২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রাক্কালে মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সুমের–আক্কাদ সাম্রাজ্যের ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত শক্তির সুযোগ নিয়ে আরব অঞ্চল থেকে আগত আমোরাইট জাতি আক্কাদ অঞ্চল অধিকার করে নেয়। একদিকে এলামদেশীয় উপজাতিরাও সুমের অঞ্চল দখল করার চেষ্টা চালায়। এ দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই বেধে উঠে, যার পরিণামে এলামদেশীয়রা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। বিজয়ী আমোরাইটরা তাদের শক্তির কেন্দ্রস্থল হিসাবে ‘ব্যবিলন’ নগরকে নির্বাচন করে। দ্রুত সময়ের মধ্যে, ব্যবিলন নগর হয়ে ওঠে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে।
ব্যবিলনীয় সভ্যতার উদয়
ব্যবিলনীয় সভ্যতার উদয় ও প্রসার
প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে আমোরাইট শাসক হাম্মুরাবির শাসনামলে (প্রায় ১৯৭২–১৭৫০ খৃিঃ পূঃ)। হাম্মুরাবির আমলে ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ শক্তি ও প্রসারে পৌঁছে। পরবর্তীকালের নব ব্যবিলনীয় বা ক্যালডীয় সভ্যতার সঙ্গে পার্থক্য রাখার জন্য এ পর্যায়কে প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতা বলা হয়। মেসোপটেমীয় সভ্যতার বিবর্তনের এটি দ্বিতীয় ধাপ। হাম্মুরাবি উত্তরদিকে অবস্থিত মারি রাজ্য জয় করে এবং আরও বিস্তৃত এলাকা, যেমন আসিরিয়া পর্যন্ত, নিজের অধীন নিয়ে সাম্রাজ্যের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার করেন।

হাম্মুরাবির অবদান: আইন ও শাসনব্যবস্থা
হাম্মুরাবি শুধুমাত্র একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বের প্রথম বিশিষ্ট আইনপ্রণেতা। তাঁর ‘হাম্মুরাবি আইন-সংহিতা’ বিশ্ব ইতিহাসে বিখ্যাত। এই আইনপুস্তিকা থেকে প্রাচীন ব্যবিলনের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সামাজিক শ্রেণী সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যায়। তৎকালীন সমাজে পুরোহিত, ভূস্বামী, বণিক, ভূমিদাস এবং দাস শ্রেণীর স্বতন্ত্র অবস্থা ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল। আইন-সংহিতাটি সামাজিক শৃঙ্খলা, সম্পত্তির অধিকার, বাণিজ্যিক লেনদেন, দণ্ডবিধি এবং পারিবারিক আইন ইত্যাদি ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছিল।
হাম্মুরাবির পরবর্তী সময়: কাসাইটদের আধিপত্য
হাম্মুরাবির মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্যের শক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। আনুমানিক ১৬৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে কাসাইটরা ব্যবিলন দখল করে এবং প্রায় ছয়শো বছর পর্যন্ত এখানে শাসন করে। কাসাইটরা পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা থেকে আগত বর্বর জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা ব্যবিলনীয় সংস্কৃতিতে তেমন আগ্রহ প্রদর্শন করেনি, তবে মেসোপটেমীয় অঞ্চলে ঘোড়ার প্রবর্তন তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান। কাসাইটদের শাসনামলে ব্যবিলন একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে টিকে থাকে।
সমকালের রাজনৈতিক পরিবর্তন: মিতানি এবং আসিরিয়ার উত্থান
কাসাইটদের শাসনামলের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর মেসোপটেমিয়ায় আরেকটি শক্তিশালী রাজ্য ‘মিতানি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মিতানি ছিল আর্যভাষী একটি সাম্রাজ্য, যা কাসাইটদের সাথে একসময় শাসনাধীনে ছিল। তবে উভয় রাজ্যই একপর্যায়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে যায়। এরপর মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসে আসে বিশাল ক্ষমতা সম্পন্ন আসিরীয় সাম্রাজ্য। আসিরীয়রা প্রাচীন ব্যবিলনীয় সংস্কৃতির বহু অংশ রক্ষা করে, সংরক্ষণ করে এবং উন্নয়ন ঘটায়। তাদের শক্তিশালী সামরিক ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার নানা সংস্কৃতির একত্রিতকরণে সহায়ক হয়।
সুমের–আক্কাদ যুগের পতনের পর আমোরাইটদের নেতৃত্বে ব্যবিলনীয় সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার এক নতুন যুগের সূচনা করে। হাম্মুরাবির আইন–সংহিতা এবং কাসাইটদের দীর্ঘ শাসনকাল এই সভ্যতাকে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায় করে তোলে। এরপরে মিতানি এবং আসিরীয় শক্তির আবির্ভাব মেসোপটেমীয় অঞ্চলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে, প্রাচীন সভ্যতার ধারা অব্যাহত রাখে এবং বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে।