মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়

মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়

 

মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়

 

মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়

প্রাচীন মিশরীয়দের জীবনে ধর্ম বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। প্রথম অবস্থায় মিশরীয়রা পশুপাখির ওপর দেবত্ব আরোপ করত। কোনো নগরে বাজপাখি, কোনো নগরে ষাঁড়, কোথাও হরিণ দেবতার পূজা করা হত। এ সকল চিন্তাধারায় আদিম টোটেম বিশ্বাসের রেশ দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন রাজত্বের আমলে সমগ্র মিশর ঐক্যবদ্ধ হবার পর সবচেয়ে শক্তিশালী নোমের দেবতা সমগ্র জাতির দেবতায় পরিণত হল। এ সময় থেকে বিভিন্ন দেবতার স্থলে এক ‘সূর্য দেবতা’ কিংবা ‘বা দেবের’ পূজা প্রচলিত হয়।

ক্রমশ কৃষি সমাজের অনুরূপ চিন্তাধারা সমস্ত সমাজে ব্যাপ্তি লাভ করে। যেমন ওসিরিস্ এবং আইসিস্-এর পূজা। মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুসারে, ওসিরিস ছিলেন অতি প্রাচীন কালের এক ন্যায় পরায়ণ রাজা। তিনি প্রজাদের কৃষিকাজ ও অন্যান্য বিষয় শিখিয়েছিলেন। তাঁর ভাই তাঁকে হত্যা করে তাঁর দেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। অবশেষে ওসিরিসের স্ত্রী আইসিস্ তাঁর দেহের টুকরোগুলোকে একত্রিত করে তাঁর দেহে আবার প্রাণসঞ্চার করেন।

প্রাণ পেয়ে ওসিরিস্ কিছুকাল রাজত্ব করেন, তারপর পাতালে গমন করে সেখানে মৃতদের বিচারের কাজে নিয়োজিত হন। ওসিরিস্-এর পুত্র ‘হোরাস’ বড় হয়ে পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এ কাহিনীর মধ্যে শস্যবীজের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন শস্যের জন্মের কাহিনী রূপকের আকারে লুকিয়ে আছে। মধ্য রাজত্বের আমলে বিশেষ ভাবে সূর্য দেবতার পরিবর্তে ওসিরিস্-এর পূজা প্রসার লাভ করে। কিন্তু ওসিরিস্ ছিলেন মৃতের রাজা।

ইহজীবনে তাঁর কাছ থেকে কোনো পুরস্কার লাভের সম্ভাবনা ছিল না। এ যুগে মিশরীয়দের মনও পর জীবনের দিকে আকৃষ্ট হয়। পরলোক সম্পর্কে মিশরীয়দের ধারণা এ যুগেই বিকাশ লাভ করে। এ যুগে যে ধর্মবিশ্বাস প্রসার লাভ করে তা হল, মানুষের মধ্যে একটা ‘বা’ অর্থাৎ ‘আত্মা’ আছে এবং একটা ‘কা” অর্থাৎ ‘দ্বিতীয় সত্তা’ আছে। মৃত্যুর পর দেহ যদি রক্ষা পায় তাহলে ‘বা’ এবং ‘কা’ ফিরে এসে দেহকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

এ কারণেই প্রাচীন মিশরীয়রা মৃতদেহকে মমির আকারে রক্ষা করার জন্য এত আগ্রহী ছিল। ক্রমশ পারলৌকিক জীবনের ধারণা আরও পূর্ণতা অর্জন করে। পরিবর্তিত বিশ্বাস অনুসারে, মৃতদের ওসিরিস্-এর সামনে উপস্থিত হয়ে কৃতকর্মের হিসেব দিতে হত। প্রথম পর্যায়ে তাদের প্রমাণ করতে হত যে তারা ৪২টি পাপ কাজ করেনি। এ সকল পাপের তালিকায় ছিল চুরি, নরহত্যা, লোভ, মিথ্যাচার, ক্রোধ, গর্ব, অসাধুতা প্রভৃতি।

