মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যা

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। সুদূর অতীতে মানব প্রজাতির বিকাশের সাথে সাথে চিকিৎসাবিদ্যারও বিকাশ ঘটে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ উদ্ভিদ (Herbalism), পশুর দেহের বিভিন্ন অংশ এবং খনিজ পদার্থকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত। প্রাথমিক চিকিৎসক, পুরোহিত বা Shaman-রা এসব উপাদানকে অনেক সময় ঐন্দ্রজালিক পদার্থ হিসেবে দেখতেন এবং আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করতেন।

সেই সময়কার কিছু পরিচিত আধ্যাত্মিক চিকিৎসা প্রথা হলো—

  • প্রাণবৈচিত্র্য: আত্মার অদৃশ্য উপস্থিতি ও শক্তিতে বিশ্বাস
  • আধ্যাত্মিকতা: দেবতার কাছে প্রার্থনা বা পূর্বপুরুষের আত্মার সাথে যোগাযোগ
  • শামানবাদ (Shamanism): রহস্যময় ক্ষমতার সঙ্গে সংযোগ
  • ভবিষ্যদ্বাণী: জাদুবিদ্যার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও সত্য উদ্ঘাটন

চিকিৎসা নৃতত্ত্ব (Medical Anthropology) স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং তার সাথে জড়িত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো কিভাবে গড়ে ওঠে এবং মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে, তার বিশ্লেষণ করে।

 

 

মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যা

মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যা

 

মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যার সূচনা

মধ্য রাজত্বকাল থেকে মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যা ধীরে ধীরে কুসংস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পথে অগ্রসর হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালের একটি দলিল থেকে জানা যায়, মিশরীয়রা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করেছিল।
সে সময়ে চক্ষুরোগ, দাঁতের রোগ, পেটের অসুখ, শল্যবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মূল্যবান আবিষ্কার করেন। তারা হৃৎপিণ্ড ও নাড়ির তাৎপর্যও অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মিশরীয় চিকিৎসকেরা—

  • রেচক ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন
  • বহু ওষুধের রোগ-নিরামক গুণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন
  • মেটিরিয়া মেডিকা বা ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন

যদিও তারা স্থাপত্য, পিরামিড নির্মাণ ও ধাতুশিল্পে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানে তেমন উন্নতি করতে পারেননি। তবে, কাগজ তৈরি, কাঁচ নির্মাণ, সূর্যঘড়ি আবিষ্কারসহ প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব মিশরীয়দের উল্লেখযোগ্য অর্জন।

 

প্রাচীন যুগের চিকিৎসা জ্ঞান

ইতিহাসে মিশরের ইমহোতেপ (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দ) ছিলেন প্রথম পরিচিত চিকিৎসক। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে প্রাচীনতম মিশরীয় চিকিৎসা পাণ্ডুলিপি Kahun Gynecological Papyrus গাইনোকোলজিক্যাল রোগের বর্ণনা দিয়েছিল।

  • খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০: Edwin Smith Papyrus – সার্জারি বিষয়ক প্রথম কাজ
  • খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০: Ebers Papyrus – চিকিৎসা সংক্রান্ত বিস্তৃত পাণ্ডুলিপি, যা আধুনিক চিকিৎসা গ্রন্থের অনুরূপ

 

সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার চিকিৎসা

  • চীন: ব্রোঞ্জ যুগে শং রাজবংশের সময় অস্ত্রোপচারে বনজ ঔষধ ব্যবহৃত হতো। Huangdi Neijing ছিল দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত চিকিৎসা শাস্ত্রের মাইলফলক।
  • ভারত: শল্যচিকিৎসক সুশ্রুত (Sushruta) প্লাস্টিক সার্জারি সহ বহু অস্ত্রোপচারের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাচীন শ্রীলঙ্কার Mihintale হাসপাতাল ছিল চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নত উদাহরণ।
  • গ্রিস: হিপোক্রেটিস, “পশ্চিমা চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক”, যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করেন এবং Hippocratic Oath প্রবর্তন করেন। রোগ শ্রেণিবিন্যাসে acute, chronic, endemic, epidemic ইত্যাদি ধারণা তার অবদান। গ্যালেন ছিলেন প্রাচীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সার্জন, যিনি মস্তিষ্ক ও চক্ষু অস্ত্রোপচারেও দক্ষ ছিলেন।
  • হিব্রু চিকিৎসা: তওরাতের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইন ও রীতিনীতি ছিল চিকিৎসা প্রথার অংশ। বাইজেন্টাইন যুগে ইহুদি চিকিৎসক আসফ হিব্রু চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

