথম জলপ্রপাতটি রয়েছে আসোয়ান শহরের কাছে। এ সকল জলপ্রপাতকে বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত না করতে পারলে মোহনার কাছাকাছি অঞ্চলে চাষের কাজ চলতে পারে না। প্রধানত এই স্বাভাবিক প্রয়োজনেই এত প্রাচীনকালে মিশর ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালেও নীলনদকে তার উৎস থেকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়োজনে সর্বদা মিশরে একচ্ছত্র কেন্দ্রীয় শাসন বজায় রাখার দরকার হয়েছে।
৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত কালের মিশরের ইতিহাসকে বলা হয় প্রাক-রাজবংশীয় যুগ। ৩২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ মিশরের একত্রীকরণের মাধ্যমে মিশরে প্রথম বড় সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে প্রায় তিন হাজার বছর পর্যন্ত প্রাচীন মিশরের একত্রিশটি রাজবংশ রাজত্ব করে। এ রাজবংশের যুগকে তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়েছে ঃ প্রাচীন, মধ্য ও নতুন রাজত্বের যুগ।

চকমকি পাথর, তামা ও সোনা থেকে হাতিয়ার, অস্ত্র ও গয়না নির্মাণের কৌশল মিশরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, প্রাক-রাজবংশ যুগের অবদান অল্প নয়। এ যুগে আবিষ্কৃত হয়েছিল। মৃৎপাত্রকে ঔজ্জ্বল্য প্রদান ও চিত্রশোভিত করার যে প্রক্রিয়া এ যুগে আবিষ্কৃত হয়, তা উপযোগিতা ও উৎকর্ষের দিক থেকে পরবর্তীকালের তুলনায়ও উচ্চমানের ছিল। এ ছাড়া উন্নত সেচব্যবস্থা, জলাভূমির পুনরুদ্ধার, উন্নতমানের ক্ষৌমবস্ত্র বয়ন ইত্যাদিও এ যুগেরই আবিষ্কার।
এ যুগে প্রচলিত প্রথার ওপর ভিত্তি করে এক প্রকার আইনের উদ্ভব ঘটেছিল। যদিও এ সকল আইনে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ছাপ পড়েছিল স্বাভাবিকভাবেই, তথাপি তা সমাজে এমন প্রভাব অর্জন করেছিল যে পরবর্তীকালে ফারাও নিজেও এর আওতামুক্ত হতে পারেননি। এ সময়ে প্রাথমিক ধরনের লেখন পদ্ধতিরও প্রচলন হয়েছিল বলে বোধ হয়, যদিও এ যুগের লেখার কোনো সত্যিকার নমুনা এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
প্রথম রাজবংশের আমলেই লেখন পদ্ধতি এত জটিল আকার ধারণ করেছিল যে স্পষ্টই বোঝা যায়, অনেক আগেই এর উদ্ভব ঘটেছিল। এ যুগের মিশরীয়দের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হল॥ মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সৌর পঞ্জিকার আবিষ্কার। আধুনিক মিশরবিদদের মতে, ৪২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের সমকালে এ পঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়েছিল। প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট দিনে নীলনদে বন্যা হত আর সেদিনই ভোরের আকাশে লুব্ধক তারার আবির্ভাব ঘটত।
সম্ভবত এ সম্পর্কের আবিষ্কার থেকেই প্রাচীন মিশরীয়রা সৌরবছর আবিষ্কারে সক্ষম হয়। তাদের বছরে ছিল ৩০ দিনের ১২টি মাস এবং বছরের শেষে যুক্ত ৫টি দিন, মোট ৩৬৫ দিন। এত প্রাচীনকালে মোটামুটি নিখুঁত এ পঞ্জিকার উদ্ভব থেকে অনুমান করা চলে যে, গণিত এবং সম্ভবত অন্যান্য বিজ্ঞানও এ যুগে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছিল।
আরও দেখুন :