এরপর তাদের প্রমাণ করতে হত যে তারা কতগুলো সৎকাজ করেছে, যথা॥ ক্ষুধিতকে অন্ন, পিপাসার্তকে পানি, বস্ত্রহীনকে কাপড় ইত্যাদি দিয়েছে। শেষ পর্যায়ে মৃতের হৃদয়কে দাঁড়িপাল্লায় রেখে মাপা হত— তার কথার সত্যতা বিচারের জন্যে। বিচারে যারা সৎ বিবেচিত হত তাদের জন্যে ছল চিরসুখের জীবন। তারা ফলবাগানের পাশে বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারত, নদীতে বা হ্রদে নৌকাভ্রমণ করতে পারত, পাখি শিকার করতে পারত ইত্যাদি।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আর যারা সৎ জীবন যাপন করেনি তাদের চিরস্থায়ী ক্ষুধা-তৃষ্ণার কবলিত হয়ে চির অন্ধকার কারাগারে কাল কাটাতে হত। মিশরীয় ধর্ম সর্বোচ্চ পূর্ণতা লাভ করে মধ্য রাজত্বের শেষ ভাগে এবং নতুন রাজত্বের প্রথম ভাগে। এ সময়ে সূর্য দেবতা এবং ওসিরিসের পূজা এমনভাবে মিশে যায় যে দুই ধর্ম বিশ্বাসেরই ভাল দিকগুলো বজায় থাকে। জীবিতদের দেবতা ‘রা’ মৃতদের দেবতা ওসিরিস্-এর সমান মর্যাদা লাভ করেন।

কিন্তু নতুন রাজত্বের প্রতিষ্ঠার পর মিশরীয় ধর্মে অবক্ষরের লক্ষণ দেখা দেয়। মিশরীয় ধর্মের নৈতিক চিন্তার দিকগুলো লোপ পায় এবং কুসংস্কার ও যাদুবিদ্যার প্রবণতা প্রসার লাভ করে। দীর্ঘস্থায়ী হিক্সস’ আধিপত্য এবং তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কালেই সম্ভবত মিশরীয়রা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সে সুযোগে পুরোহিতরা জনসাধারণের মধ্যে অযৌক্তিক চিন্তার প্রসার ঘটায়। এ সময় পুরোহিতদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খুব বেড়ে যায়।

মানুষের পারলৌকিক ভয় ভীতি প্রভৃতির সুযোগ নিয়ে তারা অর্থের বিনিময়ে রক্ষাকবচ প্রভৃতি বিক্রি করতে শুরু করে। পুরোহিতরা কাগজের ওপর নানারকম মন্ত্রতন্ত্র লিখে মৃতদেহের সাথে তা কবরে রেখে দিত, যাতে পরলোকে বিচারে তারা শাস্তি না পায়। ধর্মের অধোগতি রোধ এবং পুরোহিতদের ক্ষমতা খর্ব করার মানসে ফারাও ইখনাটন এক ধর্ম সংস্কারের উদ্যোগ নেন— এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ইখনাটন সব পুরোহিতকে মন্দির থেকে দূর করে দেন, প্রস্তরলিপি থেকে প্রাচীন দেবতাদের নাম মুছে ফেলেন এবং নতুন এক সূর্যদেবতা ‘এ্যাটন’॥এর পূজার প্রচলন করেন। ইখ্াটনের চিন্তায় এ দেবতা ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং মানুষের পালকস্বরূপ। কিন্তু এ ধর্মসংস্কার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।

 

মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয়

 

ইখনাটনের মৃত্যুর পর পুরোহিততন্ত্র এবং কুসংস্কারের প্রতাপ আবার বেড়ে যায়। ধর্মীয় চিন্তার অবনতি মিশরের দর্শন, শিল্পকলা এবং শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের সূচনা করেছিল এবং কালক্রমে সমগ্র মিশরীয় সভ্যতাই অস্তমিত হয়েছিল।

আরও দেখুন :

Leave a Comment