 

মধ্যযুগ

মধ্যযুগে চিকিৎসাবিদ্যা নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে, বিশেষত মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাতে এর অসাধারণ অগ্রগতি সাধিত হয়। আবু আলী হোসাইন ইবনে সিনা (Avicenna) ছিলেন এই সময়ের সর্বাধিক বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক। তাকে আরবিতে বলা হতো আলশায়খ আলরাঈস বা “জ্ঞানীকুল শিরোমণি” এবং পাশ্চাত্যে তিনি অ্যাভিসিনা নামে পরিচিত। চিকিৎসাশাস্ত্রে তার রচিত বিশ্বকোষ আলকানুন ফিততীব (Canon of Medicine) ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবেও তিনি সম্মানিত।

ইসলামী চিকিৎসাবিদ্যার অবদান

৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলিম বিশ্বে হিপোক্রেটিস, গ্যালেন ও সুশ্রুতের গ্রন্থসমূহের আরবি অনুবাদ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। মুসলিম চিকিৎসকরা কেবল এই জ্ঞান অনুবাদই করেননি, বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন চিকিৎসা তত্ত্বও যুক্ত করেছেন।
প্রখ্যাত ইসলামী চিকিৎসকদের মধ্যে ছিলেন—

  • আবুল কাসিস (Abulcasis) – সার্জারির উন্নয়নে অগ্রদূত
  • আভেনজার (Avenzoar)
  • ইবনে আলনাফিসPulmonary Circulation বা ফুসফুসীয় রক্ত সঞ্চালনের আবিষ্কারক
  • আভেরোস (Averroes)
  • রাযি (Rhazes) – গ্রিক Theory of Humorism নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন
  • ইমাম আলি আলরিধাAl-Risalah al-Dhahabiah গ্রন্থ রচনা করেন, যা ইসলামী চিকিৎসা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত

এ সময়ে বিমারিস্তান ছিল মুসলিম বিশ্বের পাবলিক হাসপাতাল, যা রোগীর যত্ন ও চিকিৎসার জন্য উন্নত ব্যবস্থা প্রদান করত।

 

ইউরোপের চিকিৎসা কাঠামো

মধ্যযুগীয় ইউরোপে শার্লিমেন ঘোষণা দেন যে প্রতিটি ক্যাথেড্রাল ও মঠের সাথে একটি হাসপাতাল সংযুক্ত থাকতে হবে। এই সময়ের ক্যাথলিক চার্চ একধরনের প্রাথমিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করে—

  • বৃদ্ধাশ্রম
  • এতিমখানা
  • সকল বয়সের রোগীর জন্য হাসপাতাল
  • কুষ্ঠরোগীর জন্য আলাদা আশ্রয়
  • তীর্থযাত্রীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের হোস্টেল ও খাবারের ব্যবস্থা

দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য বিতরণ ও দরিদ্রদের সহায়তাও গির্জার দায়িত্বের অংশ ছিল। এ কার্যক্রম মূলত কর ও কৃষিজমি থেকে প্রাপ্ত আয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।

গির্জা চিকিৎসা শিক্ষা বিস্তারের জন্য ক্যাথেড্রাল স্কুলবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে ইতালির Schola Medica Salernitana ছিল গ্রিক ও আরব চিকিৎসা শাস্ত্রের মিলনস্থল এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপের সেরা মেডিকেল স্কুল।

 

চ্যালেঞ্জ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি

১৪শ ও ১৫শ শতকে কালো মৃত্যু (Black Death) মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ উভয় অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দেয়। তবে এর ফলে প্রথাগত চিকিৎসা কর্তৃত্ব (Traditional Authority) প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তার দ্বার উন্মোচিত হয়।

উল্লেখযোগ্য উন্নয়নসমূহ:

  • Andreas VesaliusDe humani corporis fabrica, মানব অঙ্গসংস্থান বিষয়ক প্রভাবশালী গ্রন্থ
  • Anthony van Leeuwenhoek (১৬৭৬) – প্রথম মাইক্রোস্কোপে ব্যাকটেরিয়া পর্যবেক্ষণ, মাইক্রোবায়োলজির সূচনা
  • Michael Servetus – স্বাধীনভাবে Pulmonary Circulation আবিষ্কার করেন (ইবনে আল-নাফিসের অনুরূপ)
  • Renaldus ColumbusAndrea Cesalpino – রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কিত গবেষণা
  • Herman Boerhaave – “শারীরবৃত্তির জনক” হিসেবে পরিচিত, Institutiones Medicae (১৭০৮) রচনা
  • Pierre Fauchard – “আধুনিক দন্তচিকিৎসার জনক” হিসেবে খ্যাত

