আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মিশরীয় শিল্পকলা
মিশরীয় শিল্পকলা
মিশরীয় শিল্পকলা
প্রাচীন মিশরের শিল্পচর্চার অনুরূপ প্রকাশ ঘটেছিল স্থাপত্যশিল্পে। প্রাচীন মিশরের পিরামিড ও মন্দিরসমূহ স্থাপত্যবিদ্যায় মিশরীয়দের চরম উৎকর্ষের নির্দশন বহন করছে। মিশরে চিত্রাঙ্কন এবং ভাস্কর্যেরও বিকাশ ঘটেছিল। তবে তা ছিল মূলত স্থাপত্যশিল্পের সাথে যুক্ত।
মিশরের পিরামিডের বর্ণনা আগেই দেয়া হয়েছে। কুড়ি বাইশ লাখ বিশাল পাথরের টুকরোকে নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়ে দিয়ে চার পাঁচশো ফুট উঁচু পিরামিড তৈরি করতে যে বিজ্ঞান ও কারিগরি কৌশল জানা আবশ্যক, তা তারা আয়ত্ত করেছিল। পিরামিডের তাৎপর্য অনুধাবন করা খুব কঠিন। তবে পিরামিড নির্মাণের পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বিশেষ আছে বলে বোধ হয় না, বরং তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য থাকতে পারে।
পিরামিড সম্ভবত ছিল দেশের ও জাতির চিরস্থায়িত্বের প্রতীক। প্রাচীন মিশরে ফারাওকে মনে করা হত সমগ্র জীবনের মূর্ত রূপ। সুবিশাল পিরামিডের অভ্যন্তরে ফারাওয়ের মৃতদেহ বা মমিকে সংরক্ষিত রাখার রীতি হয়তো এ বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে উঠেছিল।
মধ্য ও নতুন রাজত্বের কালে পিরামিডের পরিবর্তে সুবিশাল মন্দিরসমূহ মূল স্থাপত্য কীর্তিরূপে স্থান অধিকার করে।
ফারাওয়ের মৃতদেহকে মমিরূপে রাখার প্রবণতা এ যুগে দেখা যায় না, ফারাওকে সমগ্র জাতির প্রতীক হিসাবে দেখার প্রবণতাও লোপ পেয়েছিল। অপর পক্ষে জাতীয় পরাক্রম এবং স্থায়িত্বের প্রকাশ হিসাবে সুবিশাল আকারে মন্দির নির্মাণের রীতি প্রচলিত হয়। কর্ণাকের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনো নতুন রাজত্বের যুগের অত্যুচ্চ শিল্পরীতি ও কৌশলের পরিচয় বহন করছে।
প্রাচীন মিশরীয় মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সুবিশাল আকৃতি। কর্ণাকের মন্দিরের দৈর্ঘ্য ছিল ১৩০০ ফুট। এ বিশাল মন্দিরের কেন্দ্রীয় হল ঘরেই ইউরোপের যে কোনো বড় গীর্জার স্থান অনায়াসে হতে পারত। কিন্তু মিশরীয় পুরোহিতবর্গ এতেও তৃপ্ত হয়নি। কৃত্রিম পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা এ মন্দিরকে আরও বৃহৎরূপে প্রতিভাত করে তোলার চেষ্টা করেছে।
যেমন, মন্দিরের ছাদের উচ্চতা প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু করে পিছনের দিকে ক্রমশ নামিয়ে আনা হয়েছিল, যাতে মন্দিরে প্রবেশ করলে মনে হয় মন্দিরের মেঝে অসীম দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মন্দিরের স্তম্ভগুলো ছিল সুবিশাল আয়তনের। সবচেয়ে বড় স্তম্ভগুলো ছিল সত্তর ফুট উঁচু আর সেগুলোর পরিধি ছিল ২০ ফুটেরও বেশি। হিসাব করে দেখা গেছে যে, এসব স্তম্ভের মাথায় একশো জন লোকের দাঁড়াবার জায়গা ছিল।
মন্দিরের দেয়ালও ছিল চার পাঁচ ফুট চওড়া। অশক্ত বা দুর্বল মালমশলা দিয়ে মন্দির নির্মিত হয়েছিল বলে যে মন্দিরের দেয়াল ও থামগুলোকে চওড়া করতে হয়েছিল, তা নয়। বস্তুত মিশরীয়রা সবচেয়ে শক্ত পাথর ছাড়া অন্য কিছুই ব্যবহার করত না। তাই মনে হয়, রাজকীয় গৌরব, জাতীয় গর্ববোধ এবং রাষ্ট্রের পরাক্রম ও স্থায়িত্বের প্রতীকরূপেই এ ধরনের নির্মাণরীতি অবলম্বন করা হয়েছিল।
প্রাচীন মিশরে ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কনশিল্প প্রধানত স্থাপত্যশিল্পের অনুসঙ্গী রূপেই উদিত হয়েছিল। পিরামিড ও মন্দিরের, অভ্যন্তরে স্থাপন ও মন্দির গাত্র অলঙ্করণের প্রয়োজনেই এ সকল শিল্পরীতির প্রবর্তন হয়েছিল। মিশরীয় ভাস্কর্যের সুপরিচিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে সম্রাটদের সুবিশাল মূর্তি। নতুন রাজত্বের আমলে যে সব মূর্তি নির্মিত হয়েছিল। সেগুলো ছিল পঁচাত্তর থেকে নব্বই ফুট পর্যন্ত উঁচু।

ফারাওদের এ সকল বিশাল মূর্তির মধ্য দিয়ে তাদের এবং তাদের রাষ্ট্রের পরাক্রম ও শক্তিকেই প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছে। একই প্রয়াসের প্রকাশ দেখা যায় প্রাচীন আমলের ‘স্ফিংস্’- ফারাওয়ের মুখ বসিয়ে দিলে হয় স্ফিংস। ফারাও যে সিংহের মতোই সাহসী ও শক্তিধর, স্ফিংস প্রতীকটির মধ্য দিয়ে এ ভাবটিই পরিস্ফুট করার চেষ্টা হয়েছে। মিশরীয় চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হচ্ছে ইখনাটনের আমলের ও তাঁর ঠিক পরের আমলের চিত্রসমূহ।
এ আমলের দেয়ালচিত্রে শিল্পীরা তাঁদের পরিচিত জগৎকে আশ্চর্য সুন্দরভাবে রূপায়িত করেছেন। যেমন, জলাভূমির ছুটন্ত ষাঁড়, পলায়নরত হরিণ, ফুল ও ফলশোভিত গাছ প্রভৃতির রঙিন ছবি তখনকার মন্দিরের দেয়ালসমূহকে সুশোভিত করেছিল। মিশরীয় চিত্রকলার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে মানুষের ছবি আঁকার ক্ষেত্রে। মানুষের চেহারা আঁকার সময়ে প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা মুখের পার্শ্বভাগ এবং সম্মুখভাগ একই সাথে আঁকত।
যেখানে অনেক মানুষের ছবি আঁকা হত সেখানে প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ছবি অন্যদের চেয়ে বড় আকারে আঁকা হত। অভিজাত ব্যক্তিদের চেহারাকে বাস্তবসম্মত ভাবে না এঁকে আদর্শ চেহারা রূপে আঁকা হত। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে রাজা বা অভিজাত ব্যক্তিদের চেহারার কোনো বিশেষ লক্ষণ থাকলে ঐ বৈশিষ্ট্যকে আঁকা চলত। মানুষের ছবি আঁকার সময় একটা অনুপাতের নিয়ম মেনে চলা হত।