 

মিশরীয় চিকিৎসাবিদ্যা

 

আধুনিক যুগ

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হলো ঊনবিংশ ও বিংশ শতক। এই দুই শতকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানে ঘটে বিপ্লবাত্মক উন্নয়ন। বিশেষ করে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে সংঘটিত দুইটি বিশ্বযুদ্ধ যুদ্ধকালীন প্রয়োজনের কারণে চিকিৎসা কৌশল ও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির পথ খুলে দেয়।

 

পশুচিকিৎসার সূচনা

১৭৬১ সালের দিকে মানব চিকিৎসা থেকে আলাদা একটি শাখা হিসেবে পশুচিকিৎসা ব্যবস্থা শুরু হয়। ফ্রান্সের পশুচিকিৎসক ক্লড বুর্জেলাট লিয়নে বিশ্বের প্রথম পশুচিকিৎসা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে মানুষের চিকিৎসকেরাই পশু চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করতেন।

 

আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার ভিত্তি

আধুনিক বায়োমেডিক্যাল গবেষণা পশ্চিমা ভেষজ চিকিৎসার ঐতিহ্য থেকে বিকশিত হয়। ধীরে ধীরে গ্রিক Four Humours তত্ত্ব ও অন্যান্য প্রাক-আধুনিক ধারণা পরিত্যক্ত হয়।

  • ১৮শ শতকের শেষ: এডওয়ার্ড জেনারের Smallpox Vaccine আবিষ্কার (এশিয়ার প্রচলিত ইনোকুলেশন পদ্ধতি দ্বারা অনুপ্রাণিত)
  • ১৮৮৮: রবার্ট কোখের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ সংক্রমণ আবিষ্কার
  • ১৯০০এর কাছাকাছি: অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার

 

বিখ্যাত আধুনিক চিকিৎসা ব্যক্তিত্ব

জার্মানি অস্ট্রিয়া: রুডলফ বীরখো, উইলহেল্ম কনরাড রন্টজেন, কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার, অটো লোই
যুক্তরাজ্য: আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, জোসেফ লিস্টার, ফ্রান্সিস ক্রিক, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল
স্পেন: সান্তিয়াগো র্যামন ই কাজাল (আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের জনক)
নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া: মরিস উইলকিন্স, হাওয়ার্ড ফ্লোরি, ফ্রাঙ্ক ম্যাকফার্লেন বার্নেট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: উইলিয়াম উইলিয়ামস কিন, উইলিয়াম কলি, জেমস ডি. ওয়াটসন
ইতালি: সালভাদর লুরিয়া
সুইজারল্যান্ড: আলেকজান্ডার ইয়ারসিন
জাপান: কিতাসাটো শিবাসাবুরো
ফ্রান্স: জঁ মার্টিন শারকো, ক্লদ বার্নার্ড, পল ব্রোকা
রাশিয়া: নিকোলাই করতোকভ
কানাডা যুক্তরাষ্ট্র: স্যার উইলিয়াম ওসলার, হার্ভি কুশিং

 

ফার্মাকোলজি টিকা

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফার্মাকোলজি হার্বালিজম থেকে বিকশিত হয়ে উচ্চপ্রযুক্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদিও অনেক আধুনিক ওষুধ এখনও উদ্ভিদজাত উৎস থেকে আসে—

  • অ্যাট্রোপিন
  • ইফেড্রিন
  • ওয়ারফারিন
  • অ্যাসপিরিন
  • ডিজক্সিন
  • ভিনকা অ্যালকালয়েড
  • ট্যাক্রোলিমাস
  • হাইসোসিন

টিকা: এডওয়ার্ড জেনার (Smallpox), লুই পাস্তুর (রেবিস ও অ্যানথ্রাক্স)

প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক: সালভারসান (Arsphenamine), ১৯০৮ সালে পল এরলিখের আবিষ্কার, পরে সালফা ওষুধ উন্নত হয়।

 

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি জেনেটিক্স

আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি নির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার জন্য লক্ষ্যভিত্তিক ওষুধ তৈরি এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জেনোমিক্সজেনেটিক্স-এর উন্নতি মনোজেনিক জেনেটিক ডিসঅর্ডারের কারণকারী জিন শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যা ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা (Personalised Medicine) বিকাশে সহায়তা করছে।
আণবিক জীববিদ্যা ও জেনেটিক প্রযুক্তি চিকিৎসা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

Leave a Comment