যেমন, চিত্রের পুরো দৃশ্যপটকে অনেকগুলো বর্গাকার ছকে বিভক্ত করা হত এবং একজন অভিজাত পুরুষ বা মহিলার ছবি কতগুলো ছক জুড়ে আঁকতে হবে তা আগে থেকেই ঠিক করা থাকত ৷ মিশরীয় চিত্রকলার যে রীতি মানুষের ছবি আঁকার ক্ষেত্রে অনুসৃত হত, অন্যান্য দৃশ আঁকার ক্ষেত্রেও ঐ একই রীতির অনুসরণ করা হত।
অর্থাৎ, যে দৃশ্যের ছবি আঁকা হচ্ছে, ঐ স্থানে অবস্থানরত একজন দর্শকের চোখে দৃশ্যটা যেমন দেখাবে, ছবিটা সে অনুযায়ী আঁকা হবে না; ছবিটা আঁকা হবে ঐ দৃশ্যের উপাদানগুলোর প্রকৃত রূপ যেমন, সে অনুযায়ী। এ কথাটা মানুষ, পশুপাখি, ঘরবাড়ি সবকিছু সম্পর্কেই প্রযোজ্য। যেমন, প্রাচীন মিশরীয় চিত্রে ঘরবাড়ির ছবি আঁকা হত অংশত নকশার আকারে, অংশত উচ্চতা প্রদর্শন করে।
আবার, গাছে ঘেরা একটা পুকুরের ছবি হয়তো এমন ভাবে আঁকা হত, যেমনটা আমরা দেখতে পাব ওপর থেকে পুকুরের দিকে তাকালে— একটা সমতলীয় পানির স্তরের মতো। ছইয়ে ঢাকা বড় নৌকায় করে গরুর পাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— এ দৃশ্যটাকে প্রাচীন মিশরীয় চিত্রে আঁকা হবে এমন ভাবে যে মনে হয় গরুগুলো নৌকার ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যদিও বুঝে নিতে হবে যে, আসলে গরুগুলো দাঁড়িয়ে আছে ছইয়ের ওপরে নয়, ভেতরে।
একই ভাবে, জাল পেতে পাখি ধরার দৃশ্য আঁকতে গিয়ে প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা জালটাকে সমতলীয়ভাবে আঁকতেন, যাতে জালে আটকা পড়া পাখিগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখতে ও গুণতে পারা যায়। মিশরীয় শিল্পীরা বর্ণনামূলক বা ঘটনাপূর্ণ দৃশ্যের ছবি আঁকার জন্যে আনুভূমিক ছকের সাহায্য নিতেন। আমাদের রুলটানা কাগজের মতো আনুভূমিক সারিতে সাজিয়ে তাঁরা ছবি আকতেন। অনেক সময় বর্ণনামূলক চিত্রের বিভিন্ন উপাদানকে পৃথক করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
যেমন, একই ছবিতে আঙুরের খেত, যুদ্ধের দৃশ্য, ফসল কাটার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, কোথায় কোনটার শুরু, কোথায় শেষ বোঝা যায় না।
কাছের আর দূরের জিনিসের ছবি আঁকার জন্যে বর্তমান কালের শিল্পীরা যে চিত্রানুপাত বা পার্সপেকটিভ (ণেরষণর্ড ধশণ)-এর কৌশল অবলম্বন করেন, প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীদের নিকট তা অজানা ছিল।
দৃশ্যস্থলে উপস্থিত কোনো দর্শকের সবচেয়ে কাছের বস্তুগুলোকে চিত্রপটের নিচের অংশে আঁকা হত, আর ক্রম অনুসারে দূরের জিনিসকে ক্রমশ পটের ওপরের অংশে আঁকা হত। কাছের আর দূরের আঁকার জন্যে একই পরিমাপ (ওডটফণ) ব্যবহার করা হত। অর্থাৎ, এখনকার শিল্পীরা যেমন কাছের জিনিসকে বড় আর দূরের জিনিসকে ছোট করে আঁকেন, প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা তা করতেন না।
তাঁরা কাছের গরুটাকে চিত্রপটের নিচের দিকে আঁকতেন আর দূরের গরুটাকে পটের উপরের অংশে আঁকতেন। কিন্তু দুটো গরুর ছবিই সমান আকারের এবং একই মাপের হত।
আরও দেখুন :